তিল ধারণের জায়গা নেই তুরাগ তীরে
মো. দেলোয়ার হোসেন, মো. হেদায়েত উল্লাহ : এতটুকু তিল ধারণের জায়গা নেই বিশ্ব ইজতেমা প্রাঙ্গণে। তারপরও ধর্মপ্রাণ মানুষের স্রোত অব্যাহত রয়েছে তুরাগ তীরে।
আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় ছুটে আসার ব্যাকুলতা ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের। ইজতেমার দ্বিতীয় দিনে গতকাল (শনিবার) দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লির পদভারে মুখর হয়ে উঠে শিল্পনগরী। সন্ধ্যার পর গোটা টঙ্গী শহর পরিণত হয় জনসমুদ্রে। এদিকে আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান ও রাসূল (সা.) প্রদর্শিত তরিকা অনুযায়ী জীবন গড়ার আহ্বান জানিয়ে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লির জিকির-আসকার, ইবাদত-বন্দেগী আর পবিত্র কোরআনের আলোকে গুরুত্বপূর্ণ বয়ানের মধ্য দিয়ে গতকাল ইজতেমার দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়।
তবে তীব্র শীতে ও কনকনে বাতাসে অনেক মুসল্লিকে দুর্ভোগ পোহাতে দেখা গেছে। বিশেষ করে বয়স্কদের ওযু-গোসলে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। অনেক মুসল্লিকে প্যান্ডেলের নীচে কম্বল মুড়ি দিয়ে জবুথবু হয়ে বয়ান শুনতে দেখা গেছে।
আজ (রোববার) আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে তাবলীগ জামাত আয়োজিত ৫২তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। ইজতেমা ময়দানের বিদেশি নিবাসের পূর্বপার্শ্বে বিশেষভাবে স্থাপিত মোনাজাত মঞ্চ থেকে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে শুরু হবে আখেরী মোনাজাত। বিশেষ এ তাৎপর্যপূর্ণ মোনাজাতে প্রায় ৪০ লাখ মুসল্লি অংশ নেবেন বলে ইজতেমার আয়োজকরা ধারণা করছেন।
এর আগে অনুষ্ঠিত হবে হেদায়েতি বয়ান। তাবলীগ জামাতের ভারতের দিল্লী মারকাজের শূরা সদস্য হযরত মাওলানা সা’দ হেদায়েতি বয়ান করবেন। তাবলীগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বীদের পরামর্শের ভিত্তিতে তাঁরই আখেরী মোনাজাত পরিচালনার কথা রয়েছে।
এবারের প্রথম পর্বের আখেরী মোনাজাতে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন অংশ নেবেন কি না শনিবার বিকেল পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। তবে বিশেষ ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকা থেকে মোনাজাতে শরিক হবেন বলে আইন-শৃংখলা বাহিনীর দায়িত্বশীল একটি সূত্র থেকে জানা গেছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ইজতেমা মাঠের পার্শ্বে হোন্ডা কারখানার ছাদে বিশেষভাবে তৈরি মঞ্চে আখেরী মোনাজাতে শামিল হওয়ার কথা রয়েছে।
চারদিন বিরতির পর আগামী ২০ জানুয়ারি থেকে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে। আর ২২ জানুয়ারী এ পর্বের আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার পরিসমাপ্তি ঘটবে।
এদিকে প্রথম পর্বের ইজতেমার আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিরা ট্রেন, বাস, ট্রাক, লঞ্চ, নৌকাযোগে ও পায়ে হেঁটে দলে দলে ইজতেমাস্থলে আসতে শুরু করেছেন। মুসল্লিদের আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে ইজতেমা ময়দানে আসার এ স্রোত, মোনাজাতের আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে জানান ইজতেমা আয়োজক কমিটি। আজ রোববার জোহরের নামাজের পূর্বে যে কোন সময় ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
যারা বয়ান করছেন:
গতকাল (শনিবার) বাদ ফজর ভারতের হযরত মাওলানা জমশেদ আলীর বয়ানের মধ্যদিয়ে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিন শুরু হয়। এই বয়ানের তাৎক্ষণিক ভাষান্তর করে শুনান বাংলাদেশের মাওলানা জাকির হোসাইন। এ ছাড়া বাদ জোহর বয়ান করেন ভারতের হযরত মাওলানা মোস্তাক আহমদ, বাদ আছর বয়ান করেন একই দেশের মাওলানা হযরত ইউসুফ আলী, বাদ মাগরিব বয়ান করেন ভারতের হযরত মাওলানা সা’দ।
বয়ানে যা বলা হলো
ইজতেমার ময়দানে বয়ানে শীর্ষ মুরুব্বী ও ইসলামী চিন্তাবিদরা বলেন, দ্বীন ও ইসলামের দাওয়াত আল্লাহ পাকের অসীম রহমতে ও অনুগ্রহে তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় দ্বীন ইসলাম পুনরুজ্জীবিত করে নর-নারীর মধ্যে দাওয়াত পৌঁছে দিতে হবে। হযরত মোহাম্মদ (সা.) উম্মতের জিম্মাদার হিসাবে ঈমানিয়াত, ইবাদত, মোয়ামেলাত ও আখলাক অনুশীলনে জানমাল আল্লাহর রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে জিন্দেগীতে কিছু সময় দাওয়াত, তালিম, জিকির, নামাজে মশগুল হওয়ার আহ্বান জানান ইসলামী চিন্তাবিদগণ। এসব বয়ান বাংলা, আরবি, ফার্সি, মালয় ও তামিল, উর্দ্দুসহ কয়েকটি ভাষায় তাবলীগ জামাতের মুুরুব্বীদের তরজমা করে মুসল্লিদের মাঝে শোনানো হচ্ছে।
মহান আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভের ব্যাকুলতায় দ্বীনের দাওয়াতে মেহনত করার জন্য ইসলামের মর্মবাণী সর্বত্র পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিন শনিবারেও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা দলে দলে ছুটে আসছেন টঙ্গীর তুরাগ তীর ইজতেমা ময়দানে। বিগত ইজতেমাগুলোতে যৌতুকবিহীন বিয়ে পড়ানোর রেওয়াজ থাকলেও এবার বিশ্ব ইজতেমার অন্যতম আকর্ষণ যৌতুক বিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।
তাশকিলের কামরা স্থাপন: ইজতেমার প্যান্ডেলের উত্তর-পশ্চিমে তাশকিলের কামরা স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন খিত্তা থেকে বিভিন্ন মেয়াদে চিল্লায় অংশগ্রহণেচ্ছু মুসল্লিদের এ কামরায় আনা হচ্ছে এবং তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। পরে কাকরাইলের মসজিদের তাবলীগী মুরুব্বীদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলাকা ভাগ করে তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাবলীগী কাজে পাঠনো হবে।
আখেরী মোনাজাতের প্রস্তুতি
আজ প্রথম পর্বের আখেরী মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মুসল্লিদের ঢল অব্যাহত থাকবে। ইতোমধ্যে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের আগমনে ইজতেমা ময়দান পূর্ণ হয়ে গেছে। মূল প্যান্ডেলে স্থান না পেয়ে অনেক মুসল্লি নিজ উদ্যোগেই প্যান্ডেলের বাইরে পলিথিন সিট ও কাপড়ের সামিয়ানা টানিয়ে তাতেই অবস্থান নিয়েছেন। রোববার হেদায়তি বয়ান ও আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমার তিন দিনের প্রথম পর্ব। আগামী শুক্রবার শুরু হবে তিন দিনের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব।
আখেরী মোনাজাতে অংশগ্রহণ সহজতর করার লক্ষ্যে জেলা তথ্য অফিস ও গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের উদ্যোগে চেরাগ আলী মার্কেট থেকে উত্তরা আব্দুল্লাপুর পর্যন্ত মহাসড়ক ব্যতীত শাখা সড়ক ও অলিগলিতে মাইক সংযোগ-এর ব্যবস্থা করেছে। এছাড়া ইজতেমা মাঠের কন্ট্রোল রুমের আশপাশের এলাকা, মন্নু রোড, স্টেশন রোড, বাটা ফ্যাক্টরির অভ্যন্তর, হোন্ডা ফ্যাক্টরির অভ্যন্তর, টেলিফোন শিল্প সংস্থার মাঠের পুলিশ কন্ট্রোল রুম এলাকাসহ ১৫টি পয়েন্টে মাইক সংযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা গণযোগাযোগ অধিদপ্তর উত্তরা আবদুল্লাপুরসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মাইক সংযোগের ব্যবস্থা করেছে বলে জানিয়েছেন জেলা তথ্য অফিসার এস এম রাহাত হাসনাত।
মুসল্লিদের দুর্ভোগ:
গত কয়েকদিন ধরে রাতে তীব্র শীত অনুভূত হওয়ায় ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে। বিশেষত, বয়স্ক মুসল্লিদের ওজু, গোসল ও পয়ঃপ্রণালী কার্য স¤পাদনের সমস্যায় পড়তে হয়। এদিকে লাখ লাখ মানুষের পদধূলি আর অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে ধুলোয় ছেয়ে গেছে ইজতেমা এলাকা আর টঙ্গীর রাস্তাঘাট।
হাসপাতালে ভর্তি ৪৬ মুসল্লি:
ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের মধ্যে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত দুই দিনে মোট ৪৬ জনকে টঙ্গী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে ৯৫০ জনকে। গুরুতর অসুস্থ ১২ জনকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়।
টঙ্গী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মোঃ পারভেজ হোসেন জানান, অসুস্থ মুসল্লিদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে টঙ্গী হাসপাতালের বার্ণ ইউনিট, হৃদরোগ ইউনিট, চক্ষু ইউনিট, অর্থপেডিক ইউনিট, সার্জারি ইউনিটের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রেখেছেন।
ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প :
এবারের বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের স্বাস্থ্য সেবা দিতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করছে। এবার অর্ধশতাধিক স্বেচ্ছাসেবী, সরকারি ও বেসরকারী সংস্থা স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করছে বলে জানাগেছে। মন্নুনগর এলাকায় হামদর্দ ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্প ছাড়াও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, গাজীপুর সিভিল সার্জন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ছাড়াও টঙ্গী ওষুধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি এমএ লতিফের নেতৃত্বে একটি মেডিক্যাল টিম ময়দানের মুসল্লিদের ফ্রি চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রেখেছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, চিকিৎসা নিতে আসা মুসল্লিদের অধিকাংশই জ্বর, ঠান্ডা, পেটের পীড়াজনিত রোগে আক্রান্ত।
ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা
ইজতেমা সূত্র জানায়, প্রথম পর্বের আখেরী মোনাজাতে আজ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী-কালিগঞ্জ সড়ক, দুপুর পর্যন্ত যানচলাচল বন্ধ থাকবে। এছাড়া যানচলাচল বন্ধের কারণে টঙ্গী ও আশপাশের এলাকায় কলকারখনার মালিক কর্তৃপক্ষ বিশ্ব ইজতেমার জন্য ১ দিন কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিক যাতে করে আখেরী মোনাজাতে শরীক হতে পারে সে জন্য এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
পকেটমার ও হকার আটক :
টঙ্গী থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার জানান, বিশ্ব ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের এলাকা থেকে মুসল্লিদের ব্যাগ টানা, পকেটকাটাসহ বিভিন্ন অপরাধে গত শনিবার পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪ জনকে গাজীপুর আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি :
বিশ্ব ইজতেমাকে ঘিরে টঙ্গীর বিশাল এলাকা পরিণত হয়েছে কাঁচা বাজারে। এসব বাজারে জিনিসপত্রের দাম অনেক চড়া। চাল-ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ইজতেমায় আগত মুসল্লিরা এক প্রকার বাধ্য হয়েই এসব জিনিসপত্র কিনছেন।
ভ্রাম্যমাণ আদালত :
গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও ইজতেমা মাঠে স্থাপিত জেলা প্রশাসকের কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রাহেনুল ইসলাম জানান, শনিবার পর্যন্ত ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত ইজতেমা ময়দানের আশপাশে গড়েওঠা অবৈধ দোকানপাট ও রেষ্টুরেন্টে অভিযান চালিয়ে ৩৬টি প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে।
৭ মুসল্লির মৃত্যু:
বিশ্ব ইজতেমায় শনিবার ভোরে আরো এক মুসল্লি ইন্তেকাল করেছেন। মরহুম তারা মিয়া (৬৫) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের জগতৃষা গ্রামের বাসিন্দা। এ নিয়ে ইজতেমায় সাত মুসল্লি ইন্তেকাল করলেন। মরহুমদের মধ্যে রয়েছেন, কক্সবাজার জেলার নেকনাথ থানার মধ্যম নীলা গ্রামের হোসেন আলী (৬৫), ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার খারুয়া গ্রামের ফজলুল হক (৫৬), সাতক্ষীরা জেলা সদরের বিলের পোতা গ্রাামের আব্দুস সাত্তার (৬০), টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার নিজবনি পাড়ার জানু ফকির (৭০), মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার বাগবাড়ী শিমুলিয়া গ্রামের সাহেব আলী (৬৫) এবং ফেনীর দাগন ভূইয়া উপজেলার মাছিমপুর গ্রামের বাবুল মিয়া (৬০)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন