কুল মাখলুকাতের তুলনায় মানুষ আল্লাহপাকের এক অনুপম সৃষ্টি। আল্লাহপাকের দয়া, করুণা ও অনুগ্রহের জোয়ার ধারা তার চারদিকে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। চলমান দুনিয়ায় ধন-দৌলত, মান-মর্যাদা, সম্মান প্রতিপত্তি যা কিছু তার প্রয়োজন, তার সবই সে লাভ করেছে। এ অপূর্ব দৃশ্য দেখে মানুষ কৃতজ্ঞ হবার পরিবর্তে বরং বিদ্রোহের পথ অবলম্বন করেছে বেশি মাত্রায় এবং সীমালঙ্ঘন করে চলেছে অহরহ। কাজে-কর্মে, চিন্তা-চেতনায়, শক্তি-সামর্থের ব্যবহারে মোটেই সংযতভাব প্রদর্শন করছে না। জাগতিক গবেষণা, উপায় ও উদ্ভাবনের তোড়জোড় তাকে দূর্বিনীত করে তুলেছে। নমরুদ ও ফেরাউনের মতো বেপরোয়াভাব প্রদর্শনে পিছপা হচ্ছে না। এতদ¦প্রসঙ্গে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন : বাস্তবেই মানুষ সীমালঙ্ঘনই করে থাকে। (সূরা আলাক : ৬)।
তবে, স্বভাবতই মনের কোণে এ প্রশ্নের উদয় হয় যে, কেন মানুষ সীমালঙ্ঘনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে? কেন এদিকের টান তাকে অধিক আকর্ষিত করে? এর উত্তর মহান আল্লাহপাক নিজেই প্রদান করেছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : কারণ সে নিজেকে অমুখাপেক্ষী মনে করে। (সূরা আলাক : ৭)। যেমনটি অভিশপ্ত আবু জাহেল মনে করেছিল। একবার সে কাবা চত্বরে দাঁড়িয়ে বলেছিলÑ যদি মুহাম্মাদকে কিবলার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করতে দেখি, তাহলে তাঁকে আমি অবশ্যই হত্যা করব।
তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাত আদায় করতে কাবা গৃহে আসলে আবু জাহেল তাঁকে বলল, তোমাকে কি আমি সালাত আদায় করতে নিষেধ করিনি? তোমাকে কি আমি এটা থেকে নিষেধ করিনি? রাসূলুল্লাহ (সা.) তার কাছে ফিরে আসলেন এবং আবু জাহেলের সঙ্গে তাঁর কথাকাটি ও বিতন্ডা হলো। এক পর্যায়ে আবু জাহেল বলে উঠল, আমার চেয়ে বড় সভাসদ কি কেউ আছে? দারুণ নোদওয়ার সভাসদদের ওপর আমার একচ্ছত্র আধিপত্য কি নেই? তখন আল্লাহপাক ও আয়াত নাজিল করলেন যে, ‘সে যেন তাঁর সভাসদদেরকে ডাকে আমরাও অচিরেই যাবানিয়াদেরকে ডাকব।’
এখানে যাবানিয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে জাহান্নামের প্রহরী কঠোর প্রকৃতির ফিরিশতাগণ। তাফসিরবিদ কাতাদাহ (রহ.) বলেন : আরবি ভাষায় যাবানিয়া শব্দের অর্থ হলো প্রহরী পুলিশ। এ ব্যাখ্যা অনুসারে বলা যায় যে, যাবানিয়াহ শব্দটি আরবি ভাষায় বিশেষ বাহিনীর প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর যাবান শব্দের আসল অর্থ হচ্ছেÑ ধাক্কা দেয়া, প্রচণ্ড শক্তিতে পাকরাও করা। সে হিসেবে যাবানিয়া-এর অন্য অর্থ হলো প্রচণ্ডভাবে পাকরাওকারী, প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়ে নিক্ষেপকারী। এতদ্বপ্রসঙ্গে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ! যদি আবু জাহেল তার সভাসদদেরকে ডাকত, তবে অবশ্যই তাকে আল্লাহপাকের যাবানিয়া পাকরাও করত। (সহীহ বুখারী : ৪৯৫৮)।
কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, আবু জাহেল বলেছিল-মুহাম্মাদ কি তোমাদের সামনে মাটিতে মুখ ঘষে? তাকে বলা হল যে, হ্যাঁ। তখন সে বলল, লাত ও উযযার শপথ! যদি আমি তাঁকে তা করতে দেখি, তবে অবশ্যই আমি তার ঘাড় পা দিয়ে দাবিয়ে দেব। অথবা তার মুখ মাটিতে মিশিয়ে দেব। অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আসল। তিনি তখন সালাত আদায় করছিলেন। সে তাঁর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
তার ধারণা অনুসারে সে তাঁর মাথা গুঁড়িয়ে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু কাছে যাওয়ার পর ভীত পদে পেছনের দিকে ফিরে আসতে বাধ্য হল এবং হাত উঁচিয়ে কাকে যেন বাধা দিচ্ছিল। তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে সে বলল, আমার ও মুহাম্মাদের মধ্যে আগুনের একটি খন্দক দেখতে পেলাম এবং ভয়ঙ্কর আকৃতির ও ডানা বিশিষ্টদের দেখতে পেয়েছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : যদি সে নিকটবর্তী হতো, তাহলে ফিরিশতাগণ তাকে টুকরা টুকরা করে ছিড়ে ফেলত। তখন আল্লাহপাক এই আয়াত নাযিল করলেন, বাস্তবেই মানুষ সীমালঙ্ঘন করে থাকে, কারণ সে নিজেকে অমুখাপেক্ষী মনে করে। (সহীহ মুসলিম : ২৭৯৭)।
উল্লিখিত আয়াতে কারীমায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী আবু জাহেলকে লক্ষ্য করে বক্তব্য রাখা হলেও ব্যাপক অর্থবোধক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের একটি নৈতিক দুর্বলতা বিধৃত হয়েছে। মানুষ যতদিন নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অমুখাপেক্ষী মনে না করে, ততদিন সে সীমালঙ্ঘন করেনা। কিন্তু যখন সে মনে করতে থাকে যে, সে কারো মুখাপেক্ষী নয়, তখন তার মধ্যে অবাধ্যতা এবং সীমালঙ্ঘন প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন