ভোরের সূর্যই বলে দেয় কেমন যাবে দিন- এমন প্রবাদের প্রাচীনতাও কখনো কখনো অসাড় হয়ে পড়ে। মুহূর্তরাই হয়ে ওঠে জাদুকর। মোহাবিষ্ট মুহূর্ত বদলে দিয়ে সব হিসেব-নিকেশ নতুন রূপকথার ডালি খোলে, ডানা মেলে ভিন্ন গল্পের অচিন পাখি।
বিশ্বকাপের বড় মঞ্চও সেই গল্পে মুগ্ধ। যেমন রোববার মুগ্ধ হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেইড। অবিশ্বাস্য আখ্যান লিখেছে নেদারল্যান্ডস। মাইটি দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দিয়েছে আনকোরা ডাচরা। হঠাৎ কোনো মহাদেশ আবিষ্কার করা নাবিকের মতো তাদের চোখেমুখে সেকি উচ্ছ্বাস। হলান্ডের সুখে বুকে বেদনার শেল নিয়ে বাড়ি ফিরেছে প্রোটিয়ারা, তাদের যেন শেষ হয়েও হইলো না শেষ। তীরে এসে তরী ডোবা হয়তো একেই বলে। টেবিল টপার থেকে হঠাৎ পতনে সেমিতে খেলার স্বপ্ন ভঙ্গ।
তবে কথায় তো বলে নদীর একূল যখন ভাঙে, তখন ওপাড়ে গড়ার খেলা চলে। এবারে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভেও ঘটলো তেমন। দক্ষিণ আফ্রিকার পতনে বাবর সাম্রাজ্যের উত্থান। নিশ্চিত বাড়ি ফেরার পথ থেকেই যেনো সেমিফাইনালের পথে ছুটলো পাকিস্তান। মিরাকল বুঝি একেই বলে।
বাবর আজমরা চাতকের মতো চেয়েছিলেন বারিধারার আশায়, ডাচরা তাদের মেঘ দিয়ে গেল। যে মেঘে সহসাই বৃষ্টি ঘনায়। আর বৃষ্টি নামানোর বাকি কাজটা করলো বাংলাদেশ। পাকিস্তানের পিয়াস মিটলো সেই জলের শীতলতায়।
আর একেবারে বাদ পড়তে বসা পাকিস্তানের এই গল্পটাই, আরও একটা গল্প মনে করায়। মনে করায় সেই গল্পের নায়কের কথাও। যিনিও করেছিলেন অসাধ্য সাধন। ছন্দ গেঁথে দিয়েছিলেন এক অন্তমিলহীন কবিতায়। সেই রূপকথা রচিত হয়েছিল ১৯৯২ সালে, ত্রিশ বছর আগে। সেই নাটকের মঞ্চও ছিল অস্ট্রেলিয়া, মেলবোর্ন।
তারিখটা ছিল ২৫ মার্চ। ২৪৯ রানের টার্গেট, পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। সেই ম্যাচে ওয়াসিম আকরাম আর মোস্তাক আহমেদদের বোলিং তোপ সামলাতে পারেনি ইংলিশরা। ২২৭ রানে গুটিয়ে যায় গ্রাহাম গুচের দল। আকরাম ম্যাচসেরা, কাপ্তান ইমরান খানের হাতে ট্রফি। তিনিও সেই ম্যাচে করেছিলেন দলে পক্ষে সর্বোচ্চ ৭২ রান।
বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের গল্পে মনে হচ্ছে ১৯৯২ সালে বেশ দাপটেই ফাইনালে গিয়েছিল পাকিস্তান! মোটেও না! ইমরান খানের সেই পাকিস্তান গ্রুপ পর্বের বেড়া ডিঙাতে পারবে কিনা সে নিয়েই সবাই ছিল সন্দিহান। ফেবারিট তকমা তো দূরের কথা, ওই বিশ্বকাপে পাকিস্তান সেমিতে যাবে সেটাও কল্পনা করেনি কেউ। বিশেষ করে ভারতের কাছে হারের পর সমালোচনার তীর ছোটে ইমরান খানের দিকে।
ম্যাজিক ঘটিয়েছিলেন ইমরান খান। ভাঙা দলকে জোড়া লাগিয়ে, সামনে থেকে সাহস যুগিয়ে; উপদলে বিভক্ত দলটাকে এক সুতোয় বেঁধে তিনি সেবার পাকিস্তানকে সেমি, আর সেখান থেকে শিরোপা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন।
ইমরানের সেই নেতৃত্বের কথা বলতে গিয়ে তারই সতীর্থ আকিব জাভেদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘১৯৯২ বিশ্বকাপের কথা বলি। সত্যি বলছি, ইমরান ছাড়া আমরা আর কোনো খেলোয়াড়ই বিশ্বকাপ জেতার আশা করিনি। আমার এখনো চোখে ভাসে, পার্থে অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান ম্যাচের আগে ইমরান ড্রেসিংরুমে ঢুকছেন। আমরা সবাই তখন বিধ্বস্ত। অথচ ইমরান ভোজবাজির মতো আধা ঘণ্টার মধ্যেই সবাইকে বদলে দিলেন। সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করল, আজ আমরাই জিতব।’
সেবার ইমরান নাকি জাভেদদের বলেছিলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ানদের চাপে ফেলার একটাই উপায়, আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়া। যদি রক্ষণাত্মক মানসিকতা নিয়ে নামি, ওরা আমাদের গুঁড়িয়ে দেবে। মাঠে নেমে সবাই ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ো। দুই স্লিপ, এক গালি থাকবে; বাউন্সার, আউট সুইঙ্গার যার যা আছে সব দেখিয়ে দাও...আমার শুধু উইকেট চাই, রান-টানের কথা ভাবার দরকার নেই। বিশ্বকাপ জিতব, তোমাদের বিশ্বাস হচ্ছে না তো! একটু ভেবে দেখো, এই ম্যাচটা জিতলে এর পর শ্রীলঙ্কা, ওটা তো আমরা জিতবই। এরপর খেলা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, ওদের আমরা সব সময় বলে-কয়েই হারাই। এরপর সেমিফাইনাল-ফাইনাল।’
জাদুকরি ইমরান সেবার পেরেছিলেন। সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে, ফাইনালে ইংলিশ বধ। ইমরানের হাতে বিশ্বকাপ। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ২২তম বছরে এমন সাফল্য পেয়েছিলেন মিস্টার খান।
২০২২ সালে এসেও সেই ১৯২২ সালের মতো অবস্থায় পড়ল পাকিস্তান। সুপার টুয়েলভের প্রথম ম্যাচে ভারতের কাছে হার, ঘটনা সেখানে শেষ হলেও পারতো। তবে গল্পের মোড়টা আরও ঘুরিয়ে দিল জিম্বাবুয়ে। হুট করেই সিকান্দার রাজারা পাকিস্তানকে হারিয়ে দিল। টানা দুই হার নিয়ে পাকিস্তানের ভেঙে পড়ার দশা।
হয়তো তাদেরও মনে পড়লো সেই ৯২, সেই জাদুকরী ইমরান খান। স্মৃতির দেরাজ হাতরেই হয়তো বাবররা অনুপ্রেরণা নিলেন। নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে জয়ের ধারায় ফেরার পর, দক্ষিণ আফ্রিকাকেও দাপটের সাথে হারালো বাবর আজমরা। টানা দুই জয় আর দুই হার। ৪ পয়েন্ট নিয়েও সেমির আশা দূরাশা হয়েই থাকলো বাবরদের। কারণ প্রোটিয়ারা কমশক্তির ডাচদের হারালেই সেমিফাইনালে চলে যাবে। তাই বাংলাদেশকে হারিয়েও কোনো লাভ ছিল না বাবরদের।
তবে ডাচরা অঘটন ঘটিয়ে প্রোটিয়াদের হারিয়ে দেওয়ায় ৯২-এর পথটাই যেনো ধরলো পাকিস্তান। বাংলাদেশকে হারিয়ে সেমিতে চলে গেলো বাবরের দল। এ দফায় অসম্ভব সম্ভব হলো।
তবে কাকতালের সেখানেই শেষ নয়। এই বিশ্বকাপেও প্রথম সেমিফাইনাল ম্যাচে পাকিস্তানে প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। যেনো ৯২ ফিকশ্চারটাই কপি করেছে কেউ। ১৯৯২ ওয়ানডে বিশ্বকাপের মতো দ্বিতীয় সেমিফাইনালে আছে ইংল্যান্ড, যদিও এবার প্রোটিয়াদের জায়গায় ইংলিশদের প্রতিপক্ষ ভারত। এটুকুই কেবল ওলট-পালট।
তবে ধরুন এবার যদি বাবর নিউজিল্যান্ডকে হারায়, চলে যায় ফাইনালে। ওদিকে ভারতকে হারিয়ে ফাইনালে ইংলিশরা। সবমিলিয়ে তবে তো পাকিস্তানে ফিরছে ১৯৯২? বাবর হয়ে যাচ্ছেন ইমরান খান?
যদিও বাবরনামা ঠিক ইমরান রূপকথার সমান্তরালে হাটবে কিনা জানা নেই। কারণ ক্রিকেটে মাঠে খেলাই শেষ কথা। অনুমানে এখানে হয় না কিছুই। তবুও তো এবারের ফাইনালের ভেন্যু সেই মেলবোর্ন, হতেও তো পারে কাকতাল! বাবরে মাঝে ভর করতেও তো পারেন ইমরান, বিশ্বকাপটা জিততে পারে পাকিস্তান। হতে পারে বিপর্যস্ত এক সম্রাটের উত্থান...
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন