আল্লাহ তা’আলার সকল নেয়ামতের মতো শান্তি ও নিরাপত্তার মূল্যও তখনই উপলব্ধি করা যায় যখন কিছু সময়ের জন্য জীবনের কিছু ক্ষেত্রে এই নেয়ামতের সঙ্কট দেখা দেয়। বিবাদ, বিসংবাদ ও হানাহানিতে যখন জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে তখন শান্তি ও নিরাপত্তার মূল্য বুঝে আসে। এই ভীতি ও অশান্তির সময়গুলো অন্তত দু’টো বিষয়ের দিকে আমাদের মনযোগ আকর্ষণ করে। এক. মুহাসাবা ও আত্মপর্যালোচনা। ভালো-মন্দ সকল অবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে মানুষের নিজের কর্ম। এ কারণে সর্বাবস্থায় মুহাসাবা ও আত্মপর্যালোচনা অতি গুরুত্বপূর্ণ। ইরশাদ হয়েছে, মানুষের কৃতকর্মের কারণে স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে, যার ফলে আল্লাহ তাদেরকে তাদের কিছু কিছু কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে। (সূরা রূম : ৪১)।
এ অশান্তির শাস্তি যেমনিভাবে ফাসাদ সৃষ্টিকারী ব্যক্তি ও সমাজ তাদের অপকর্মের জন্য ভোগ করে থাকে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে তার আগ্রাসনে পড়ে যায় জালিমদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া, তাদের প্রতিবাদ ও সাধ্যানুযায়ী প্রতিরোধ না করা সমাজ ও গোষ্ঠির লোকজনও। তাই নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করার পাশাপাশি অসত্য, অন্যায়, প্রকাশ্য গুনাহ ও খোদাদ্রোহীতার বিরুদ্ধে যার যার সাধ্যানুযায়ী শান্তিপূর্ণ পন্থায় উদ্যোগ গ্রহণ করাও অপরিহার্য।
দুই. দুনিয়ার ছোট ছোট ভীতি ও শঙ্কা আখিরাতের চরম ভীতি ও শঙ্কার নিদর্শন। এগুলো আখিরাতের কঠিন মুহূর্তে শান্তি ও নিরাপত্তার মূল্য মুমিনের চিন্তায় উপস্থিত করে। কোরআন মজীদে বারবার কিয়ামত ও আখিরাতের সেই চরম ভীতির পরিস্থিতি সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। জাহান্নামীদের অবর্ণনীয় সন্ত্রস্ততার যে চিত্র আল্লাহ তা’আলা কোরআন মজীদে তুলে ধরেছেন তা মুমিনের অন্তরাত্মাকে প্রকম্পিত করে তোলে।
আরো ইরশাদ হয়েছে, তুমি কখনো মনে করো না যে, জালিমরা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ বে-খবর, তবে তিনি তাদেরকে সেই দিন পর্যন্ত অবকাশ দেন যেদিন তাদের চক্ষু হবে স্থির। ভীত-বিহŸল চিত্তে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা ছুটাছুটি করবে। নিজের প্রতি তাদের দৃষ্টি ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে উদাস। যেদিন তাদের শাস্তি আসবে, সেদিন সম্পর্কে তুমি মানুষকে সতর্ক কর, যখন জালিমরা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে কিছুকালের জন্য অবকাশ দাও আমরা তোমার ডাকে সাড়া দিব এবং রাসূলগণের অনুসরণ করব। তোমরা কি পূর্বে শপথ করে বলতে না যে, তোমাদের পতন নাই? অথচ তোমরা বাস করতে তাদের বাসভূমিতে, যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল এবং তাদের প্রতি আমি কী করেছিলাম তাও তোমাদের জানা ছিল এবং তোমাদের কাছে আমি তাদের দৃষ্টান্তও উপস্থিত করেছিলাম।
তারা ভীষণ চক্রান্ত করেছিল, কিন্তু তাদের চক্রান্ত আল্লাহ রহিত করেছেন, যদিও তাদের চক্রান্ত এমন ছিল, যাতে পর্বত টলে যেত। তুমি কখনো মনে করো না যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলগণের প্রতি প্রদত্ত প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, দন্ড-বিধায়ক। যেদিন এই পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হবে এবং আকাশমন্ডলি এবং মানুষ উপস্থিত হবে আল্লাহর সামনে যিনি এক, পরাক্রমশালী। সেইদিন তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে শৃঙ্খলিত অবস্থায়, তাদের জামা হবে আলকাতরার এবং আগুন আচ্ছন্ন করবে তাদের মুখমন্ডল। এটা এজন্য যে, আল্লাহ প্রত্যেকের কৃতকর্মের প্রতিফল দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রæত হিসাব করেন। এটা মানুষের জন্য এক বার্তা, যাতে এর দ্বারা সতর্ক হয় এবং জানতে পারে যে, তিনি একমাত্র ইলাহ এবং যাতে বোধশক্তিসম্পন্নরা উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা ইবরাহীম ৪২-৫২)।
ওই চরম ভীতির মুহূর্তে আল্লাহ রাববুল আলামীনের পক্ষ হতে অভয় ও নিরাপত্তাই হবে সবচেয়ে বড় নেয়ামত, যার মোকাবেলায় দুনিয়ার সকল ভোগ-উপভোগ অতি তুচ্ছ মনে হবে। এই পরম নেয়ামত আল্লাহ শুধু দান করবেন তাঁর মুত্তাকী বান্দাদেরকে, যারা দুনিয়াতে আল্লাহকে ভয় করেছেন, কিয়ামত ও আখিরাতের কঠিন অবস্থাকে ভয় করেছেন। মেহেরবান আল্লাহ তাদেরকে ওই জীবনের ভীতি থেকে নিরাপদ রাখবেন।
আমাদের এই ক্ষুদ্র জীবনের অনুষঙ্গগুলো ওই চিরস্থায়ী জীবনেরই কিছু নিদর্শন। এই সকল অনুষঙ্গ থেকে যদি আমরা ওই জীবন সম্পর্কে উপলব্ধি গ্রহণ করতে পারি এবং বিস্মৃতি ও উদাসীনতা থেকে মুক্ত হয়ে ওই কঠিন সময়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারি তাহলে সেটিই হবে বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা। আল্লাহ তা’আলা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বুল আলামীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন