আরবী ‘লা’নাতুন’ শব্দটির মূল ধাতু হচ্ছে ‘লা’নুন’। ‘লা’নাতুন’ শব্দটি আল কোরআনে ১৩ বার ব্যবহৃত হয়েছে। আর ‘লা’নুন’ ধাতু থেকে উৎপন্ন ক্রিয়াপদ, সম্বন্ধ পদ এবং কর্তাপদ একবচন ও বহু বচনে ব্যবহৃত হয়েছে ২৪ বার। একুনে বিভিন্ন আঙ্গিকে শব্দটির ব্যবহার আল কোরআনে ৩৭ বার লক্ষ্য করা যায়। ৩৭ সংখ্যাটির একক (৩+৭)=১০। এবং ১০ এর একক (১+০) =১ অর্থাৎ আল্লাহ। আল্লাহ পাকই নির্ধারণ করেন কার ওপর লা’নত দুনিয়া ও আখেরাতে বর্ষিত হবে।
মহান আল্লাহপাক পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) কে খেতাব করে ইরশাদ করেছেন : আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যাদের কিতাবের এক অংশ দেয়া হয়েছিল, তারা মূর্তি ও শয়তানে বিশ^াস করে? তারা কাফেরদের সম্পর্কে বলেÑ এদের পথই মুমিনদের চেয়ে উৎকৃষ্টতর। এরাই তারা, যাদের আল্লাহ লা’নত করেছেন এবং আল্লাহ যাকে লা’নত করেন আপনি কখনো তার কোনো সাহায্যকারী পাবেন না। (সূরা নিসা : ৫১, ৫২)।
আরবী লা’নত শব্দটির আভিধানিক অর্থ অভিশম্পাত, আল্লাহর রহমত হতে দূর হয়ে যাওয়া, চরম অপমান ও অপদস্ততা। ইসলামী শরীআতের পরিভাষায় এর অর্থ কাফেরদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া। আর মুমিনদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলে আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী সৎকর্মশীলদের মর্যাদা থেকে নীচে পড়ে যাওয়া। এ জন্যই কোনো ঈমানদারের প্রতি তার নেক আমল কমে যাওয়ার দোয়া করা যায়েজ নয়। (শামী ২/৮৩৬)।
আর যার ওপর আল্লাহর লা’নত বর্ধিত হয় সে কখনও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারেনা। আল কোরআনে তাদের সম্পর্কে কঠিন অপদস্ততার কথা বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : যাদের ওপর আল্লাহর অভিশম্পাত বর্ধিত হয়েছে, তারা যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই নিহত অথবা ধৃত হবে। (সূরা আল আহযাব : আয়াত-৬১)। এ তো হল তাদের পার্থিব অপদস্ততার কথা। আখেরাতে তাদের অপমান এর চেয়েও কঠিন হবে। এই দিক নির্দেশনাই আলোচ্য আয়াতে কারিমায় প্রদান করা হয়েছে যে আল্লাহর লা’নত যার ওপর পতিত হয়, আপনি কখনো তার কোনো সাহায্যকারী পাবেন না।’ এ আয়াতের দ্বারা বুঝা যায় যে, যার ওপর আল্লাহর লা’নত বর্ধিত হয় তার কোনো সাহায্যকারী থাকে না।
এখন চিন্তা করার বিষয় এই যে, আল্লাহর লা’নত বা অভিশম্পাতের যোগ্য কারা? এতদ সংক্রান্ত কতিপয় হাদীস উল্লেখ করা হল। ১. রাসূলুল্লাহ (সা.) সুদগ্রহীতা এবং সুদদাতা, সুদসংক্রান্ত দলিল সম্পাদনকারী এবং সুদের লেনদেনের সাক্ষী সবার প্রতিই অভিশম্পাত করেছেন। এদের সবাই পাপের ক্ষেত্রে সমান। (সহীহ মুসলিম : ১৫৯৮)। ২. অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে লোক লূত (আ.)-এর সম্প্রদায়ের অনুরূপ কর্মে লিপ্ত হবে, সে অভিশপ্ত হবে। (মুস্তাদরেকে হাকেম : ৪/৩৯৬)।
৩. অত:পর তিনি বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা চোরদের প্রতি ও অভিশম্পাত করেন। যে ডিম কিংবা রশিরমত সাধারণ বস্তু ও চুরি থেকে বিরত থাকে না, তারও হাত কাটা হয়। (সহীহ বুখারী : হাদীস নং-৬৪০১)। ৪. আর এক হাদীসে বলা হয়েছে, সুদগ্রহীতা ও দাতার ওপর আল্লাহতায়ালার লা’নত এবং সে সমস্ত নারীর উপর যারা নিজেদের শরীর কেটে উল্কি আঁকে, যে অন্যের শরীর কেটে ও উল্কি এঁকে দেয়, তেমনিভাবে চিত্রকারের উপরও আল্লাহর লা’নত। (সহীহ বুখারী : ১৯৮০)।
উল্লিখিত আয়াতে কারীমায় ‘জি¦ব্ত’ এবং ‘তাগুত’ শীর্ষক দু’টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এই শব্দ দুটির অর্থ ও মর্ম সম্পর্কে তাফসীরকার মনাষীবৃন্দের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। যেমন (ক) হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আবিসীনীয় ভাষায় ‘জি¦বত’ বলা হয় যাদুকরকে। আর তাগুত বলা হয় গনক বা জ্যোতিষীকে। (খ) হযরত ওমর (রা.) বলেন, ‘জি¦রত’ অর্থ জাদু এবং ‘তাগুত’ অর্থ শয়তান। (গ) হযরত মালেক বিন আনাস (রা.) বলেন যে, আল্লাহ ছাড়া যে সমস্ত জিনিসের এবাদত, উপাসনা, পূজা করা হয়, সে সবই ‘তাগুত’ বলে অভিহিত হয়। (ঘ) ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন যে, হযরত মালেক ইবনে আনাস (রা.) এর উক্তিটিই অধিক পছন্দনীয়। তার কারণ আল কোরআন থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ‘তাগুত’ হতে বেঁচে থাক। (সূরা নাহল : ৩৬)।
স্মরণ রাখা দরকার যে উল্লেখিত বিভিন্নমতের মাঝে কোনো বিরোধ নেই। কাজেই এর যে কোনো একটিই গ্রহণ করা যায়। প্রকৃত পক্ষে ‘জি¦বত’ বলতে প্রতীমাকেই বোঝায়। পরে এই শব্দটি আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য পূজ্য বস্তুর ক্ষেত্রে ও প্রয়োগ হতে থাকে। (রূহুল মায়ানী)। আর ‘তাগুত’ শব্দটি আরবী ভাষায় সীমালংঘনকারী ব্যক্তিকে বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রসিদ্ধ তাগুত পাঁচ প্রকার। যথা : (১) শয়তান, (২) যে অদৃশ্যের জ্ঞান রয়েছে বলে দাবি করে। (৩) যে আল্লাহর বিধানের বিপরীত ফায়সালা দেয়। (৪) আল্লাহ ছাড়া যার ইবাদত করা হয় এবং যে ইবাদত করে। (৫) যে মানুষকে নিজের ইবাদতের দিকে ডাকে। (কিতাবুত তাওহীদ)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন