বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ এবং আজকের অনুষ্ঠান

| প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুজিবুর রহমান মুজিব : বৃহত্তর সিলেট একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক জনপদ। প্রাচীনকালে বৃহত্তর সিলেট লাউড়, গৌড়, জৈন্তা, তরফ ও ইটা এই পাঁচটি প্রধান সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত ছিল। রাজ্যগুলোর মধ্যে গৌড় ছিল প্রাচীন ও বৃহত্তম। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে গৌড়ের অত্যাচারী শাসক গোবিন্দকে পরাজিত করে এই অঞ্চলে ইসলামের বিজয় নিশান উড়ান ওলিকুল শিরোমণি হযরত শাহ জালাল ইয়েমেনী (র.)। তখন থেকে মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির আলোকে আলোকিত হতে থাকে জনপদ। সময়ের বিবর্তনে সামন্ত যুগের অবসান, বৃটিশবিদায় এবং পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রাচীন এই জনপদ সিলেট জেলা সদর এবং স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে বিভাগীয় সদর হিসেবে সমাজ বিকাশের ধারাবাহিকতায় গৌরবোজ্জ্বল অবদান রাখছে। সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত সিলেটের জ্ঞানী গুণীজন বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা, মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের মহান লক্ষ্যে যেসব সংঘ-সমিতি-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তাদের মধ্যে ‘কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেট’ এবং যুগভেরী অন্যতম। সাপ্তাহিক যুগভেরী দৈনিক হয়ে দেশের প্রাচীনতম পত্রিকা হিসেবে সগৌরবে প্রকাশিত হচ্ছে। সিলেটের সুধী সমাজের নিকট সংসদ হিসেবে সুপরিচিত কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ-কেমুসাস এবং সংসদের মুখপত্র-আল ইসলাহ সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্যের গৌরবোজ্জ্বল অংশ ও অধ্যায়। দেশে বিদেশে সামাজিক সেবা সংগঠন সমূহের ইতিহাস সুপ্রাচীন গৌরবদীপ্ত। প্রাক ইসলামিক এ্যারাবিয়ায় মরুভাস্কর মহা-মানব-মহানবী মোহাম্মদ (স.) নবুওতির পূর্বেই ঊষর মরুর ধূসর দেশে সামাজিক সেবা সংগঠন-হিলফুল-ফুজুল গঠন করে আল-আমীন খ্যাতি অর্জন করেন। বৃটিশ ভারতেÑ ভারতীয় মুসলিম সমাজ-এ্যাংলোওরিয়েন্টেল মোহামেডান সোসাইটি মুসলিম সমাজকে জাগ্রত ও ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ করে।
কাপ্তান মিয়া হিসেবে সুপরিচিত আসামের শিক্ষামন্ত্রী সৈয়দ আব্দুল মুজিদ সি আই ই প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ও সাহিত্য সংগঠন কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেট এবং সংসদের মুখপত্র আলইসলাহর সঙ্গে আরেকটি নাম শ্রদ্ধার সাথে সম্পৃক্ত, তিনি পাঠাগার আন্দোলনের পথিকৃত আলইসলাহ সম্পাদক মৌলভী নুরুল হক দশঘরি। দশঘরের এক মাদ্রাসা পড়–য়া মৌলভী জাগতিক লোভ-লালসা, চাওয়া-পাওয়াকে পরিহার করে আজীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন আলইসলাহ এবং সংসদের খেদমতে। সংসদ এবং নুরুল হক দুটি নাম হলেও এক সত্তায় পরিণত হয়েছিল। সংসদকে বাঁচিয়ে প্রাণবন্ত এবং আলইসলাহ্্র প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে সিলেটের জ্ঞানী-গুণী-বিদগ্ধ সমাজ দলমত-পথ, বয়স, কর্ম-পেশা নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেছেন। সিলেটের সর্বজনশ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদ মহান স্বাধীনতার সংগঠক দেওয়ান ফরিদ গাজি, ভাষা সৈনিক-শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মসউদ খান  প্রমুখ জ্ঞানী-গুণীজন বিভিন্ন সময় অন্যতম সংগঠক ও সভাপতির গুরু দায়িত্ব পালন করে সংসদ ও সিলেটী সমাজকে আলোকিত করেছেন। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রকৃতি ও মানব প্রেমিক সাংবাদিক-কলামিস্ট আফতাব চৌধুরী দীর্ঘদিন কৃতিত্ব ও আন্তরিকতার সাথে সংসদের সহ-সভাপতি-সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করে বর্তমানেও আজীবন সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালনরত।
দক্ষিণ সিলেটের সেকালের সাহিত্য ও সংবাদপত্র সেবীদের মধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লোক বিজ্ঞানী চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্য ভুষণ, বৃটিশ ভারতের খ্যাতিমান সাংবাদিক সাপ্তাহিক নকিব (১৯৩৭) সম্পাদক মৌলভী ছনাওর আলী এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক সৈয়দ সামসুল ইসলামের সঙ্গে আল-ইসলাহ সম্পাদক মৌলভী নূরুল হকের সখ্য ও বন্ধুত্ব ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় এখনও সিলেটের সঙ্গে দক্ষিণ শ্রীহট্টবাসীর সুসম্পর্ক বিদ্যমান। সর্বোপরি পীরানে পীর হযরত শাহজালাল ইয়েমেনীর (র.) মাজার এবং সিলেটী ঐতিহ্য সমগ্র বৃহত্তর সিলেটবাসীকে এক ঐক্যবদ্ধ ও অভিন্ন করে রেখেছ।  
১৯৬৪ সালে সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ থেকে এস এস সি পাস করি।  সামান্য নাম্বারের জন্য ফার্স্ট ডিভিশন মিস হলেও সকল বিষয়ে ভালো নম্বর ছিল। শিক্ষানুরাগী আমার মরহুম পিতার ইচ্ছা ছিল ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া। দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে মানুষের মত মানুষ হওয়া। তখন এমসি কলেজের দেশে-বিদেশে নামডাক। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল সলমান চৌধুরী অধ্যক্ষ। অতি সহজেই এম সি কলেজে ভর্তি হলাম। হোস্টেলে সিট পেলাম না। মেসের-খাবার ভালো নয়। তখন মেস সিস্টেম এখনকার মত এত উন্নত ছিল না। ফলে মেসের পরিবর্তে মোবারক হোটেল হয়ে আমার কতিপয় বিয়ানীবাজারি বন্ধুর পরামর্শে দরগা গেইটস্থ জালালিয়া মোশায়েদী হোটেলে উঠলাম। পরে এম সি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ হোস্টেল চালু হলে আমরা প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে হোস্টেলে উঠি। জালালিয়াতে অবস্থানকালে দরগাহ শরীফ ও সংসদের কাছে আসি। শ্রদ্ধেয় নুরুল হক মরহুমের ভ্রাতষ্পুত্র কাফেলা সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের সাথে লেখালেখির সুবাদে আমার সখ্য গড়ে উঠে। তখন সিলেটে আমাদের নিজস্ব বাসাবাড়ি ছিল না। সময়ের পরিবর্তনে শাহজালালের সিলেট এখন আধুনিক মহানগরী। আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা গনী বাসাবাড়ি করেছে। সিলেটস্থ মৌলভীবাজার সমিতি এবং রোটারি ক্লাবের সভাপতি হয়ে সিলেটের সমাজ উন্নয়নে কাজ করছে। এখন আমার ও আমাদের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের বাসাবাড়ি আছে। সিলেট শহরে ঢুকতেই উপশহর এলাকায় বন্ধুবর আফতাব চৌধুরীর বিশাল চৌধুরী বাড়ি। সখ্য ও সম্পর্কের সুবাদে আমার ভাইয়ের বাসা সুবিদ বাজার যাবার আগে ভাই আফতাব চৌধুরীর বাসায় উঠতে হয়। খেতে হয়। আরো দুটি দুর্বলতা আছে আমার- তার বিশাল পাঠাগার এবং বাহারি বৃক্ষরাজি। আর দায়িত্বও আছে তার অসুস্থ স্ত্রী হামনা খানম চৌধুরীকে সালাম দেয়া, দোয়া নেয়া ও দোয়া দেয়া।
সিলেট থেকে চলে এলেও পুণ্যভূমি সিলেটের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়নি। বরং বয়োবৃদ্ধি, দুনিয়া দেখা ও কিঞ্চিত শেখার কারণে ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের বন্ধন আরো মজবুত হয়েছে। হচ্ছে। সত্তর দশকে আমি কেমুসাস-এর আজীবন সদস্য হই। সংসদের শহীদ সুলেমান হলটি, সভা-সমাবেশ বুদ্ধিবৃত্তিতে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে যাই। নব্বইর দশকে লন্ডনভিত্তিক শিক্ষা সংগঠন বি.এন.এস.এ. আমার ‘গবেষণাগ্রন্থ, ইটার ইতিহাস’ কে বিভাগের শ্রেষ্ঠ ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে নির্বাচিত করে অন্যান্যের সঙ্গে আমাকে সংবর্ধনা প্রদান করে। গবেষক প্রফেসর নন্দ লাল শর্মা, সুলেখক সুপ্রিয় চৌধুরী হারুন আকবর সাংবাদিক কলামিস্ট আফতাব চৌধুরী এবং অগ্রজ প্রতিম গবেষক-লেখক সৈয়দ মোস্তফা কামালের উপস্থিতি ও সরেস আলোচনায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি। সংসদ প্রাঙ্গণ মুখরিত ছিল লেখক-গবেষকদের উচ্ছল পদভারে। এতদিন পর এখনও সেই সুখানুভূতি হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। গেল দশকে এই শহীদ সুলেমান হলেই নাগরিক সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল শিকড় সন্ধানী লেখক অকুতোভয় বীর মোজাহিদ আলহাজ্ব সৈয়দ মোস্তফা কামাল অগ্রজপ্রতিমেষুকে। গিয়েছিলাম। মনের সুখে বক্তৃতা দিয়েছিলাম। সেদিনও আনন্দ উল্লাসে-মাতোয়ারা ছিল শহীদ সুলেমান হল প্রাঙ্গণ। একজন চিত্তবান বিত্তশালীর বদাণ্যতায় শহীদ সুলেমান হল আর আগের দীন-হীনঅবস্থায় নেই বিশাল ভবন হয়েছে। আকর্ষণীয় দৃষ্টিনন্দন। সংসদেও বর্তমান সভাপতির গুরু দায়িত্বে আছেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ আব্দুল আজিজ এবং সম্পাদক পদে আছেন মরহুম মৌলভী মোঃ নুরুল হকের রক্ত ও উত্তরাধিকার প্রিয় ভাজন আজিজুল হক মানিক। মহান আল্লাহর অপার রহমত ও বরকতে মরহুম মৌলভী নুরুল হক সাহেবের সকল সন্তানই উচ্চ শিক্ষায় সুশিক্ষিত, কর্ম জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত।
এহেন ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী সংস্থা কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেট আজ ৭ জানুয়ারী সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছে। ২০১৬  সাহিত্য পুরস্কার পাবেন ষাটের দশকে এম সি কলেজের শিক্ষক, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু কবি ও কলামিস্ট, সাবেক হাই কমিশনার এ এইচ মোফাজ্জল করিম। উদ্যোক্তাগণ উৎসবানুষ্ঠানটি যথার্থ ভাবেই উৎসর্গ করেছেন সংসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়ার পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশ্যে। উৎসবানুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রবীণ সাংবাদিক, বৃহত্তর সিলেটের আরেক গুণীজন সালেহ চৌধুরী। এমন মেজাজি উৎসবানুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা খোশ নসীবের ব্যাপার। কিন্তু বদ নসীব আমার, তিন মাসাধিককাল যাবত ডান পা ভেঙ্গে আমি শয্যাশায়ী থেকে বর্তমানে সোফাশায়ী। শ্রদ্ধেয় মোফাজ্জল করিম সেকাল থেকে একাল-এখন পর্যন্ত ছাত্রবৎ-মিত্রবৎ দেখেন। দেখভাল করেন। তাঁর সম্বর্ধনানুষ্ঠানে তাঁর পাশে দাঁড়ানো, সেবাযতœ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব ছিল, পারলাম না। উদ্যোক্তাগণকে শ্রদ্ধাঞ্জলি, উৎসবানুষ্ঠানের সাফল্য এবং শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু এ. এইচ. মোফাজ্জল করিমের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু এবং সার্বিক কল্যাণ কামনা করি।
(মুক্তিযোদ্ধা। সিনিয়র এডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। আজীবন সদস্য কেমুসাস, সিলেট।)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন