শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম

ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব-৩

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৪ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

একবার তিনজন সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীদের কাছে এসে তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তাদেরকে যখন তা জানানো হলো তারা অবাক হলেন। কারণ তার পরিমাণ তাদের ধারণা অপেক্ষা ঢের কম ছিল। তাদের ধারণা ছিল তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে দিবা-রাত্র নামাজ-রোজাতেই কাটান। কখনও রাতে ঘুমান না এবং কোনো দিন বিনা রোজায় কাটান না। পরক্ষণে তারা ভাবলেন, তাঁর তো এত বেশি ইবাদতের দরকার নেই। আল্লাহ তা’আলা তাকে নিষ্পাপ রেখেছেন, তাঁর কোনো গুনাহ নেই।

তাই খুব বেশি ইবাদত করার তাঁর দরকার নেই। অন্যরা তো তাঁর মত নয়। তাদের অনেক গুনাহ হয়ে যায়। তাই তাদেরই বেশি বেশি ইবাদত করতে হবে। সে মতে একজন বললেন, আমি রাতভর নামাজ পড়ব। কখনও ঘুমাব না। দ্বিতীয়জন বললেন, আমি জীবনভর প্রত্যেকদিন রোজা রাখব। তৃতীয়জন বললেন, আমি নারীসঙ্গ পরিহার করে চলব। কখনো বিবাহ করব না।

তাদের একথা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কানে গেল। তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা এই-এই কথা বলেছ? শোন, আমি কিন্তু আল্লাহকে তোমাদের অপেক্ষা বেশি জানি। তাই তোমাদের অপেক্ষা তাকে ভয়ও বেশি করি, অথচ আমি কোনো দিন রোজা রাখি এবং কোনো দিন রাখি না। আমি নামাজও পড়ি এবং ঘুমাইও আর আমি বিবাহও করেছি। (এটাই আমার সুন্নত ও নিয়ম)। যে ব্যক্তি আমার সুন্নত উপেক্ষা করে সে আমার দলের নয় (সহীহ বুখারী : ৫০৬৩)।

মধ্যপন্থা ও পরিমিতি রক্ষা সম্পর্কে এ হাদীসে এক সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও সীমালঙ্ঘন সম্পর্কে কঠোর সতর্কবাণী। ইবাদতে পরিমিতি সম্পর্কে এরকম আরো বহু হাদীস আছে। সবগুলোর একত্রীকরণ উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য শুধু ইবাদত-বন্দেগীতে শরীয়তের বিশেষ মেজাজ। তথা মধ্যপন্থা অবলম্বনের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করা। সে জন্য দু’ একটি হাদীসের উদ্ধৃতিই যথেষ্ট।
প্রকাশ থাকে যে, এই পরিমিতি রক্ষার জন্য কোনো ইবাদত কোনো পর্যায়ের সে সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। যাতে অজ্ঞতাজনিত কারণে কোনো ইবাদতকে তার আপন অবস্থান থেকে উপরে উঠানো বা নিচে নামানোর প্রান্তিকতা দেখা না দেয়।

ফরজ-ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাব সাধারণভাবে ইবাদত এই চার স্তরের। এর প্রত্যেকটিকে আপন আপন স্থানে রাখাই পরিমিতিবোধের দাবি এবং সেটাই শরীয়তের যথার্থ অনুসরণ। ফরজ-ওয়াজিবকে যেমন সুন্নত-মুস্তাহাবের স্তরে নামানো ঠিক নয়, তেমনি সুন্নত-মুস্তাহাবকেও ফরজ-ওয়াজিবের মর্যাদা দেয়া সঙ্গত নয়। এতে দীনের প্রকৃত কাঠামো যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি উম্মতের স¤প্রীতি নষ্টেরও পথ তৈরি হয়। যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ফরজিয়াতকে অস্বীকার করা হয়, রমজানের রোজা, মালের জাকাত ও বায়তুল্লাহর হজ্জকে ঐচ্ছিক সাব্যস্ত করা হয় তবে তাতে দীনে ইসলামের অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়ে।

কেউ তা করলে তার নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়ার সুযোগ থাকে না। বেশ আগে থেকেই এক শ্রেণির লোক এ জাতীয় চিন্তা পোষণের মাধ্যমে দীনের অবকাঠামোয় ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করেছে। তাতে শাশ্বত ও সুরক্ষিত দীন ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও তাদের নিজেদের ধামির্কতা যে বিধ্বস্ত হয়েছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। সেই সঙ্গে বৃহত্তর মুসলিম জাতিসত্তার এই ক্ষতি হয়েছে যে, এর ফলে বিভক্তিতে মাত্রাযোগ হয়েছে, নতুন ফেরকার গোড়াপত্তন হয়েছে।

একই রকমের কুফল রয়েছে-এর বিপরীত প্রান্তিকতার ভেতর। অর্থাৎ সুন্নত-মুস্তাহাবকে ফরজের মর্যাদা দিলে তাতেও দীনের অবকাঠামো বদলে যায়। হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রাহ.) দীনের ভেতর রদবদল ঘটার বিভিন্ন কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখেন, ‘আরেকটি কারণ হচ্ছে বাড়াবাড়ি। অর্থাৎ এমন কঠিন কঠিন ইবাদত অবলম্বন করা, শরীয়ত যার আদেশ করেনি, যেমন সারা বছর রোজা রাখা, রাতভর ইবাদত করা, সংসার জীবন পরিহার করা, বিবাহ না করা এবং সুন্নত-মুস্তাহাবকে ওয়াজিবের মতো গুরুত্ব দেয়া। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, ১/১২০)।
এ জাতীয় বাড়াবাড়ির ফলে বিভক্তিপ্রবণতাও উসকানি পায়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে যেসব আত্মকলহের ঘটনা ঘটেছে তার পেছনে এরকম বাড়াবাড়ির ভূমিকা নেহাত কম নয়। সন্দেহ নেই সুন্নত-মুস্তাহাবও দীনের একটা অংশ এবং ইসলামের পূর্ণাঙ্গরূপের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু সেই প্রাসঙ্গিকতা বজায় থাকবে তখনই যখন তাকে তার আপন অবস্থানে থাকতে দেয়া হবে। বাইরের আলো বাতাস দ্বারা গৃহাভ্যন্তরকে স্বচ্ছন্দ ও স্নিগ্ধময় করে রাখার পক্ষে জানালা ও গবাক্ষের ভ‚মিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু সে ভ‚মিকার মর্যাদা অক্ষুণœ রাখার স্বার্থে জানালা ও গবাক্ষকে যথাস্থানে যথারূপে রাখাই বাঞ্ছনীয়। নচেৎ তাকে যদি গৃহস্থদের চলাচলের পথ তথা দরজার আকার-প্রকারে নিয়ে আসা হয়, তাতে দুয়েরই মহিমা ক্ষুণœ হয়। উদ্দেশ্য ভেস্তে যায়। আলোচ্য ক্ষেত্রেও বিষয়টা সে রকমই। সুন্নত-মুস্তাহাবকে ফরজ-ওয়াজিবের মর্যাদা দিলে এভাবেই উভয়ের মহিমা ক্ষুণœ হয় এবং কার্যত উভয়টাই অস্তিত্ব-সঙ্কটের শিকার হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
Md Parves Hossain ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ৯:২৪ এএম says : 0
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ইসলামের প্রতিটি বিধান ও হুকুম পরিমিত ও সহজ, ন্যায়নিষ্ঠ ও ভারসাম্যপূর্ণ। মধ্যপন্থা ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য। বিশ্বাস, ইবাদত, লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, আইন-কানুন, ভাব ও অনুভূতি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষয়াবলি, বুদ্ধি, আবেগ, অন্তর ও আদর্শ সব কিছুতেই ইসলাম মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে।
Total Reply(0)
Rabbul Islam Khan ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ৯:২৪ এএম says : 0
কোরআনের বহু আয়াত থেকে মধ্যপন্থার ধারণা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে ‘তুমি তোমার নামাজে স্বর উঁচু কোরো না এবং তাতে মৃদুও কোরো না; বরং এর মাঝামাঝি পথ অবলম্বন কোরো।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ১১০)
Total Reply(0)
Md Ali Azgor ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ৯:২৪ এএম says : 0
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা আমলে মধ্যপন্থা অবলম্বন কোরো, বাড়াবাড়ি কোরো না। সকাল-সন্ধ্যায় (ইবাদতের জন্য) বের হয়ে পড়ো এবং রাতের কিছু অংশেও। তোমরা অবশ্যই পরিমিতি রক্ষা করো। তাহলে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪৬৩)
Total Reply(0)
Jahirul Islam ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ৯:২৫ এএম says : 0
সলাম একটি স্বভাবজাত সহজ-সরল ধর্ম। এতে কোনো কঠোরতা ও কাঠিন্য নেই। এর প্রতিটি বিধান ন্যায়নিষ্ঠ ও ভারসাম্যপূর্ণ।
Total Reply(0)
Md Parves Hossain ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ৯:২৫ এএম says : 0
ইসলাম কখনো তার অনুসারীকে আদেশ দেয় না শুধু ইবাদত-বন্দেগিতে জীবন কাটিয়ে দিতে। আখিরাতের চিন্তায় বিভোর হয়ে দুনিয়ার অংশকে ভুলে যেতে কোরআনে নিষেধ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন তাতে তুমি আখিরাতের নিবাস অনুসন্ধান করো। তবে তুমি দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তোমার প্রতি আল্লাহ যেরূপ অনুগ্রহ করেছেন তুমিও সেরূপ অনুগ্রহ করো। আর জমিনে ফাসাদ করতে চেয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ ফাসাদকারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আল কাসাস: ৭৭ )
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন