শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ফুটবলকে পূর্ণতা দিয়েছে ব্রাজিল

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০১ এএম



২০ নভেম্বর কাতারে শুরু হতে যাচ্ছে ফুটবলের মহাযুদ্ধ, ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের ২২তম আসরের চূড়ান্ত পর্ব। এখানে ফিফার অন্তর্ভুক্ত ৩২টি জাতীয় ফুটবল দল প্রতিযোগিতা করবে। এটি ৩২ দলের অংশগ্রহণে আয়োজিত ফিফা বিশ্বকাপের সর্বশেষ আসর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো এবং কানাডায় অনুষ্ঠিত ২০২৬ সালের আসর হতে ৪৮ দলের সমন্বয়ে ফিফা বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ম্যাচে আল বাইত স্টেডিয়ামে কাতার এবং ইকুয়েডর মুখোমুখি হবে।

১৮ ডিসেম্বর তারিখে কাতার জাতীয় দিবসে ফাইনাল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বেশকিছু কারণে এবারের আসর বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। পর্তুগিজ কিংবদন্তি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ও আর্জেন্টাইন জাদুকর লিওনেল মেসির এটাই হতে পারে শেষ বিশ্বকাপ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আরেকটি প্রশ্ন বিশ্বব্যপী ফুটবলপ্রেমীদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আর সেটি হল সর্বোচ্চ পাঁচবার বিশ্বকাপ জয় করা ব্রাজিল কি পারবে তার স্বপ্ন পূরণ করতে?

সেলেকাও নামে পরিচিত ব্রাজিল দলের প্রধান কার্যালয় ব্রাজিলের রিউ ডি জেনেরিওর আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী বরা দা তিজুকা এলাকায় অবস্থিত। বর্তমানে এই দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন তিতে এবং অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করবেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ডিফেন্ডার থিয়াগো সিলভা। ব্রাজিল ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল দল, যারা এ পর্যন্ত ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৯৪ এবং ২০০২ সালে ৫ বার বিশ্বকাপ জয়লাভ করেছে। ব্রাজিল ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র দল হিসেবে সবগুলো আসরে অংশগ্রহণ করেছে। এছাড়া কোপা আমেরিকায়ও ব্রাজিল অন্যতম সফল দল, যেখানে তারা ৯টি (১৯১৯, ১৯২২, ১৯৪৯, ১৯৮৯, ১৯৯৭, ১৯৯৯, ২০০৪, ২০০৭ এবং ২০১৯) শিরোপা জয়লাভ করেছে। ব্রাজিল ১৯৯৭, ২০০৫, ২০০৯ এবং ২০১৩ সালে ৪ বার ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ জয়লাভ করেছে, যা উক্ত প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ। পেলে, কাফু, রোনালদো, রোনালদিনহো, কাকা এবং রবার্তো কার্লোসের মতো খেলোয়াড়গণ ব্রাজিলের জার্সি গায়ে মাঠ কাঁপিয়েছেন। ফুটবলের ব্যাপারে একটি সাধারণ উক্তি রয়েছে, যা হচ্ছে: The English invented it, the Brazilians perfected it. অর্থাৎ, ফুটবল ইংল্যান্ড আবিষ্কার করেছে, তবে ব্রাজিল তা পরিপূর্ণতা দান করেছে।

সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৫৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপে ব্রাজিল দল পূর্ণাঙ্গভাবে আত্মপ্রকাশ করে। পূর্ববর্তী আসরে মারাকানায় পরাজিত হওয়ার বেদনা ভুলে নিলতন সান্তোস, দালমা সান্তোস, দিদির ন্যায় একগুচ্ছ প্রতিভাবান ফুটবলারদের নিয়ে উক্ত আসরে অংশগ্রহণ করে ব্রাজিল। কিন্তু, দলটি খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। কোয়ার্টার-ফাইনালে শক্তিশালী হাঙ্গেরির কাছে ৪-২ গোলের ব্যবধানে পরাজিত হয়ে তারা উক্ত আসর হতে বিদায় নেয়।

১৯৫৮ সালে সুইডেনে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপে ব্রাজিলের কোচ ভিসেন্তে ফিওলা দলে কিছু কঠোর নিয়ম আরোপ করেন। খেলোয়াড়দের চল্লিশটি কাজ না করার আদেশ একটি তালিকা আকারে প্রদান করা হয়। এসব নিয়মের মধ্যে ছিল মাথায় হ্যাট পরিধান বা ছাতা ব্যবহার করা যাবে না, জার্সি পরিহিত অবস্থায় ধূমপান করা যাবে না, দল বহির্ভূত পত্রিকা অথবা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা যাবে না ইত্যাদি। সেসময় ব্রাজিল ফুটবল দলই ছিল একমাত্র দল, যাদের নিজস্ব একজন মনোবিজ্ঞানী ও দন্তচিকিৎসক ছিলো। কারণ, অনেক খেলোয়াড়ই দাঁতের সমস্যায় ভুগতেন। দাঁতের সংক্রমণের কারণে তাদের মাঠের নৈপূণ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলত। সেসময় বাছাইপর্বের খেলাগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য ব্রাজিল দলের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধিকে ইউরোপে পাঠানো হয়েছিল।

১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিল সুইডেনকে ৫-২ গোলে পরাজিত করে তার প্রথম বিশ্বকাপ জেতে এবং প্রথম দেশ হিসেবে তার নিজের মহাদেশের বাইরে বিশ্বকাপ শিরোপা জেতে। ১৯৬২ ফিফা বিশ্বকাপে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল তারকা খেলোয়াড় গারিঞ্চাসহ গঠিত দল নিয়ে দ্বিতীয় শিরোপা অর্জন করে। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে ব্রাজিল বিশ্বকাপে তাদের সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স করে এবং ১৯৩৪ সালের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়ে। ১৯৭০ ফিফা বিশ্বকাপে ব্রাজিল দল, যাকে অনেক বিশিষ্ট ধারাভাষ্যকার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবল দল হিসেবে বিবেচনা করেন, মেক্সিকোতে তৃতীয় বিশ্বকাপ জেতে। দলটি তখন থেকে প্রায়ই সেরা বিশ্বকাপ ফুটবল স্কোয়াড হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।

অনেকের কাছে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, ব্রাজিল দল আন্তর্জাতিক ফুটবলে ১৯৭০ সালের পর দীর্ঘ ২৪টি বছর বিশ্বকাপ জয় করতে পারেনি, এমন কী ফাইনালেও উঠতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে তারা সেই খরা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। সে সময় বিশ্বের সেরা আক্রমণভাগের খেলোয়াড়গণ ব্রাজিলের আক্রমণভাগে খেলতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন রোমারিও, বেবেতো, দুঙ্গা, তাফারেল, এবং জোরগিনহো। ১৯৯৪ সালেই ব্রাজিল রেকর্ড চতুর্থবারের মতো ফিফা বিশ্বকাপ জয়লাভ করে। এই আসরে ব্রাজিল শুরু থেকেই অত্যন্ত সাফল্যের সাথে খেলতে থাকে। গ্রæপ পর্ব থেকে উত্তোরণের পর ১৬ দলের পর্ব থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ১০ গোলের ব্যবধানে জয়লাভ করে তারা কোয়ার্টার ফাইনালের ওঠে। সেখানে নেদারল্যান্ডের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ এক খেলায় ৩-২ গোলে জয়লাভ করে সেমিফাইনালের জন্য উত্তীর্ণ হয়। এই খেলাটি ঐ টুর্নামেন্টের সেরা খেলা হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া সুইডেনকে তারা সেমিফাইনালে ১০ গোলে পরাজিত করে। অতঃপর ফাইনালে একটি চিরচেনা প্রতিদ্ব›িদ্বতার সৃষ্টি হয়, ব্রাজিল বনাম ইতালি। খেলাটি ০-০ গোলে ড্র হওয়ায় ট্রাইবেকারের মাধ্যমে ফলাফল নির্ধারিত হয়। শেষ মুহূর্তে ইতালির আক্রমণভাগের খেলোয়াড় রবের্তো বাজ্জোর শট ক্রসবারের ওপর দিয়ে চলে গেলে, ব্রাজিল চতুর্থবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই সাথে পুনরায় ফিরে আসে বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিলের আধিপত্যের যুগ।

ব্রাজিল ১৯৯৮ ফিফা বিশ্বকাপে রানার-আপ হয়। সেমিফাইনালে ব্রাজিল নেদারল্যান্ডের সাথে ড্র করে। এই ম্যাচে রোনালদো এবং প্যাট্রিক ক্লুভার্ট প্রত্যেকেই নিজ নিজ দলের পক্ষে একটি করে গোল করে। ফাইনালে ব্রাজিল ফ্রান্সের কাছে ৩-০ গোলে পরাজিত হয়। এই ম্যাচে ব্রাজিলের রক্ষণভাগ খুবই দুর্বল ছিল। উক্ত ম্যাচে জিনেদিন জিদান কর্নার কিক থেকে হেডের মাধ্যমে দুই গোল করেন। ফাইনাল ম্যাচের কিছু পূর্বেই রোনালদো স্নায়ুরোগে ভুগছিলেন। উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে না পারায় অনেকেই রোনালদোকে প্রথম লাইন-আপে রাখার ব্যাপারে সমালোচনা করেছিলেন।

বাছাইপর্বের মাত্র পাঁচটি খেলা হাতে রেখে ঐসময় বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন নিয়ে ব্রাজিল বিরাট সংশয়ে ছিল। ২০০১ সালে লুইজ ফেলিপে স্কলারি কোচের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর প্রথম ম্যাচেই ব্রাজিল উরুগুয়ের কাছে ১০ গোলের ব্যবধানে পরাজিত হওয়ার পর এই সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়। শেষ পর্যন্ত ব্রাজিল মূলপর্বে উত্তীর্ণ হতে সমর্থ হয়। বিশ্বকাপ শুরুর আগে ব্রাজিলকে তুলনামূলকভাবে দুর্বল দল হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছিল। কিন্তু একে একে তুরস্ক, চীন, কোস্টারিকা, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড এবং সেমি-ফাইনালে পুনরায় তুরস্কের বিরুদ্ধে জয় ব্রাজিলকে ফাইনালে পৌঁছে দেয়। ফাইনালে রোনালদোর জোড়া গোলের বিনিময়ে ব্রাজিল জার্মানিকে পরাজিত করে পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপো নিজেদের করে নেয়।

২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ফিফা কনফেডারেশন্স কাপে ব্রাজিল শিরোপা জয় করে। এই টুর্নামেন্টে ব্রাজিলের শুরুটা খুব একটা স্বাচ্ছন্দপূর্ণ ছিল না। প্রথম খেলায় তারা মিশরের সাথে হারতে হারতে ৪-৩ গোলে জয়লাভ করে। খেলার শেষ মিনিটে এসে মিশরের বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে একটি গোল করার মাধ্যমে ব্রাজিলের এই জয় আসে। ব্রাজিলের বিপক্ষে আফ্রিকার কোনো ফুটবল দলের এক ম্যাচে তিন গোল করার ঘটনা সেটিই প্রথম ছিল। পরবর্তীতে অবশ্য দলটি খুব ভালোভাবে ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করে। উভয়কেই ব্রাজিল ৩-০ গোলে পরাজিত করে। এছাড়া ব্রাজিল সেমিফাইনালে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকাকে পরাজিত করার পর, ফাইনালে তারা পুনারায় যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হয। উত্তেজনাপূর্ণ এই ফাইনালের প্রথমার্ধে ব্রাজিল ২-০ গোলে পিছিয়ে থাকলেও, দ্বিতীয়ার্ধে তারা পুরোপুরিভাবে খেলায় ফিরে আসে ও দুইটি গোলই পরিশোধ করে। পরবর্তীতে খেলা শেষের ছয় মিনিট আগে লুসিওর শিরোপাজয়ী গোলের সুবাদে ব্রাজিল ৩-২ গোলে তাদের তৃতীয় ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ জয়লাভ করে। এই আসরের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন ব্রাজিলের কাকা এবং সবচেয়ে বেশি গোল করেন লুইস ফ্যাবিয়ানো। তিনি ৫ ম্যাচে মোট ৫টি গোল করেন।

ফিফা বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে, ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত র‌্যাঙ্কিংয়ে ব্রাজিল তাদের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সর্বোচ্চ অবস্থান (প্রথম) অর্জন করে এবং ২০১৩ সালের জুন মাসে প্রকাশিত র‌্যাঙ্কিংয়ে তারা ২২তম স্থান অধিকার করে, যা তাদের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। অন্যদিকে, বিশ্ব ফুটবল রেটিংয়ে ব্রাজিলের সর্বোচ্চ অবস্থান হচ্ছে প্রথম, যা তারা সর্বপ্রথম ১৯৫৮ সালে অর্জন করেছিল এবং সর্বনিম্ন অবস্থান হচ্ছে ২০। বর্তমানেও ফিফা বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে ব্রাজিল প্রথম স্থানে আছে।

লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন