হিজরি বর্ষপঞ্জির সপ্তম মাসের নাম রজব বা রাজ্জাব। অন্ধকার যুগে এই মাসটি বছরের গ্রীষ্মার্ধের প্রথম মাস ছিল। পরবর্তীকালে প্রক্ষেপণ পদ্ধতি মতে মাস যোগ করার রীতি বর্জিত হওয়ার ফলে প্রত্যেকটি মাস প্রতি বছর একই ঋতুতে নিয়মিতভাবে পড়া বন্ধ হয়ে যায়। ফলে, রজব মাসটি শীত এবং গ্রীষ্ম উভয় ঋতুতেই ঘুরে-ফিরে আসে, যা রোজ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। মোট কথা, ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে প্রাচীন মক্কা বছরের প্রথম দুই মাস ছিল প্রথম সাফার ও দ্বিতীয় সাফার। আল মুহাররাম ও সাফারের স্থলে আল সাফারাইনি এ দ্বিবাচনিক রূপ দেখে তা বোঝা যায়। প্রাচীন আরব বছরের প্রথম অর্ধবছরে তিনটি মাস ছিল এবং এই তিন মাসের প্রত্যেকটিতে দু’টি করে মাস ছিল। যেহেতু দুই সফরের পরে দুই বারই এবং দুই জুমাদা ছিল, আর দুই সফরের প্রথমটি অলঙ্ঘনীয় পবিত্র মাসগুলোর অন্যতম ছিল বলে এর গুণবাচক আখ্যা দেয়া হয়েছিল মুহাররাম। পরবর্তীতে তা-ই মাসের নাম হয়ে গেছে।
জিলহজ্জ মাসও অলঙ্ঘনীয় পবিত্র মাসগুলোর অন্যতম হওয়ায় অধিবর্ষ ছাড়া অন্যান্য বছরে চারটি অলঙ্ঘনীয় পবিত্র মাসের তিনটি একাধিক্রমে আসত। চন্দ্র বছরকে সৌর বছরের সাথে সমপর্যায়ে আনবার জন্য বর্ণিত সংযুক্ত মাসটিকে জিলহজ্জের পরে ধরা হত এবং তা অলঙ্ঘনীয় মাস হত না। ফলে বর্ধিত মাস প্রবর্তন করে সৌরবছরের সমপর্যায়ে আনয়ন করার চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ, ইসলাম এ ধরনের বর্ধিত মাস সংযোজনকে নিষিদ্ধ করেছে।
বস্তুতঃ রজব মাসটি প্রকৃতই একটি বরকতময় পবিত্র মাস। জাহিলিয়্যা যুগে এই মাসে হজ্জের অঙ্গীভ‚ত অনুষ্ঠান উমরা পালন করা হত। সুতরাং এই মাসে আল্লাহপাকের তরফ হতে শান্তিবর্ষিত হত। এই মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। অথচ কুরঈশ এবং আরবগোষ্ঠির মধ্যে এই মাসেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। একারণে একে ফিজার সমর বা অবৈধ যুদ্ধ নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
কোরআনুল কারীমে রজব মাসের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাকে তুলে ধরে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আকাশমÐলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনার মাস বারটি, তন্মধ্যে চারটি মাস হচ্ছে পবিত্র ও নিষিদ্ধ মাস, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না এবং তোমরা মুশরিকদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করবে, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে থাকে এবং জেনে রেখ, আল্লাহপাক মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন। (সূরা তাওবাহ : ৩৬)।
এই আয়াতে কারীমায় যে চারটি মাসকে পবিত্র ও নিষিদ্ধ মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তা হলো জিলকাদ, জিলহাজ্জ, মুহাররাম ও রজব। এই চারটি মাস আরববাসীদের নিকট খুবই পবিত্র ছিল এবং আছে। সেহেতু তারা এই চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হতো না এবং এই চারটি মাসকে খুবই সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করত।
লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, উপরোক্ত আয়াতে কারীমায় ‘আরবাআতুন হুরুম’ শব্দদ্বয় যোগে যে চারটি মাসের উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর নাম কী কী তা বলা হয়নি। এই মাসগুলোর নাম বিবৃত হয়েছে সহীহ হাদীসে। প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) পাক জবানে সেগুলোর নাম তুলে ধরেছেন। উম্মতে মুহাম্মাদীয়া রোজ কিয়ামত পর্যন্ত এই চারটি মাসের মর্যাদা ও পবিত্রতা অক্ষুণœ রাখবে, তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
জাহিলিয়্যা যুগে তো বটেই বরং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনের অন্যতম ঘটনা ‘ইসরা’ বা নৈশ ভ্রমণের বিষয়টিও রজব মাসের সাথে জড়িত। এতে করে ইসলামে রজব মাসের গৌরব বিশেষভাবে বর্ধিত হয়েছে। উক্ত মাসের ২৭ তারিখটি মিরাজের তারিখ রূপে নির্ধারিত হয়। নৈশ ভ্রমণের এই রাতকে লাইলাতুল মিরাজ নামে আখ্যায়িত করা হয়।
এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পবিত্র ও মহিমময় তিনি, যিনি তার বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছিলেন, মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায়, যার পরিবেশ আমি বরকতময় করেছিলাম, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য। তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা’। (সূরা বনী ইসরাঈল : ০১)। এতে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়ে যে, রজব মাসটি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মিরাজের স্মৃতি নিজের বক্ষে ধারণ করে আছে বলেই, এ মাসের সম্মান ও মর্যাদা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন