আজ মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এ মাসে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অবসান ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। অবিস্মরণীয় এই বিজয়ের মধ্যদিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। জাতীয় জীবনে সূচিত হয় নতুন অধ্যায়। লাখো শহীদের আত্মদান ও অগণিত মুক্তিকামী মানুষের অপরিসীম ত্যাগ মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই যুদ্ধ ও বিজয় জাতীয় অগ্রগতির অভিযাত্রায় অন্তহীন প্রেরণার উৎস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় অনাগতকাল অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাবে। ইতিহাসের নানা পর্যায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে, মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা স্বাধীনতা ও জাতীয় প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছি। এই স্বাধীনতা ও জাতীয় প্রতিষ্ঠা যাদের রক্ত ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে, আজকের দিনে সেই মুক্তি সংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও বিনম্র ভালোবাসায় স্মরণ করছি। তাদের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
মহান স্বাধীনতা ও বিজয়ের পর অনেক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। সঙ্গত বিবেচনাতেই আমরা কি পেয়েছি, কি পাইনি? তার সাদামাঠা হলেও একটা হিসাব করা দরকার। একথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, রাজনৈতিক স্বাধীনতার কিছু লক্ষ্য থাকে যা আমাদেরও ছিল। স্বশাসন, সুশাসন, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল এবং সে সংগ্রামে আমরা বিজয়ী হয়েছি। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ও জনসমর্থিত লক্ষ্যগুলো অর্জিত না হলে এ বিজয়কে সার্বিক অর্থে বিজয় বলে চিহ্নিত করা যায় না। সত্য বটে, পরাধীনতা ও পরশাসন থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেয়েছি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকেও আমরা মুক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু সে মুক্তি জাতীয় প্রত্যাশা পূরণ করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। এই ব্যর্থতার প্রেক্ষিতেই নতুন করে মুক্ত ও স্বাধীন হওয়ার লড়াইয়ে আমাদের অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে প্রত্যাশিত মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আজকের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, সেই ৭১-এর জাতীয় ঐক্য অনেকাংশেই এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির একটা রাজনৈতিক খেলা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এটা জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। কে না জানে, গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। অথচ আজ সেই গণতন্ত্র সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্রে জনগণই ক্ষমতার উৎস। অথচ আজ জনগণের সেই ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা হরণ করা হয়েছে। গণতন্ত্রে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র উপায় অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এখন সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। এখন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, নির্বাচিত হওয়ার জন্য ভোটের প্রয়োজন হয়না। আজকে সুশাসন, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রায় নির্বাসনে চলে যেতে বসেছে। রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, প্রশাসনে দলীয়করণ, দুর্নীতি, জবরদস্তি সীমা ছাড়িয়ে গেছে। নাগরিক নিরাপত্তা বলতে যা বুঝায় তাও উধাও হয়ে গেছে। বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অগ্রগতিÑ সব কিছুতেই নেমে এসেছে শ্লথতা।
স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ও লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে, উন্মুক্ত রাজনীতি, গণতন্ত্রের বিকাশ, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। এই সঙ্গে নাগরিক নিরাপত্তা, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ, শোষণ ও বৈষম্য হ্রাস এবং দুর্নীতি রোধ করাও অপরিহার্য। এখন বেশী উন্নয়ন ও কম গণতন্ত্রের একটা তত্ত্ব প্রচার করা হচ্ছে। এতে মনে হতে পারে, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন বুঝি পরস্পর বিরোধী আসনে মোটেই তা নয়। আমাদের গণতন্ত্র যেমন দরকার তেমনি দরকার উন্নয়নও। ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয়, গণতন্ত্রে উন্নয়ন দ্রুতায়িত হয়। সরকার বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে ও করছে। এসব প্রকল্প জাতীয় উন্নয়ন ও কল্যাণকে এগিয়ে দেবে, সন্দেহ নেই। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে গণতন্ত্র কোনো বাধা নয় বরং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও আইনের শাসন যদি প্রতিষ্ঠা লাভ করে তাহলে তা হবে উন্নয়ন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক। দেশে এখন যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বা রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা বিরাজ করছে সেটা সবার আগে দূর করা দরকার। এজন্য রাজনীতির চর্চা বাধামুক্ত করতে হবে, একটা গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কথা দেশী নয়, বিদেশী বিশেষজ্ঞরাও স্বীকার করেন, বাংলাদেশ এক অমিত সম্ভাবনার দেশ। সম্পদ, শক্তি উদ্যমে ভরা দেশটি দ্রুতই মধ্যম ও উন্নত দেশের তালিকায় স্থান লাভ করতে পারে, যদি সম্ভাবনাগুলো ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়। ভূতের পা নাকি পেছনে। আমরা পেছনে হাঁটতে চাই না। চাই সামনে এগিয়ে যেতে। জাতিকে সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রধান দায়িত্ব রাজনীতিকদের। আমরা আশা করতে চাই, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুভবুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দেবে। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার ও লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে। ক্ষুদ্র স্বার্থ, পরমুখাপেক্ষিতা, নতজানুতা অবশ্যই আমাদের পরিহার করতে হবে। পরিশেষে মহান বিজয় দিবসে আমরা সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন