শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

দ্বীনের দাওয়াত ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার প্রত্যয়ে শেষ হলো এবারের বিশ্ব ইজতেমা

বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের হেফাজত কামনায় আখেরী মোনাজাত

| প্রকাশের সময় : ২৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মো. দেলোয়ার হোসেন ও মো. হেদায়েত উল্লাহ : দ্বীনের দাওয়াত ঘরে ঘরে তথা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তরে পৌঁছে দেয়ার প্রত্যয়ে শেষ হয়েছে তিনদিন করে দুই ধাপে ৬ দিনের বিশ্ব ইজতেমা। এবার ৫২তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম ধাপের চেয়ে দ্বিতীয় ধাপের আখেরী মোনাজাতে মুসলিমদের অংশ গ্রহণ ছিল বেশি। আখেরী মোনাজাতের আগে তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বী ভারতের মাওলানা মুহাম্মদ সা’দ তাঁর সমাপনী বয়ানে সাহাবা কেরামের তরিকায় মসজিদ কেন্দ্রিক দাওয়াতী কার্যক্রম জোরদার করার আহবান জানিয়ে সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বয়ান করেন। তিনি বলেন, হুজুর পাক (সা.) এর জামানায় মসজিদ আবাদের যে পরিবেশ ছিল সেই পরিবেশ চালু হলে সমাজ থেকে বাতেলের আসর (প্রভাব) খতম হয়ে যাবে। সেই সময় কোন মুসলমান নামাজ ছেড়ে দেবে তা কল্পনাও করা হতো না। বরং কাফের-মুশরিকদের দাওয়াত দেয়া হতো এই শর্তে যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই’ এই কথা বিশ্বাস করার পর তাকে নিয়মিত নামাজ পড়তে হবে, যাকাত দিতে হবে এবং মহান আল্লাহর অন্যান্য হুকুম পালন করতে হবে। কিন্তু লজ্জাজনক হলেও সত্য যে, আজ মুসলমানদেরকে নামাজের দাওয়াত দিতে হচ্ছে।
মাওলানা সা’দ মসজিদ কেন্দ্রিক দাওয়াতী কার্যক্রমের বিভিন্ন দিক নির্দেশনামূলক দীর্ঘ সমাপনী বয়ান শেষে দরুদ শরিফ পড়ে সকাল ১১টা ১২মিনিটে আখেরী মোনাজাত শুরু করেন। তাঁর কান্নাজড়িত এই আখেরী মোনাজাত চলাকালে ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় আবেগঘন পরিবেশের তৈরি হয়।
নীরব নিস্তব্ধতা নেমে আসে গোটা এলাকায়। মাঝে মধ্যে এই নীরবতা ভেঙে ‘আমিন; আল্লাহুম্মা আমিন; ছুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে মুখরিত প্রকম্পিত হয়ে উঠে ইজতেমা ময়দান। বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে শেষ হয় আখেরী মোনাজাত। দরুদ শরিফের পর তিনি কালামে পাকের দোয়ার আয়াতগুলো দিয়ে মোনাজাত শুরু করেন। দীর্ঘ প্রায় ৩৩ মিনিটের মোনাজাতের প্রথম প্রায় ১৫ মিনিট তিনি কালামে পাকের বেশ কিছু দোয়ার আয়াত উচ্চারণ করেন পাশাপাশি আরবিতে পরওয়ারদিগারের কাছে ফরিয়াদ জানান।
এরপর মোনাজাতের বাকি অংশে তিনি উর্দু ভাষায় মহান আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে আকুতি জানান। আরবিতে মোনাজাত চলাকালে তিনি সূরা বাক্কারার শেষাংশের দোয়ার আয়াতের একাংশ (ফান্সুরনা আলাল কাফিরিন অর্থাৎ কাফেরদের মোকাবেলায় তুমি আমাদের সাহায্য করো) একাধিকবার উচ্চারণ করেন। এছাড়া তিনি বলেন, ‘হে প্রভু ! আপনি সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাশীল। আমাদের তাওবা কবুল করুন। মুসলমানদের হেফাজত করুন।’ উর্দুতে মোনাজাতকালে তিনি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে দুনিয়া থেকে শিরক ও বিদআতের খতম কামনা করেন। দ্বীনের হিজরত ও মেহনতকে কবুল করার আকুতি জানান। বনি আদমের হেদায়েত, উম্মতে মুহাম্মদির জান-মাল হেফাজত, সকল বেমারি থেকে আরোগ্য, সিরাতুল মুস্তাকিম ও ইবাদতে ইখলাস নসিব কামনা করেন। ইহ ও পারলৌকিক মুক্তি, দ্বীনের দাওয়াত ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার তৌফিক কামনা এবং তাবলীগের মেহনত ও ইজতেমাকে কবুল করার আকুতি জানিয়ে আখেরী মোনাজাত শেষ করেন।
উপমহাদেশের শীর্ষ বুজুর্গ মাওলানা সা’দ সাহেবের মোনাজাত চলাকালে সুবিশাল ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। মোনাজাতে তিনি মহান রাব্বুল ইজ্জতের কাছে যখন কিছু কামনায় আকুতি জানান; তখনই সাথে সাথে ময়দান কেঁপে লাখো কণ্ঠে আওয়াজ উঠে ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন, ছুম্মা আমিন’। পিনপতন নীরবতা ভঙ্গ করে মুসলিমদের সমস্বরে আমিন ধ্বনি ও কান্নার আওয়াজে ইজতেমা ময়দানে নেমে আসে এক ভাবগম্ভীর ও আবেগঘন পরিবেশের। আখেরী মোনাজাতকে কেন্দ্র করে গতকাল ইজতেমা ময়দান ও চারপাশের এলাকা এক বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে শনিবার সন্ধ্যা থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে ইজতেমা অভিমুখে মুসল্লীরা আসতে শুরু করেন। ফলে টঙ্গী যেন সকল পথের মোহনায় পরিণত হয়। আখেরী মোনাজাত উপলক্ষে শনিবার রাত ৩টা থেকেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের রাজধানীর কুড়িল বিশ্ব রোড থেকে গাজীপুর ভোগড়া চৌরাস্তা, টঙ্গী-আশুলিয়া রোডের বাইমাইল ও টঙ্গী-কালীগঞ্জ-নরসিংদী রোডের মিরের বাজার পর্যন্ত যানচলাচল বন্ধ করে দেয় প্রশাসন।
আবেগঘন আখেরী মোনাজাতে লাখো কন্ঠে উচ্চারিত  হয়েছে  রাহমানুর রহীম আল্লাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। আমীর-ফকির, ধনী-গরীব, নেতা-কর্মী নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশা-গোষ্ঠীর মানুষ পরওয়ারদেগার আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। মুঠোফোন, রেডিও এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে দেশ-বিদেশেরও লাখ লাখ মানুষ এক সঙ্গে হাত তুলেছেন পরওয়ারদিগারের শাহী দরবারে।
মুসল্লিদের বাড়ি ফেরায় চরম দুর্ভোগ ঃ মোনাজাত শেষে লাখো মুসল্লি তাদের নিজস্ব গন্তব্যে যেতে যানবাহন সংঙ্কটে পড়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হন। মোনাজাত শেষে লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমা ময়দান থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে স্রোতের মতো এক সাথে ফিরতে শুরু করলে এক পর্যায়ে ময়দানের চতুর্দিকে ৬/৭ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকায় তীব্র জনজটের সৃষ্টি হয়। এসব এলাকার সকল রাস্তায় এক পর্যায়ে মুসল্লিদের বাড়ি ফেরার কাফেলায় পরিণত হয়। এ সময় রাস্তায় কোন যানবাহন চলাচল করতে পারেনি। এক পর্যায়ে সকল রাস্তাই মুসল্লিদের বাড়ি ফেরার রাস্তায় পরিণত হয়। এদিকে ভোর হতে টঙ্গী-চৌরাস্তা পর্যন্ত ৭/৮ কিলোমিটার ও টঙ্গী থেকে পূবাইল পর্যন্ত ৪/৫ কিলোমিটার, টঙ্গী-আব্দুল্লাহপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ৫/৬ কিলোমিটার, টঙ্গী থেকে আশুলিয়া সড়কের ৫/৬ কিলোমিটার পর্যন্ত ইজতেমামুখী সকল যানবাহন চলাচল মুসল্লিদের মোনাজাত শেষে বাড়ি ফেরার জন্য বন্ধ রাখা হয়। এতে মুসল্লিরা পায়ে হেঁটেই ওই সকল দূরত্বের পথ পাড়ি দিয়ে মোনাজাত শেষে যে যার গন্তব্যে রওয়ানা দিয়েছেন।  
মহিলাদের অংশগ্রহণ ঃ দ্বিতীয় পর্বের আখেরী মোনাজাতেও অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা কয়েক হাজার মহিলা মুসল্লিকেও ইজতেমা ময়দানের আশেপাশে, বিভিন্ন মিল-কারখানা, বাসা-বাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাদে বসে আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা যায়।  
টিভি চ্যানেল ও মোবাইলের মাধ্যমে মোনাজাত ঃ
আখেরী মোনাজাতের সময় বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও মোবাইল, ওয়ারলেস সেটের মাধ্যমে লাখ লাখ নারী-পুরুষ, ও শিশু টিভির সামনে বসে মোনাজাতে অংশ নেন।
এবারও ১০ কি.মি. জুড়ে মানব বলয় ঃ
দ্বিতীয় পর্বের তিন দিনব্যাপী ৫২তম বিশ্ব ইজতেমার শেষ দিন রোববার ভোর থেকেই আখেরি মোনাজাতে শামিল হতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ রাজধানী ঢাকা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো থেকে ট্রেন, বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, জিপ, কার এবং নৌকাসহ নানা ধরনের যানবাহনে এবং পায়ে হেঁটেই ইজতেমা ময়দানে পৌঁছেন। সকাল থেকেই দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে ইজতেমা অভিমুখে ছুটতে থাকে মুসল্লীদের কাফেলা। এতে তুরাগের তীরকে কেন্দ্র করে কয়েক বর্গকিলোমিটার জুড়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশাল মানব বলয় সৃষ্টি হয়। মোনাজাত শুরুর আগেই সকাল থেকেই ভিড় ঠেলে মুসল্লীরা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় তুরাগ তীরের পুরো ইজতেমাস্থল ও চারপাশের প্রায় ৬/৭ বর্গ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকা। এতে গোটা এলাকা পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে।
১০ মুসল্লীর মৃত্যু ঃ
বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে আসা মুসল্লিদের মধ্যে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৬ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। সকাল ৯টার দিকে বাবুল মিয়া (৬০) নামে এক মুসল্লি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তিনি ফেনীর দাগনভূইয়া উপজেলার মাছিমপুর গ্রামের আ. রশিদের ছেলে।
এর আগে বুধবার দিবাগত রাতে কক্সবাজারের মোঃ হোসেন আলী (৬৫), বৃহস্পতিবার সকালে ময়মনসিংহের নান্দাইলের মারুয়া গ্রামের মৃত আহম্মদ আলীর ছেলে মোঃ ফজলুল হক (৫৬), বিকেলে সাতক্ষীরা জেলা সদরের খেজুরডাঙ্গা এলাকার মৃত আব্দুস সোবাহানের ছেলে আব্দুস সাত্তার (৬০), সন্ধ্যায় টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার নিজবন্নী এলাকার মোঃ জানু ফকির (৭০), রাতে মানিকগঞ্জের সাহেব আলী (৩৫) মারা যান। বি. বাড়িয়ার সদরের মৃত হাসান মিয়ার ছেলে তারা মিয়া (৬৫) মারা যান। তারা সবাই বার্ধক্যজনিত কারণে এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. পারভেজ জানান।
বৃহস্পতিবার রাতে সিলেটের গোপালগঞ্জ উপজেলার রনকালি এলাকার জয়নাল আবেদীন (৫৫), কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার চকলাপাড় গ্রামের নূরুল ইসলাম (৭২) ও নাটোরের সিংড়া উপজেলার বটিয়া গ্রামের ফরিদ উদ্দিন (৬৫) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, কিশোরগঞ্জের আব্দুর রহমান (৬৫)।
২০১৮ সালের বিশ্ব ইজতেমা ১২ জানুয়ারী ঃ
ইজতেমা মাঠের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বী ইঞ্জিনিয়ার মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, আগামী বছর বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারী। ২০১৮ সালেও দুই পর্বে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম পর্ব শুরু হবে ১২ জানুয়ারী ২০১৮। আর এ পর্বের আখেরি মোনাজাত হবে ১৪ জানুয়ারী। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে ১৯ জানুয়ারী এবং আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে ২১ জানুয়ারী। এ ছাড়া ২০১৭ সালের জোড় ইজতেমা ১৭ নভেম্বর ৫ দিনব্যাপী টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানেই অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান ইজতেমা মাঠের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বি ইঞ্জিনিয়ার মো. গিয়াস উদ্দিন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
গোলাম কিবরিয়া ২৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১১:৩৪ এএম says : 0
আমাদের সকলের উচিত দ্বীনের আমল করা।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন