আমরা এ পর্যন্ত সহৃদয় পাঠক ও পাঠিকাদেরকে নিয়ে আল কুরআনে ব্যবহৃত ‘বরকত’ শব্দের অর্থ এবং মর্ম অনুসন্ধানে বহু দূর এগিয়ে এসেছি। এর জন্য মহান আল্লাহপাকের দরবারে হাজারো কৃতজ্ঞতা, হাজারো শুকুরগুজারী জ্ঞাপন করছি। বরকতময় আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের ফলেই তা’ সম্ভব হয়েছে। সকল অবস্থায় আল্লাহপাকই আমাদের সহায়।
তবে, স্মরণ রাখা দরকার যে, বরকত শব্দ হতে উদগত ‘মাবারাকাতুন’ শব্দটি আল ক্রুআনে চার বার ব্যবহৃত হয়েছে। যথা : (ক) ইরশাদ হয়েছে : ‘আল্লাহ আসমান সমূহ ও জমিনের নূর, তার নূরের উপমা যেন একটি দীপধার যার মধ্যে একটি প্রদীপ আছে, প্রদীপটি একটি কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাঁচের আবরনটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো, তা জ্বালানো হয় বরকতময় জায়তুন গাছের তেল দ্বারা যা শুধু পূর্ব দিকের (সূর্যের আলোকপ্রাপ্ত) নয় আবার শুধু পশ্চিম দিকের (সূর্যের আলোকপ্রাপ্ত ও) নয়, আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও যেন তার তেল উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে’। (সূরা আন নূর : ৩৫)।
এই আয়াতে কারীমায় যে বরকতময় জায়তুন গাছের তেলের কথা বলা হয়েছে, তা’ নূরে হেদায়েতের উদাহরণ, যা মুমিনের স্বভাবে গচ্ছিত রাখা হয়েছে। এর গুণ হচ্ছে আপনা-আপনি সত্যকে গ্রহণ করা। জায়তুন তেল অগ্নি স্পর্শে প্রজ্জ্বলিত হয়ে যেমন অপরকে আলোকিত করে, তেমনিভাবে মুমিনের অন্তরে রাখা নূরে হেদায়েত যখন আল্লাহর ওহী এবং জ্ঞানের সাথে মিলিত হয়, তখন আলোকিত হয়ে গোটা বিশ্বকে আলোকিত করে দেয়। (তফসীরে ইবনে কাসির; তফসীরে কুরতুবী; তাফসীরে মায়ালেমুত তানজিল; তাফসীরে মায়ারেফুল কুরআন।)
(খ) ইরশাদ হয়েছে : ‘তবে যখন তোমরা কোনো ঘরে প্রবেশ করবে তখন তোমরা পরস্পরের প্রতি অভিবাদন স্বরূপ সালাম করবে যা আল্লাহর কাছ থেকে বরকতময় ও পবিত্র’। (সূরা নূর : ৬১)। (গ) ইরশাদ হয়েছে : ‘অতঃপর মূসা যখন তার মেয়াদ পূর্ণ করার পর সপরিবারে যাত্রা করলেন, তখন তিনি তুর পর্বতের দিকে আগুন দেখতে পেলেন। তিনি তার পরিজনবর্গকে বললেন, তোমরা অপেক্ষা কর, আমি আগুন দেখেছি, সম্ভবত : আমি সেখান থেকে তোমাদের জন্য খবর আনতে পারি অথবা এক খণ্ড জ্বলন্ত কাঠ আনতে পারি, যাতে তোমরা আগুন পোহাতে পার। অতঃপর যখন মূসা আগুনের কাছে পৌঁছলেন তখন উপত্যকার ডান পাশে বরকতময় ভূমির উপর অবস্থিত সুনির্দষ্ট গাছের দিক থেকে তাকে ডেকে বলা হয়, হে মূসা! আমিই আল্লাহ, কুল মাখলুকাতের প্রতিপালক’। (সূরা আল কাসাস : আয়াত : ৩০-৩১)। এই আয়াতে বরকতময় ভূমি বলতে তুর পাহাড়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
(ঘ) ইরশাদ হয়েছে : ‘নিশ্চয় আমি একে এক বরকতময় রাতে নাজিল করেছি, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী’। (সূরা আদ দুখান : আয়াত-৩)। এই আয়াতে কারীমায় ‘হু’ সর্বনাম দ্বারা সুস্পষ্ট কিতাব আল কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। (তফসীরে জালালাইন, তাফসীরে সা’দী)। আর মুবারক রাত বলতে কদরের রাত্রিকে বুঝানো হয়েছে, যা রমজান মাসের শেষ দশকে হয়। সূরা কদরে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, পবিত্র কুরআন শবে কদরে নাজিল হয়েছে।
এতে বোঝা যায় যে, এখানেও বরকতের রাত্রি বলতে শবে কদরই বোঝানো হয়েছে। আর এ রাত্রিকে মোবারক বা বরকতময় বলার কারণ এই যে, এ রাত্রিতে আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে অসংখ্য কল্যাণ ও বরকত নাজিল হয়। এক হাদীসে এসেছে পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলূল্লাহ (সা.) বলেছেন : দুনিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত নবী ও রাসূলগণের প্রতি যত কিতাব নাজিল করেছেন, তা সবই রমজান মাসেরই বিভিন্ন তারিখে নাজিল হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ইবরাহীম (আ.)-এর সহীফা সমূহ রমজান মাসের প্রথম তারিখে, তাওরাত ছয় তারিখে, যাবুর বার তারিখে, ইঞ্জিল আঠার তারিখে, এবং কুরআনুল কারীম চব্বিশ তারিখ অতিবাহিত হওয়ার পর (পঁচিশের রাত্রিতে) অবতীর্ণ হয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ : ৪/১০৭)।
এতদপ্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন : বরকতময় রাতের অর্থ কুরআন অবতরণের রাত্রি। অর্থাৎ শবে কদরে সৃষ্টি সম্পর্কিত সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ফায়সালা নির্ধারিত করা হয়, যা পরবর্তী শবে কদর পর্যন্ত এক বছরে সংঘটিত হবে। মোট কথা, এ বছর কারা কারা জন্ম গ্রহণ করবে, কে মারা যাবে এবং এ বছর কি পরিমাণ রিজিক দেয়া হবে তা’ স্থির করা হয়।
ইমাম মারদাওয়াই বলেন, সে রাতে প্রত্যেক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থিরকৃত হওয়ার অর্থ এই যে, আল্লাহপাক কর্তৃক নির্ধারিত তকদীরে পূর্বাহ্ন্ইে স্থিরকৃত সকল ফায়সালা এ রাত্রিতে সংশ্লিষ্ট ফিরিশতাগণের কাছে অর্পণ কর হয়। কেননা, কুরআন ও হাদিসের অন্যান্য বর্ণনা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ তা’য়ালা এসব ফায়সালা মানুষের জন্মের পূর্বেই সৃষ্টিলগ্নে লিখে রেখেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন