শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম

মহানবী (সা.)-এর মহানুভবতা-২

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৯ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

মক্কা বিজয়কালে আবূ সুফয়ান ধৃত হয়ে নবী কারীম (সা.)-এর সামনে নীত হন। দুর্ধর্ষ এ আসামির সঙ্গে সেদিন তিনি কী আচরণ করেছিলেন? প্রতিশোধ গ্রহণ? অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য ধিক্কার? সরোষ তিরস্কার? না কতলের হুকুম? এমন কিছু হওয়াই তো স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু নবী-জীবনে এ জাতীয় সঙ্কীর্ণ স্বাভাবিকতার কোনো স্থান নেই। তিনি যা করলেন, আবূ সুফয়ানের পক্ষে তা ছিল অকল্পনীয়। তিনি তাকে ক্ষমা করেই ক্ষান্ত হলেন না, তাকে বানিয়ে দিলেন অন্য সব শত্রুরও প্রাণরক্ষার ঠিকানা। ঘোষণা করে দিলেনÑ আজ যে ব্যক্তি আবূ সুফয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে সেও নিরাপদ।

এমন মহানুভবতা কে কবে দেখেছে? মন থেকে শত্রুর আঘাত-চিহ্ন কতটা মুছে ফেললে এমন মহানুভবতা দেখানো সম্ভব? এ মহানুভবতারই সুফল যে, আবূ সুফয়ান আর শত্রু আবূ সুফয়ান থাকেনি। এর পর থেকে তিনি হয়ে যান হযরত আবূ সুফয়ান (রা.), যিনি ইসলাম গ্রহণ করে প্রিয়নবী (সা.)-এর উৎসর্গিত প্রাণ সাহাবীদের তালিকায় নিজের স্থান করে নেন। এবার তিনি তাঁর পাশাপাশি থেকে যুদ্ধ করতে থাকেন এত দিনকার লালিত শিরক ও কুফরের বিরুদ্ধে আর এভাবে ঈমানে উদ্বেলিত রক্ত ঢেলে অতীতের সব গ্লানি মুছে ফেলেন। যুদ্ধ করেছেন হুনায়ন ও তায়েফে।

তায়েফের যুদ্ধে তিনি এক চোখ হারিয়েছেন। তাঁর সে চোখ দ্বীনের সেবায় উৎসর্গিত, যার প্রতিদানে তিনি নবী কারীম (সা.)-এর জবানীতে পান জান্নাত লাভের আশ্বাস। নবী কারীম (সা.)-এর ওফাতের পরও তিনি ইসলামের সেবায় সমর্পিত থেকেছেন। যুদ্ধ করেছেন ইয়ারমুকে। এ যুদ্ধেও ছিল তাঁর বলিষ্ঠ ও প্রশংসনীয় ভূমিকা। এ যুদ্ধে তাঁর দ্বিতীয় চোখেরও শাহাদাত নসীব হয়। মলিনতা মুছে ফেলার সুন্নত এভাবেই একদার ঘোরতর শত্রুকে দ্বীনের একজন পরম সেবকে পরিণত করেছে। আজ আমরা মহান এ সাহাবীকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকি।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় হযরত ইকরিমা (রা.)-এর অবস্থাও। তিনি আবূ জাহেলের পুত্র। আবূ জাহেল ছিল এ উম্মতের ফির‘আউন। বদরের যুদ্ধে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত ইসলাম ও ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে তার পক্ষে যা কিছু সম্ভব ছিল সবই করেছে। প্রিয়নবী (সা.)-কে গালাগাল করেছে। সাহাবীগণের ওপর অত্যাচার করেছে। নবী কারীম (সা.) ও তাঁর বংশের লোকজনকে বয়কট করেছে। তার সে বর্বরতা মানবেতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।

সবশেষে প্রিয়নবী (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছে, যে কারণে তিনি হিজরত করতে বাধ্য হন। ইসলাম ও ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে তার সীমাহীন আক্রোশ ও বিদ্বেষ তার পুত্রতেও সংক্রমিত হয়েছিল। সুতরাং সকল জুলুম-অত্যাচারে ইকরিমাও তার বাবার এক অন্ধ সহযোগী হয়ে থেকেছে। উহুদের যুদ্ধে ইসলামী মুজাহিদদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল, তাতে সে-ই ছিল শত্রুপক্ষের মহানায়ক। সে তার শত্রুতা কোনোক্রমেই পরিত্যাগ করতে পারছিল না। মক্কা বিজয়কালে যখন অসহায় মুশরিকগণ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল, তখনও সে তার একদল সহযোগীসহ প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।

বলতে গেলে রক্তপাতহীন সে বিজয়ে কিছুটা হলেও যে রক্ত ঝরেছিল, সে জন্য ইকরিমাই দায়ী। তারপর সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হলো। দলে দলে মক্কাবাসী ইসলাম গ্রহণ করতে থাকল। কিন্তু ইকরিমার অন্তর থেকে ইসলামবিদ্বেষ কিছুতেই নামে না। পণ করল, ইসলামের অধীন মক্কায় সে থাকবেই না। থাকা সম্ভবও ছিল না। কারণ মক্কাভূমি এখন ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত। শিরকের অন্ধকার নিয়ে এখানে অবস্থান সম্ভব নয়। অগত্যা মক্কা ছেড়ে ইয়েমেন অভিমুখে যাত্রা করল। কিন্তু তার পক্ষে সেখানে পৌঁছা সম্ভব হয় না। মাঝপথ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। নিরুপায় ইকরিমা সোজা গিয়ে হাজির হয় নবী কারীম (সা.)-এর মজলিসে।

তখন প্রিয়নবী (সা.) কী আচরণ তার সাথে করলেন? দর্পিত বিজেতাগণ যা করে, সেরকম কিছু? না, মহাহৃদয়ের মহানবী উঠে তাকে স্বাগত জানালেন। বললেন : ‘আরোহী মুহাজিরকে স্বাগতম, স্বাগতম!’। এ মহানুভবতা ইকরিমার জীবন বদলে দিলো। ইসলামের ঘোর শত্রু ইকরিমা এখন থেকে ইসলামের পরম সেবক। জন্মগত বীরত্ব তো ছিলই। ঈমানের স্ফূলিঙ্গ তাতে বাড়তি তেজ যোগাল। এতদিন তো ইসলামের বিরুদ্ধে শক্তিক্ষয় করছিলেন, এবার শুরু করলেন দ্বীন প্রতিষ্ঠায় রক্তদান। প্রাণ বাজি রেখে একের পর এক রণক্ষেত্রে ছুটে যান।

অক্লান্তভাবে জিহাদ করতে থাকেন। পরিশেষে ইসলামী ইতিহাসের এ বীর মুজাহিদ আজনাদাইনের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। এ আর কিছুই নয়, অন্তর থেকে মলিনতা মুছে ফেলার সুফল। মহানবী (সা.) আঘাতের বদলে ভালোবাসা দানের সুন্নত দ্বারা এরকম বহু শত্রুর জীবন বদলাতে সক্ষম হয়েছিলেন, যাদের বদলে ফেলা সে জীবন ইসলামের সোনালি ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন