ইখতিয়ার উদ্দিন সাগর : তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও গ্রহণ থেকে জনগণকে বিরত রাখার জন্য সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ ও তামাকবিরোধী অভিযানের পরও পণ্যভিত্তিক রাজস্বের ৪০ শতাংশেরও বেশি আসে তামাকজাত পণ্য থেকে। যা পণ্যভিত্তিক রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বেশি। শুধু খাতভিত্তিক নয়, একক ভাবেও নামীদামী প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীকে পেছনে ফেলে শীর্ষ করদাতার পুরস্কার পেয়েছেন তামাক পণ্য ব্যবসায়ী মো. কাউছ মিয়া। তবে এই খাত থেকে বড় ধরনের রাজস্ব আসলেও ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে মারা যায় প্রায় এক লক্ষ। রোগে ভুগছে আরও কয়েক লাখ। এ সব রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য খরচ তামাক খাত থেকে পাওয়া রাজস্বের অনেক বেশি।
এদিকে এনবিআর কর্তৃক এই খাত থেকে বড় আয় পেলেও তামাকজাত পণ্যের ক্ষতিকর দিক চিন্তা করে এ পণ্যে অতিরিক্ত করারোপ ধারা অব্যাহত রেখেছে। স্বাস্থ্য খাতে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে করণীয় বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ‘ডিউটি ফ্রি’ নিষিদ্ধ করতে হবে। তামাক কোম্পানিতে যারা কর্মরত আছেন, তাদের করপোরেট ট্যাক্স আরও ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। তামাকপণ্য রপ্তানির ওপর উচ্চ হারে রপ্তানি শুল্ক আরোপ করতে হবে।
সরকারের রাজস্ব আয়ের বিশাল অংশ তামাকজাত পণ্য সিগারেট, বিড়ি, গুল ও জর্দা থেকে আসছে। সর্বশেষ অর্থবছরেও পণ্যভিত্তিক রাজস্বের প্রায় ৪৩ শতাংশ এসেছে এ খাত থেকে। এনবিআরের তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে স্থানীয় পর্যায়ে পণ্য থেকে সরকারের মোট রাজস্ব এসেছে ৩৯ হাজার ২৫৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু সিগারেট থেকেই এসেছে ১৬ হাজার ৩২৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, পণ্যভিত্তিক মোট রাজস্ব আয়ের যা ৪১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। সরকারের নিরুৎসাহিত ও স্বাস্থ্যের জন্য আরো বেশি ক্ষতিকর বিড়ি থেকেও মোটা অংকের রাজস্ব আহরণ করছে সরকার।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে পণ্যভিত্তিক রাজস্বে তামাকজাত পণ্যের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। ওই অর্থবছর সিগারেট, বিড়ি ও জর্দা থেকে এনবিআর রাজস্ব পেয়েছিল ১৪ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সিগারেট থেকে আসে ১৪ হাজার ২৯১ কোটি, বিড়ি থেকে ৩২৯ কোটি ও জর্দা থেকে ৭১ কোটি টাকার রাজস্ব। অর্থবছরটিতে পণ্যভিত্তিক মোট রাজস্বের ৪৫ শতাংশের বেশি আসে সিগারেট থেকে।
তথ্য মতে, এদেশে ৪ কোটি ৬০ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সিগারেট, বিড়ি এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করে। এই হিসাবে দেশের প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের অর্ধেক তামাকজাত পণ্য গ্রহণ করে। বিশ্বে ৪৭ শতাংশ পুরুষ ও ১২ শতাংশ মহিলা ধূমপায়ী। কিন্তু বাংলাদেশে ৬০ শতাংশ পুরুষ ও ৪০ শতাংশ মহিলা ধূমপায়ী। বাংলাদেশে এই ধূমপায়ীর হার বেশি হওয়ার কারণ হিসাবে দেখা গেছে, গ্রামের বেশিরভাগ অশিক্ষিত মহিলা ও পুরুষ তামাক, সাদা পাতা, জর্দা, পান, খয়ের, চুন ইত্যাদি জীবননাশকারী দ্রব্যাদি নিয়মিত ব্যবহার করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের (আইএইচএমই) ২০১৩ সালে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে মারা যায় ৯৫ হাজার মানুষ। পঙ্গুত্ব বরণ করে আরও কয়েক লাখ। এসব ক্ষেত্রে রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য খরচ তামাক খাত থেকে পাওয়া রাজস্বের অনেক বেশি।
এদিকে তামাক ব্যবহারের ফলে দেশের অর্থনীতিতে বছরে নিট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকারও বেশি। প্রতিবছর সিগারেট ক্রয়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশ ও বিড়ি ক্রয়ে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ ব্যয় হয়। বর্তমানে এই ক্ষতির পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই ক্রমেই বাড়ছে।
হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার এবং ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফর ফ্রি কিডসের গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যমান মূল্যস্তরভিত্তিক কর কাঠামোর পরিবর্তে সব ধরনের সিগারেটের প্রতি ১০ শলাকার প্যাকেটের ওপর যদি ৩৪ টাকা হারে একক কর আরোপ করা হয় তাহলে বেশি মূল্য পড়বে। এর ফলে প্রায় ৭০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী সিগারেট সেবন ছেড়ে দেবেন। এছাড়া ৭০ লাখেরও অধিক সংখ্যক তরুণ ধূমপান সেবন ছেড়ে দেবেন। বিড়ির ক্ষেত্রে প্রতি ২৫ শলাকার প্যাকেটের খুচরা মূল্যের ওপর ১০ টাকা হারে কর আরোপ করা যায়, তাহলে প্রায় ৩৪ লাখ বিড়ি ছেড়ে দেবেন।
কয়েক বছর ধরেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তামাক পণ্যে করের হার আরও বাড়ানোর পাশাপাশি তামাকজাত পণ্য বিক্রির উপর সারচার্জ বর্তমানের দ্বিগুণ করার আহŸান জানাচ্ছে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো। সংগঠনগুলো তাদের সুপারিশের বলেছে, বর্তমানে তামাকজাত পণ্যের উপর স্বাস্থ্যখাতে (হেল্থ) সারচার্জ ১ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে উন্নীত করা দাবি করেছেন। এই সারচার্জ থেকে আহরিত রাজস্ব আয়ের ২৫ শতাংশ স্বাস্থ্য সুরক্ষা খাতে, ২০ শতাংশ তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত কর্মসূচি (গবেষণা ও প্রচারাভিযান) বাস্তবায়নে, ১৫ শতাংশ নিকোটিন আসক্তদের আসক্তি মুক্ত করার কর্মসূচি বাস্তবায়নে এবং ৪০ শতাংশ তামাক চাষে নিয়োজিত কৃষক এবং তামাকজাত পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃজনে ব্যয় করতে সুপারিশ করে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান অনেক আগে থেকেই জানিয়ে আসছেন, তামাকের ব্যবহার কমাতে প্রতি বছরই এ খাতে কর বাড়ানো হয়। তামাকবিরোধী আইন বাস্তবায়নে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া বিজ্ঞাপন সীমিত করে ও নানা নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে তামাকের ব্যবহার ভবিষ্যতে আরো কমিয়ে আনা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন