রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজ উপলক্ষে তখন মক্কা মুকাররমায় অবস্থান করছিলেন। একদিন তিনি অসুস্থ সাহাবী সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.) কে দেখতে গেলেন। হযরত সা‘দ (রা.) এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, যার ফলে তিনি মৃত্যুর আশঙ্কা করছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচুর সম্পদের অধিকারী। তার মৃত্যুর পর ওয়ারিস হওয়ার মতো ছিল তার একমাত্র কন্যা। রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন তাকে দেখতে গেলেন, তিনি তাকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার যে কী কষ্ট হচ্ছে, তা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন। মনে হচ্ছে আর বাঁচব না। আমার প্রচুর সম্পদ রয়েছে।
অথচ আমার একমাত্র মেয়ে ছাড়া আমার ওয়ারিস হওয়ার আর কেউ নেই। এমতাবস্থায়, আমি কি আমার সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ সদকা করতে পারি? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, না। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, তবে আমি অর্ধেক দান করে দিই? রাসূলুল্লাহ (সা.) এবারও বললেন, না। এবারে তিনি জানতে চাইলেন, তবে এক-তৃতীয়াংশ? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এক-তৃতীয়াংশই তো অনেক। এরপর বললেন, সন্দেহ নেই, তোমার ওয়ারিসদের তুমি যদি এমন অভাবীরূপে রেখে যাও, যার ফলে তারা মানুষের কাছে হাত পাতবে, এ অবস্থার তুলনায় তাদের তুমি স্বচ্ছলরূপে রেখে যাওয়া অনেক ভালো। আর আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় তুমি যা কিছুই ব্যয় করবে, তোমাকে এর প্রতিফল দেয়া হবে, এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যে লোকমাটি তুলে দাও সেজন্যেও তুমি পুরস্কার পাবে। (সহীহ বুখারী : ৪৪০৯)।
এ হাদীসে আমরা দেখতে পাই : এক. দান-সদকার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ আমলেও ভারসাম্য রক্ষা করতে বলছেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)! পবিত্র কোরআন ও হাদীসের কত জায়গায় কতভাবে এ দান-সদকার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে! অথচ সাহাবী সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.) যখন তার সম্পদের অধিকাংশ তিন ভাগের দুই ভাগ সদকা করে দিতে চাইলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাতে অনুমতি দিলেন না। প্রত্যাখ্যাত হলো অর্ধেক সম্পদ দান করে দেয়ার প্রস্তাবও।
অবশেষে এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ দান করার অনুমতি দিলেন আর বলে দিলেন, ততটুকুই অনেক! হযরত সাদ (রা.)-এর পেছনে নিজের মেয়েকে ঠকানোর মতো কোনো মন্দ উদ্দেশ্য ছিল না, তা বলাবাহুল্য। মন্দ উদ্দেশ্য থাকলে তিনি বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সামনে উপস্থাপন করতেন না। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, দুই-তৃতীয়াংশ সম্পদ দান করার পরও যা থাকবে, এক মেয়ের জন্যে অতটুকুই অনেক। বোঝা যাচ্ছে, একটি আমল আল্লাহ তা’আলার নিকট মাকবুল ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য কেবল নিয়তের শুদ্ধতাই যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট নয় বিশুদ্ধ নিয়তের পাশাপাশি আমলটি নেক ও সুন্দর হওয়া ।
এজন্যে বরং জরুরি বিশুদ্ধ নিয়ত ও সুন্দর আমলের পাশাপাশি আমলের পদ্ধতিটিও সুন্দর হওয়া; সুন্নাহসম্মত ও শরীয়তের নির্দেশিত পন্থায় হওয়া। এ তিনের মিশেলেই আমলটি আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে। প্রিয় সাহাবী অসুস্থতার তীব্রতায় যখন মৃত্যুর আশঙ্কা করছিলেন, সে মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ (সা.) এভাবেই তাকে একটি ভালো আমলের সুন্দর পদ্ধতি নির্দেশ করেছিলেন। তিনি তাকে বলেছিলেন, দান করতে চাইলে করো, তবে তা তোমার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি নয়। ইসলামী শরীয়তে মৃত্যুকালে সম্পদ দান করা কিংবা মৃত্যুপরবর্তী সময়ের জন্যে ওসিয়ত করার ক্ষেত্রে এটাই স্বীকৃত পন্থা, ওসিয়ত বা দান করতে হবে রেখে যাওয়া সম্পদের অনধিক এক-তৃতীয়াংশ। বাকিটুকু রেখে যেতে হবে ওয়ারিসদের জন্য।
দুই. নিয়ত যখন বিশুদ্ধ হয়, বাহ্যত মামুলি বিষয়ও হয়ে ওঠে অনেক মূল্যবান। হাদীসে দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে স্ত্রীর মুখে খাবারের লোকমা তুলে দেয়ার কথা। এক বিবেচনায় এটা এমন আর কী কাজ! আবার স্ত্রীর খাবারের ব্যবস্থা করা, তার পোশাক ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, এসব তো স্বামীর স্বাভাবিক দায়িত্বের অংশ। স্বামী যখন নিজের কাঁধে অর্পিত সে দায়িত্বটুকু পালন করছে আর ভাবছে এর মধ্য দিয়ে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জনের কথা, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ভাষ্যমতে, তার এ কাজটুকুও পুরস্কারযোগ্য!
নিয়তের বিশুদ্ধতায় বাহ্যত একটি তুচ্ছ কাজ যেমন- ফজিলতে-মর্যাদায় মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে, তেমনি দৃশ্যত অনেক মূল্যবান কাজও নিয়তের অশুদ্ধতায় হয়ে পড়তে পারে মূল্যহীন। এর দৃষ্টান্তও বর্ণিত হয়েছে হাদিস শরিফে। হাদিসটি বিখ্যাত এবং বহুল চর্চিত।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সকল আমল নিয়ত অনুসারেই মূল্যায়িত হয়। আর প্রত্যেকে তাই পাবে, যা সে নিয়ত করেছে। ফলে যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে (অর্থাৎ তাঁদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে) হিজরত করে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হয়েছে বলেই বিবেচিত হবে। আর যে হিজরত করে, পার্থিব কোনো বিষয় হাসিল করার জন্য, কিংবা কোনো নারীকে বিয়ে করার লক্ষ্যে, তার হিজরতের মধ্য দিয়ে সে কেবল তার উদ্দিষ্ট বিষয়ই হাসিল করতে পারবে। (সহীহ মুসলিম : ১৯০৭)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন