ইসলামপূর্ব আরব সমাজে সম্প্রীতি ও ভাতৃত্ব বলতে কোনো কিছু ছিল না। সেই সমাজে কত ভয়াবহ জাহিলিয়াত বিরাজ করছিল এবং সমাজব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর ছিল তা চিত্রায়িত হয়েছে হজরত জাফর ইবনে আবি তালেব (রা.)-এর সেই ঐতিহাসিক বক্তব্যে, যা তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠতার সাথে উপস্থাপন করেছিলেন তৎকালীন আবিসিনীয়ার বাদশা নাজাশীর রাজদরবারে। (দ্রষ্টব্য : সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৩৩৬)।
তখন সমাজে দুর্বলের উপর সবল চড়াও হত। অত্যাচার ও দুর্ব্যবহারের জয়জয়কার ছিল। সমাজ জর্জরিত ছিল অন্যায়, অবিচার, রক্তপাত, হানাহানি, সংঘাত ইত্যাদি নানাবিধ বিশৃঙ্খলায়। সীরাত ও ইতিহাসের একজন সাধারণ পাঠকেরও বিষয়গুলো অজানা নয়। এমন মুহূর্তে নবী কারীম (সা.) সমাজকে যেভাবে ঢেলে সাজিয়েছেন ইতিহাসে এমন নজির দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় না।
নবীজীর এই বিপ্লব কেবল আরবের নির্দিষ্ট কিছু ভ‚খÐের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর আভা বিকরিত হয়েছে গোটা বিশ^জুড়ে। তো নবী কারীম (সা.) যে তাদের বললেনÑ ‘তোমরা কি শতধা বিভক্ত ছিলে না, এরপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের মাঝে সৌহার্দ-স¤প্রীতি তৈরি করেছেন?’ জীবনের পরতে পরতে সাহাবায়ে কেরাম বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। নবী কারীম (সা.) সকল জাহিলিয়াত গোড়া থেকে নির্মূল করেন। বিদায় হজ্বের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, যেখানে নবীজি পরিষ্কার ঘোঘণা করেন : মনে রাখবে, জাহেলী সকল রীতিনীতি আমার পদতলে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। (সহীহ মুসলিম : ১২১৮)।
নবীজী আরো মনে করিয়ে দিয়ে বলেন : হে লোকসকল, স্মরণ রাখবে, তোমাদের প্রতিপালক এক। তোমাদের বাবাও এক। তিনি হযরত আদম আ.। অতএব মনে রাখবে, কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই কোনো অনারবের উপর। তেমনি নেই কোনো শ্রেষ্ঠত্ব কোনো অনারবের কোনো আরবের ওপর। কোনো লাল মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নেই কালো মানুষের উপর, তেমনি কালো মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নেই কোনো লাল মানুষের উপর। শ্রেষ্ঠত্বের মানদ- কেবলই তাকওয়া। (মুসনাদে আহমাদ : ২৩৪৮৯)।
এক রবের বান্দা হিসাবে এবং এক মা-বাবার সন্তান হওয়ার সুবাদে নবী কারীম (সা.) গোটা মানব জাতিকে এক কাতারে নিয়ে আসেন। এভাবে নবীজি সমাজ থেকে উৎখাত করেন শ্রেণি বৈষম্যের অভিশাপ। আরব আজম বলে অঞ্চলভিত্তিক সা¤প্রদায়িকতার অবসান ঘটান। লাল-কালোর বিভাজন তুলে দিয়ে মানব সমাজকে মুক্ত করেন বর্ণবাদ ও জাতীয়তাবাদের জিঞ্জির থেকে। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিটি মানব সন্তান এক সমান।
ভাষা বর্ণ অঞ্চল ভ‚খÐ ইত্যাদির বিচারে বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে জাহিলিয়াত। সমাজের ব্যবস্থাপনা সুরক্ষার সুবাদে কর্মবণ্টন অবশ্যই থাকবে। কিন্তু তাই বলে এর ভিত্তিতে বিভাজন সৃষ্টি করা, শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণয় করা এবং আরো আগে বেড়ে বৈষম্য তৈরি করা ইসলাম সমর্থন করে না। ইনসাফ ও অধিকার প্রাপ্তিতে কোনো ভেদাভেদ নেই। এখানে সকল বনী আদম এক সমান। শ্রেষ্ঠ তো সে ব্যক্তিই, যে আমল তথা কর্ম ও আচরণ ভালো ও সুন্দর করতে পারল, যে বেশি তাকওয়া হাছিল করতে পারল।
আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত চমৎকার ভঙ্গিমায় বিষয়টি বুঝিয়ে বলেছেন : হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার। প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান সেই, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছু সম্পর্কে সম্মক অবগত। (সূরা হুজুরাত : ১৩)।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেন : আল্লাহ তোমাদের চেহারা অবয়ব এবং ধন-সম্পদ দেখেন না। তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমল। (সহীহ মুসলিম : ২৫৬৪)। অর্থাৎ কে কত ধনী, কে কত ক্ষমতাবান, কে কোন্ বংশের সন্তান, কে কোন্ অঞ্চলের বাসিন্দা, কে কোন্ ভাষাভাষী ইত্যাদি এগুলো আল্লাহর কাছে বিবেচ্য নয়। আল্লাহতায়ালা তো কেবল বান্দার দিলের হালত এবং তার কর্মের মূল্যায়ন করবেন।
মোটকথা, ইসলাম এভাবে সকল ভেদাভেদ তুলে দিয়ে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে। আর শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নির্ধারণ করেছে দ্বীন, ঈমান, তাকওয়া ও খোদাভীতিকে। যা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই বিচার করবেন। বাবা মায়ের কাছে যেভাবে দুই পুত্র সমান। তেমনি এক বাবা আদম আ. ও এক মা হাওয়া আ. থেকে সৃষ্ট মানবকুল সমান মর্যাদার অধিকারী। ইসলাম গোটা মুসলিম উম্মাহকে এক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। পাশাপাশি এ ভ্রাতৃত্বের হক ও অধিকারগুলোও সুসংহত ও সুসাব্যস্ত করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন