নূরুল ইসলাম : ঢাকায় ৫০ লাখ পথচারীর জন্য টয়লেট আছে মাত্র ৪৭টি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যবহারের অযোগ্য। কতোগুলো আবার বন্ধ থাকে। যেগুলো চালু আছে সেগুলোতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বলতে কিছু নেই। প্রায় পৌনে দুই কোটি ঢাকাবাসীর মধ্যে প্রায় অর্ধেক নারী হলেও তাদের জন্য পৃথক কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। টয়লেটের অভাবে ঢাকার অলিতে-গলিতে মানুষ প্রস্রাব পায়খানা করে থাকে। এতে করে পরিবেশের মারাত্মক দূষণ হচ্ছে। টয়লেট নিয়ে ভুক্তভোগিদের অভিযোগের শেষ নেই। ডিএসসিসির একজন কর্মকর্তা জানান, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উন্নতমানের বেশ কয়েকটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে কয়েকটি চালুও হয়ে গেছে। বাকীগুলোর কাজ শেষ হলে টয়লেট সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে।
ভুক্তভোগিদের মতে, ঢাকা এখন যানজটের শহর। এখানে ২০ মিনিটরে পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। এর মধ্যে কারো টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হলেই বিপদ। টয়লেটের অবস্থান কোথায় সেটাও যেমন বেশিরভাগ মানুষের অজানা, আবার অবস্থান জানলেও সেই টয়লেট আদৌ খোলা আছে নাকি বন্ধ তা নিয়েও দ্বিধায় থাকতে হয়। আলাপকালে একজন ভুক্তভোগি বলেন, আজকাল অনেকেরই ডায়াবেটিস রোগ দেখা দিচ্ছে। এতে করে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসে। ঘর থেকে বের হলে টয়লেটের টেনশনে আরও ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসে। এজন্য কতোট সমস্যায় পড়তে হয় তা ভুক্তভোগি ছাড়া কেউই বুঝবে না। আরেক ভুক্তভোগি বলেন, অনেক সময় খোঁজাখুঁজি করে টয়লেটের অবস্থান জানা গেলেও রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে অনেক সময় চলে যায়। তখন বাধ্য হয়ে রাস্তার উপরই বসে পড়তে হয়। এতো গেল পুরুষ মানুষের সমস্যার কথা। পুরুষের স্থলে মহিলা হলে কি অবস্থা হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইডের তথ্যমতে, ঢাকায় প্রতিদিন রাস্তায় চলাচল করা এক লাখ মানুষের জন্য গড়ে একটি পাবলিক টয়লেটও নেই। এ বিষয়ে ২০১১ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করে সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ ও ওয়াটার এইড। যার ফলাফলে বলা হয়েছে, প্রায় ৮০০ বর্গ কিলোমিটারের ঢাকা শহরে প্রায় এক কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষের মধ্যে পাঁচ লাখ ভাসমান, ১০ লাখ রিকশাচালক, আরো ১০ লাখ অন্যান্য জীবিকার মানুষ। ২০ লাখ নিয়মিত পথচারী এবং ঢাকার বাইরে থেকে আসা ১০ লাখসহ মোট ৫৫ লাখ মানুষের প্রতিদিন চলাচলের সময় টয়লেট ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। দুই সিটি কর্পোরেশন মিলে ঢাকায় পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা ৪৭টি। অবশ্য সিটি কর্পোরেশন সূত্র দাবি করেছে এখন পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা আরও কয়েকটি বেড়েছে। ২০১১ সালের ওই হিসাব ধরলেও ঢাকায় ৫০ লাখ মানুষের জন্য ৪৭টি টয়লেট একেবারেই অপ্রতুল।
জানা গেছে, দুই সিটি কর্পোরেশন পাবলিক টয়লেটগুলো নিজেরা পরিচালিত না করে বেসরকারি পর্যায়ে ইজারা দিয়ে রেখেছে। সেগুলো ব্যবহার করতে ৫-১০ টাকা খরচ করতে হয়। যা দরিদ্রদের জন্য কষ্টসাধ্য। আবার নজদরদারি না থাকায় ইজারাদাররা বেশি টাকা আয়ের জন্য পাবলিক টয়লেটের পানি বিক্রি করে থাকেন। গাড়ি ধোয়ার কাজে, টোকাই কিংবা ছিন্নমূল মানুষদের কাছে এই পানি বিক্রি করেন তারা। এমনকি টয়লেটগুলো মাদক ব্যবসায়ীদের লেনদেনেরও স্থান হয়ে উঠেছে। রাজধানীর গুলিস্তান এলাকার পুরাতন পাবলিক টয়লেটে গিয়ে দেখা গেছে এটি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, প্রায় দুই যুগ আগে তৈরী এ পাবলিক টয়লেটটি অনেক আগেই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তারপরেও প্রয়োজনের তাগিদে এটি চালু রাখা হয়েছে। এখানেও ইজারাদার ৫-১০ টাকা করে আদায় করে। পাবলিক টয়লের সামনের রাস্তা হকাররা দখল করে দোকান বসিয়েছে। এ কারণে দূর থেকে এটি দেখা না যাওয়ায় অনেকেই প্রয়োজনের সময় এটি খুঁজে পায় না। একই অবস্থা রাজধানীর অন্যান্য পাবলিক টয়লেটগুলোর। এছাড়াও বেশিরভাগ টয়লেটের দরজা জানালা নেই, দরজা থাকলেও ছিটকিনি লাগে না। নেই বিদ্যুতের ব্যবস্থা। কোনটাতে আবার পর্যাপ্ত আলো বাতাসও প্রবেশ করতে পারে না। বর্ষকালে ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে। ময়লার গন্ধে ভিতরে প্রবেশ করা যায় না। কোনটার ভিতরে অথৈ পানি। আবার পোকামাকড়ের ঘরবসতি আছে কোনো কোনো টয়লেটে।
এ প্রসঙ্গে ভুক্তভোগি সরকারি চাকরিজীবী মোরশেদ বলেন, ঢাকার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। অথচ এখানে মহিলাদের জন্য পৃথক কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। এ কারণে শহরে মহিলাদের নিয়ে বের হলে টয়লেট সমস্যা কিভাবে সমাধান করা যাবে সে কথা আগে চিন্তা করতে হয়। তবে ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে যে কটি টয়লেট নির্মাণাধীন রয়েছে সবগুলোতে মহিলাদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকবে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, তুলনামূলকভাবে কম ‘টয়লেট’ ব্যবহার করায় নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছে কর্মজীবী ও পেশাজীবী নারীরা। দেশের মোট জনসংখ্যা ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী হলেও পাবলিক টয়লেটগুলোতে তাদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। পাবলিক টয়লেটের সুব্যবস্থা না থাকায় পথচারী, হকার, রিকশাচালক, ভিক্ষুক ও ভাসমান মানুষ বাধ্য হয়েই তারা ফুটপাতের পাশে, পার্কে, লেকে, সড়কের পাশে বিভিন্ন উন্মুক্ত জায়গায় মল-মূত্র ত্যাগ করছে। এতে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে ও জনস্বাস্থ্য ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। একই সাথে রাজধানী শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখা যাচ্ছে না। ঢাকা ক্রমে হয়ে উঠছে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকী, বসবাসের অযোগ্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন