অ্যান্টিবায়োটিক হচ্ছে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ। অথচ ভুল ব্যবহারে এই ওষুধ জীবন রক্ষার বদলে জীবনঘাতি হয়ে উঠছে। দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিব্যবহার ও অপপ্রয়োগ বাড়ছে। অনিয়ন্ত্রিত বিক্রি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকির দুর্বলতার সুযোগে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিমাত্রায় প্রয়োগ চলছে। বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিব্যবহার ও অপপ্রয়োগ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শিশুদের ওপর। বিশেষ করে নিবন্ধনহীন চিকিৎসকরা রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন বেশি। যদিও যথাযথ যোগ্যতাহীন চিকিৎসকদের কাছ থেকে আসা ব্যবস্থাপত্রের ৮৩ শতাংশেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ থাকে। আবার ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার-সংক্রান্ত যথাযথ পরামর্শ থাকলেও যথানিয়মে অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করে না ৪১ শতাংশ রোগী। তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ শিশু। এছাড়া অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক যথেচ্ছ প্রয়োগের প্রবণতাও রয়েছে অভিভাবকদের মধ্যে। তাতে করেই ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে আজকের শিশুদের। এতে সংক্রমণ ঘটানো জীবাণুগুলো হয়ে উঠছে শক্তিশালী। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের কারণে মানুষের শরীরে তা প্রতিরোধী হয়ে ওঠছে। অবশ্য শুধু অ্যান্টিবায়োটিক নয়, যেকোনো ওষুধের অতিমাত্রায় ও অপপ্রয়োগের ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে প্রয়োজন ছাড়াই বিভিন্ন ওষুধের প্রয়োগ হচ্ছে। প্রাত্যহিক জীবনে মানুষের মধ্যে ওষুধের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরির ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। যে কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ওষুধের দোকানে যাচ্ছে। এর সুযোগ নিচ্ছেন ক্ষুদ্র ও বড় অসাধু ব্যবসায়ীরা। অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের ফলে মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে ভালো ফলাফল পায় বলেই শুরুতে তা গ্রহণ করছে। কিন্তু এর অপপ্রয়োগে এএমআর তৈরির পাশাপাশি শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কেউই সচেতন নয়। অ্যান্টিবায়োটিকের অতিব্যবহার ও অপপ্রয়োগ নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর নিরব ভূমিকায় ছিল। যদিও বর্তমানে কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে। এর অংশ হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ যাতে সহজে চেনা যায়, সেজন্য এর মোড়কে লাল চিহ্ন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মোড়কে সচেতনতার জন্য লেখা থাকবে ‘চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করবেন না’।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ইউসুফ আলী বলেছেন, ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিতে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বিক্রি বন্ধ এবং সারাদেশের ফার্মেসীগুলো আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে অনিবন্ধিত ফার্মেসির বন্ধে ওষুধ আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে।
অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ জীবানু প্রতিরোধী। কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতা ও ভোক্তার অজ্ঞতার কারণে জীবন রক্ষাকারী এই ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠছে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সর্দি-কাশিতে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ, পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন না করা, ওষুধের দোকানে ফার্মাসিস্ট না থাকা, অ্যান্টিকায়োটিকের কুফল সম্পর্কে ধারণা না থাকা এবং অর্থের লোভে তা যত্রতত্র বিক্রি করায় জীবন রক্ষাকারী এই ওষুধটি মানুষের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনছে। পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ সেবনে মাল্টি ড্রাগ রেজিসট্যান্স বা ওষুধের অকার্যকরিতা বাড়ছে বলে বলে স্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা মনে করছেন। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ বিদ্যা বিভাগের শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক ড. আবুল কালাম লুৎফুল কবির বলেন, ওষুধ একটি বিষাক্ত পদার্থ। গ্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ছাড়া এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কারো ধারণা নেই। কিন্তু দেশের ওষুধের দোকানগুলো মূলত মুদি দোকানে পরিণত হয়েছে। একজন ক্রেতা মুদি দোকান থেকে যেভাবে পণ্য কিনতে পারে, ওষুধের দোকান থেকেও একই কায়দায় তা কেনা সম্ভব হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রেজিষ্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি, অ্যান্টিবায়োটিকের পূর্ণ কোর্স গ্রহন, ব্যবস্থাপত্র সংরক্ষণ, বিক্রির পর রেকর্ড সংরক্ষণ, ওষুধের ব্যাচ নম্বর উল্লেখপূর্বক ক্যাশমেমো প্রদান, নির্দেশিত তাপমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক সংরক্ষণের নিদের্শনা রয়েছে। কিন্তু তারপরও ফার্মেসীগুলো কোন নিয়ম-নীতি মানছেনা।
সূত্র মতে, দেশে নিবন্ধিত ফার্মেসী আছে দেড় লাখের মত। এর বাইরে এক লাখের বেশি অবৈধ ফার্মেসী রয়েছে। যারা নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিকের মত ওষুধ বিক্রি করছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অণুজীব প্রতিরোধী ওষুধ গ্রহণ করছেন রোগীরা। এক্ষেত্রে অনিবন্ধিত, হাতুড়ে ও অযোগ্য চিকিৎসক বা ওষুধের দোকানদারের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের ঘটনা ঘটছে বেশি। এসব ক্ষেত্রে যথাযথভাবে রোগীর রোগ নির্ণয়ও করা হচ্ছে না। সম্প্রতি প্রকাশিত স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মূল্যায়নে উঠে এসেছে, শিশুদের ওপর অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি।
গবেষণায় উঠে এসেছে, অ্যান্টিবায়োটিকের অতিব্যবহার ও অপপ্রয়োগ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শিশুদের ওপর। বিশেষ করে নিবন্ধনহীন চিকিৎসকরা রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন বেশি। যথাযথ যোগ্যতাহীন চিকিৎসকদের কাছ থেকে আসা ব্যবস্থাপত্রের ৮৩ শতাংশেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ থাকে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যথানিয়মে অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করে না ৪১ শতাংশ রোগী। তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ শিশু। এছাড়া অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক যথেচ্ছ প্রয়োগের প্রবণতাও রয়েছে অভিভাবকদের মধ্যে।
পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার খুচরা ওষুধ ব্যবসায়ী এমএস মেডিকেল হলের স্বত্বাধিকারী আবুল হোসেন জানান, অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারের নির্দেশনার বিষয়টি অধিকাংশ বিক্রেতার অজানা। এসব বিষয়ে বিক্রেতাদের সচেতন করে তুলতে হবে। তবে যেসব নির্দেশনা রয়েছে তা অভ্যাসে পরিণত করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
গত শনিবার পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারী ওষুধ বিক্রেতারা অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির পর কোনো নথি সংরক্ষণ করছে না। ব্যাচ নম্বরসহ কোনো ক্যাশ মেমোও দিচ্ছে না। সাদা ছোট কাগজে ওষুধের নাম ও মূল্য দিলে দিচ্ছেন তারা। সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতার কোনো নাম চিহ্ন পর্যন্ত নেই। এসব ওষুধ খেয়ে কোনো পার্শ প্রতিক্রিয়া হলে তাতে কাউকে দায়ী করার কিছুই থাকছে না। পাইকারী বিক্রেতাদের পথ অনুসরণ করছেন খুচরা বিক্রেতারাও। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কোনো নজরদারিও নেই।
জানতে চাইলে ওষুধ বিক্রেতাদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিষ্ট এন্ড ড্রাগিষ্ট সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি কাজী মফিজুল ইসলাম কামাল (কাজী কামাল) বলেন, খুচরা বিক্রেতারা অ্যান্টিবায়োটিকের কুফল সম্পর্কে সচেতন নন। সরকারের নির্দেশনা মানতে খুচরা বিক্রেতাদের বাধ্য করতে হবে। এজন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজনে জরিমানা করে তা কার্যকর করতে হবে।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বাসিন্দা প্রবীণ শিক্ষক আব্দুল খালেক প্রায়ই জ্বরাক্রান্ত থাকেন। জ্বর আসলেই তিনি স্থানীয় বাজার থেকে কখনো একটি, আবার কখনো দুটি অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খেয়ে থাকেন। জ্বর সেরে যাওয়ার পর তিনি আর ওই ওষুধ খাচ্ছেন না। এভাবে তাঁর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠেছে। এখন সামান্য জ্বর হলে তাঁর শরীরে অতি উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া তা নিবারণ হচ্ছে না।
অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ জীবানু প্রতিরোধী। কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতা ও ভোক্তার অজ্ঞতার কারণে জীবন রক্ষাকারী এই ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠছে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সর্দি-কাশিতে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহন, পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন না করা, ওষুধের দোকানে ফার্মাসিস্ট না থাকা, অ্যান্টিকায়োটিকের কুফল সম্পর্কে ধারণা না থাকা এবং অর্থের লোভে তা যত্রতত্র বিক্রি করায় জীবন রক্ষাকারী এই ওষুধটি মানুষের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনছে বলে স্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা মনে করছেন।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সাবরিনা ইয়াসমিন বলেন, বাংলাদেশে অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে সেবনের প্রবণতা। অসুস্থ হলেই ফার্মেসি থেকে সাধারণ মানুষ ওষুধ কিনে সেবন করেন। দেশের আট বিভাগের ৪২৭টি ফার্মেসিতে জরিপ করে আমরা পেয়েছি ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ ফার্মেসির কর্মীরাই অ্যান্টিবায়োটিক সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না। এছাড়া তারা সহজে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ চিনতেও পারেন না। তিনি বলেন, মানুষ ও পশু দুই ক্ষেত্রেই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের মোড়কে লাল চিহ্ন ব্যবহার করা হবে। অনেক কোম্পানি বর্তমান সময়েও তাদের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের মোড়কে এ চিহ্ন ব্যবহার করছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. এম এ ফয়েজ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের ভয়াবহতা সম্পর্কে বলেন, যখন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ও পরজীবী সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় এবং ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে তখন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স ঘটে। জীবাণুগুলো ওষুধ প্রতিরোধী হওয়ার ফলে অ্যান্টিবায়োটিক এবং অন্যান্য অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে সংক্রমণের চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এতে রোগের বিস্তার, গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। দ্য ল্যানসেটের বিশ্লেষণে ২০১৯ সালে এএমআরের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৫০ লাখ মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিষয়টিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনস্বাস্থ্যের জন্য শীর্ষ হুমকিগুলোর একটি হিসেবে অভিহিত করছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, এএমআর একটি মহামারী সুনামি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন