শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও জাতির প্রত্যাশা

| প্রকাশের সময় : ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. এম এ সবুর : বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়কে সর্বোচ্চ মেধা-জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠান বিবেচনা করা হয়। সাধারণত এসব প্রতিষ্ঠান থেকেই দেশ-জাতির নেতৃত্ব তৈরি হয়। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে একদিকে বাছাইকৃত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভর্তি করানো হয়, অন্যদিকে সর্বোচ্চ মেধাবীদেরকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত এক জরিপে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। এতে স্বজনপ্রীতি, প্রভাব-প্রতিপত্তিসহ বিভিন্ন দুর্নীতি, এমনকি টাকার বিনিময়েও অযোগ্যদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ করা হয়। ইতোপূর্বে বিভিন্ন সংবাদপত্র-গণমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি অস্ত্র প্রশিক্ষককেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টিও বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পায়। তবে এসব খবরের চেয়ে সম্প্রতি টিআইবি প্রকাশিত প্রতিবেদনটি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এ প্রতিবেদনে শিক্ষাবিদ, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবীসহ দেশের সচেতন সমাজে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গভীর উদ্বেগ লক্ষ করা যায়। বিতর্কিত শিক্ষানীতি, ত্রুটিপূর্ণ শিখন-পরীক্ষা পদ্ধতিসহ নানা কারণে শিক্ষার মানের যখন ক্রমাবনতি চলছে, তখন সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ জাতির হতাশাকে বাড়িয়ে দেয়।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধা-জ্ঞানচর্চার চেয়ে রাজনীতি চর্চার প্রভাব বেশি দেখা যায়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে শিক্ষা-গবেষণার পরিবর্তে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকা-ে ব্যস্ত থাকতে হয়। এজন্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী নয়, বরং এর সাথে সরকারকেও যুক্ত করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আইনত স্বায়ত্বশাসনের কথা বলা হলেও কার্যত সেখানে সরকারি হস্তক্ষেপ প্রাধান্য পায়। বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট-১৯৭৩ অনুযায়ী প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ভিসি নিয়োগ দেওয়ার বিধান থাকলেও সরকার নিজের রাজনৈতিক দলীয় শিক্ষককে ভিসি নিয়োগ দেয়। আর সরকারের নিয়োগকৃত ভিসি মহোদয় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ(!) হয়ে সরকারের আস্থাভাজন ব্যাক্তিদেরকেই গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করেন। এছাড়া তিনি প্রয়োজনতিরিক্ত শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসনের ভাবমর্যাদা হারিয়ে অনেকটা সরকারি আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু শিক্ষক নিয়োগে নয়, বরং শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রেও দুর্নীতি-টাকার বিনিময়ে ভর্তি জালিয়াতির খবর পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের মদদপুষ্ট ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা অর্থের বিনিময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস-জালিয়াতির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। এ কারণে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগরসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক অপরাধীকে শাস্তিও দেওয়া হয়। তবে তাদের অধিকাংশই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। অথচ জাতীয় রাজনীতি ও সঙ্কট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলন-অংশগ্রহণের ঐতিহ্য গৌরবময়। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অগ্রণী ভূমিকা লক্ষ করা যায়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির কারণে ছাত্ররাজনীতি ম্লান হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতির নেতৃত্ব তৈরির ঐতিহ্য থাকলেও শিক্ষক রাজনীতির কারণে ছাত্ররাজনীতি বিলীন হওয়ার পথে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ রাজনৈতিক দলের শাখার মতো বিভিন্ন গ্রুপে-দলে বিভক্ত হয়ে পড়ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লেজুরভিত্তিক রাজনীতির কারণেই প্রায় তিন দশক যাবৎ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়নি। বলতে দ্বিধা নেই, কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক শিক্ষক নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে সংঘাতের পথে ঠেলে দেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধা ও জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা-ঐতিহ্য হারিয়েছে এবং পড়ালেখার মারাত্মক অবনতি ঘটছে। এ কারণে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-প্রশাসন দেশের বিচ্ছিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। দেশের সার্বিক অবস্থাতেই তাদের বিচার করতে হয়। দেশের সর্বত্র যখন দুর্নীতির মচ্ছব চলে তখন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও দুর্নীতিমুক্ত থাকা সম্ভব নয়। অধিকন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকেও যথাযথ অধিকার-মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হয়। মর্যাদার জন্য তাদেরকে আন্দোলন করতে হয়। এমনকি রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের নিকট থেকেও তাদেরকে জ্ঞানের সবক নিতে হয়। এছাড়া আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য বরাদ্দের পরিমাণ যথার্থ নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখলেও আমাদের দেশে বরাদ্দের পরিমাণ অনেক কম। বিশ্বের সর্বোচ্চ শিক্ষা বিষয়ক সংগঠন ঊফঁপধঃরড়হ ভড়ৎ ধষষ (ঊঋঅ)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক দেশকে শিক্ষাখাতে নিজ দেশের জিডিপি’র কমপক্ষে ৬ শতাংশ অথবা জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দের সুপারিশ থাকলেও আমাদের দেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপি’র মাত্র ২.১ শতাংশ। এ কারণে জিডিপি’তে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের দিক দিয়ে বিশ্বের ১৬১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৫তম। এমনকি সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেও অবস্থান তলানির দিকে। অধিকন্তু গত কয়েক বছর ধরে বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে কমছে। যাতে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষেই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে দুর্নীতি-অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের ফলে একদিকে শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি ঘটছে অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দলীয় রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এহেন অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে সনাতন পদ্ধতির বিকল্প ভাবতে হবে। জাতীয় নেতৃত্ব গঠনের কারিগর হিসেবে খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে মেধাবী-যোগ্যদের বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই আপসহীন-নিরপেক্ষ হতে হবে। জাতির মেরুদ- শক্তিশালী করতে অবশ্যই দল-গোষ্ঠীয় সংকীর্ণতা পরিহার করতে হবে। আর দেশের সচেতন জনগণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের কাছে এ প্রত্যাশাই করে।
য় লেখক : আহ্বায়ক, ডক্টরস এসোসিয়েশন অব নন-গবর্নমেন্ট টিচার্স (ড্যাঙ্গট)
dmasobur09@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন