জামালউদ্দিন বারী : রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিবাদে তেল, গ্যাস, বন্দর ও জাতীয় সম্পদ রক্ষাকমিটির আহ্বানে অর্ধদিবস হরতাল চলাকালে ঢাকার শাহবাগে পিকেটিংয়ের সময় পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপের ছবি তোলার সময় দুই সাংবাদিককে পিটিয়ে আহত করেছে পুলিশ। খবরের এটুকুতে কোনো নতুনত্ব নেই। দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকদের মাঝেমধ্যেই পুলিশের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে দেখা যায়। অতি উৎসাহী দলবাজ পুলিশ সদস্য যেমন রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর, একইভাবে কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শে অন্ধ বা দলকানা সাংবাদিকতাও রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য সমান অনিষ্টকর। জনগণের প্রত্যাশা হচ্ছে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, সামাজিক-রাজনৈতিক ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে পুলিশ ও গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ ভ‚মিকা। আইন ও মানবাধিকারের সাধারণ নীতিমালা মান্য করে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তম্ভ, সেক্টর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় পাশাপাশি ও সম্পূরকভাবে কাজ করার মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রের বিকাশ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রত্যাশিত সুফল নিশ্চিত করা সম্ভব। দেশের সংবিধান, সরকারব্যবস্থা, রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইত্যাদি সবই দেশের জনগণের স্বার্থে এবং জনগণের সম্পদে পরিচালিত ও প্রতিপালিত হয়। বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কাজে সমন্বয় স্থাপনের মূল দায়িত্ব জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারকে পালন করতে হয়। সরকার যখন কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের দ্বারা প্রভাবিত বা পক্ষপাতপুষ্ট হয়ে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে, তখন সেটা একটি অস্বাস্থ্যকর এবং ভারসাম্যহীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সরকারব্যবস্থাকেই নির্দেশ করে। সারাবিশ্বেই রাজনীতিতে এক ধরনের অবক্ষয় ও ভারসাম্যহীনতার পূর্বাভাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্ট প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হওয়ার পর দায়িত্ব গ্রহণের সাথে সাথেই সাংবাদিকদের সবচেয়ে অসৎ বলে মন্তব্য করেছেন যা মার্কিনিদের গণতন্ত্রের ইতিহাসে নজিরবিহিন। তবে সেখানকার প্রতিষ্ঠিত নির্বাচন ব্যবস্থায় নির্বাচিত হওয়ার পর নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ বিক্ষোভ করে রাজপথে নেমে আসার পরও সেখানকার কোনো নাগরিক টিয়ারশেল, রাবার বুলেট বা রাজনৈতিক মামলার সম্মুখীন হননি। ওখানে পুলিশের কাছে প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক লিগ্যাসির চাইতে জনগণের প্রতিবাদ করার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার মূল্যবোধ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, জনগণের রায়ের প্রতি শাসকশ্রেণির আস্থা এবং নিরপেক্ষতা না থাকলে তারা গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে রাষ্ট্র ও সরকারকে পুলিশনির্ভর করে তুলতে শুরু করে। কোন দেশে নাগরিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে পুলিশ যদি জনগণের আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে এবং আইনগত প্রক্রিয়ায় একবার প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে বা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তবে তাকে কায়েমি স্বার্থে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। এর ব্যতিক্রম বাস্তবায়ন বর্ণবাদ, মিথ্যা দেশপ্রেমের সস্তা জাতীয়তাবাদী সেøাগান ও প্রোপাগান্ডার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো একটি পক্ষে কাজে লাগানোর জন্য হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। নাইন-ইলেভেনের পর সন্ত্রাস ও জননিরাপত্তার কথা বলে পশ্চিমাবিশ্বের নাগরিক অধিকার হরণের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের মধ্যে নতুন বৈষম্যনীতি আরোপ করা হয়েছে। এ কারণে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের গুলিতে বিনা উস্কানিতে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক হত্যার ঘটনা যেমন বেড়েছে। তারই সাথে পাল্লা দিয়ে পশ্চিমা সমাজে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতাও বেড়েই চলেছে।
ঢাকায় পুলিশের হাতে সাংবাদিক আহত হওয়ার ভিডিও চিত্র, টিভি চ্যানেল ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর সাংবাদিকরা যখন এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য জানতে চাইলেন, তিনি বললেন পুলিশ কখনও সাংবাদিকদের পিটায় না, মাঝেমধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়। পুলিশের ডেলিবারেট অ্যাকশনে সাংবাদিক আহত হওয়ার সচিত্র খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনাটিকে পুলিশের সাথে সাংবাদিকদের ‘ধাক্কাধাক্কি’ বলছেন। পরে অবশ্য তিনি বিষয়টি জানতেন না বলে স্বীকার করে নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। রাজধানীতে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনকালে পুলিশের হাতে বা পুলিশের অ্যাকশনে সাংবাদিক বা রাজনৈতিক কর্মী আহত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে যদি তা না জানানো হয় তা জনগণের কাছে ভিন্ন বার্তা বহন করতে পারে। আমরা সে বিষয়ে আলোচনায় যাব না। ব্যঙ্গ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনেকে পুলিশ মন্ত্রীও বলেন। মোটা দাগে প্রশ্ন আসে তিনি পুলিশের স্বার্থ দেখবেন নাকি, যে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন তাদের স্বার্থ দেখবেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশের আইনশৃঙ্খলা এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় পুলিশকে কাজে লাগানোর দায়িত্ব পালন করেন। আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এ দেশের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করার হকদার, একইভাবে পুলিশ, আইন ও অধ্যাদেশ অনুসারেও তারা বিশেষ অধিকার ভোগ করে থাকে। তবে সরকার এবং রাষ্ট্রযন্ত্র পুলিশের হাতে এমন ক্ষমতা বা অধিকার দিতে পারে না যা’ তাদেরকে সাধারণ নাগরিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা হরণের মতো কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ অবারিত করে দেয়। এ ক্ষেত্রে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনপ্রত্যাশা ও পুলিশ বাহিনীর কর্মকান্ডের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে। সম্ভবত এটাই হচ্ছে একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পলিটিক্যাল এন্ড ইথিক্যাল রুলস অব বিজনেস। কিন্তু আমাদের দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা পুলিশকে একটি জনবান্ধব বাহিনীতে পরিণত করার রাজনৈতিক ও আইনগত উদ্যোগ গ্রহণের বদলে এই বাহিনীর প্রতি একধরনের একপেশে অবস্থান গ্রহনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন কেন? বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ আগে সাম্প্রতিক সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী সকলেই রাজনৈতিক, পেশাগত জীবনে দক্ষ ও বিচক্ষণ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তারা যেন একেকটি ভিন্ন চরিত্র হিসেবে আবিভর্‚ত হন। এ ক্ষেত্রে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি আমলের মধ্যে পার্থক্য খুব বেশি নয়। আততায়ীর গুলিতে মায়ের কোলে শিশু নিহত হওয়ার পর ‘আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে গেছে’ বলে সান্ত¡না দিয়ে, ‘লুকিং ফর শত্রæজ’ বলে, ‘ঠেলাঠেলি-নাড়াচাড়া’ করে রানাপ্লাজা ভবন ফেলে দেয়া, সাগর-রুনি হত্যাকারীদের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে খুঁজে বের করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২৪ মাসেও কোনো ক্লু উদ্ধারেও ব্যর্থ হওয়া, বা পুলিশের সাথে সাংবাদিকদের ‘ধাক্কাধাক্কি’র মত উপমাগুলো লোক সমাজে শুধু হাস্যরসেরই জন্ম দেয়নি, পাশাপাশি এ থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন ধারণারও জন্ম হতে পারে যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা বুঝি এমনই হয়। তবে এই ধারণা কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। দেশের আইনশৃঙ্খলা, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও প্রত্যাশার মাঝখানে যদি সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বার্থের প্রশ্নে অস্বচ্ছতা, ব্যবধান বা গ্যাপ তৈরি হয়, সেখানে পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা ছাড়া হয়তো সরকারের কোনো গত্যন্তর থাকে না। পুলিশ বাহিনীকে সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সম্ভবত এটাই হচ্ছে প্রধান অন্তরায়।
রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে সরকার বা নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়াই গণতন্ত্র ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল অন্তরায়। দেশের আইনি ও সাংবিধানিক পরিকাঠামো যেমন থাক, সরকার বিরোধী দল তথা শাসকশ্রেণির মধ্যে ন্যূনতম সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধ, সততা ও ডিগনিটি থাকলে প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক স্বাতন্ত্র ও সক্ষমতা অক্ষুণœ থাকতে পারে। সঠিক দায়িত্বে বা কাজে যোগ্যতর ব্যক্তিটিকে সুযোগ না দিলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনগণের আস্থা ও স্বার্থের পরিপূরক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বর্তমানে রাজনীতি নাকি ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকে গেছে। আমাদের আইন বিভাগ বা বর্তমান জাতীয় সংসদের বেশিরভাগ সদস্যই জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নন। এদের মধ্যেও আবার বেশিরভাগই মূলত ব্যবসায়ী শ্রেণির অন্তর্গত। এরা রাজনীতি ও নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা লগ্নি করেন রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে। বিগত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি প্রথম থেকেই একপাক্ষিক হওয়ার পরও সংসদ সচিবালয় ও নির্বাচন কমিশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দশম জাতীয় সংসদের সদস্যদের মধ্যে কাগজে-কলমে শতকরা ৬৯ ভাগ নিজেদের ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচয় দিলেও পরোক্ষভাবে এদের শতকরা ৯০ ভাগই ব্যবসায়ী ও কোটিপতি। সংখ্যার হিসাবে ৩০০ সংসদ সদস্যের মধ্যে ২১৮ জন ব্যবসায়ী, ৪৮ জন আইনজীবী এবং ২২ জন পেশাদার রাজনীতিবিদ। অথচ চরম পুঁজিবাদী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ব্যবসায়ীর সংখ্যা শতকরা ৩৮ ভাগ, ব্রিটেনে শতকরা ২৫ ভাগ এবং ভারতে ২০ ভাগ। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে যতই দিন যাচ্ছে রাজনীতিতে ব্যবসায়ী কোটিপতিদের দাপটে পেশাজীবী রাজনীতিকরা হারিয়ে গেছেন। একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৯৫৪ সালের জাতীয় সংসদে নির্বাচিতদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ছিল শতকরা ৪ শতাংশ মাত্র। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ সংখ্যা দাঁড়ায় শতকরা ১৫ ভাগে। অবশ্য একজন ব্যবসায়ীর রাজনীতিতে যোগ দেয়া বা রাজনীতিবিদ হওয়ার মধ্যে কোনো আইনগত বা নৈতিক বাধা থাকার কথা নয়। এ প্রশ্ন তখনই উঠছে, যখন দেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে বিত্তের ক্ষুধা মহামারি রূপে আবিভর্‚ত হয়ে ব্যাপক লুটপাট ও দুর্বৃত্তায়ণ ঘটে গেছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এমপি পদের জন্য কোটি কোটি টাকায় টিকেট বিক্রি করা শুরু করেছে এবং একশ্রেণির ব্যবসায়ী দলীয় ফান্ডে কোটি কোটি টাকা দিয়ে নমিনেশন নিশ্চিত করার পর ভোটের মাঠ ও রাজনীতিকে নিজের পক্ষে রাখতে আরো কোটি কোটি টাকা খরচ করেছেন। সংসদ সদস্য হয়ে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া এসব ব্যবসায়ীর বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলে থাকলে নানাভাবে কমিশন বাণিজ্য ও লুটপাটে লিপ্ত হয়ে সুদে আসলে পুষিয়ে নিচ্ছেন। আর বিরোধী দলে থাকলে সরকারি দলের সাথে আপস ও গোপন সন্ধি করে ব্যবসায়িক পুঁজি টিকিয়ে রাখার পন্থা গ্রহণ করে থাকেন বলে অভিযোগ আছে। বিশেষত সরকার বিরোধী রাজনীতির পথ কখনই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, এখনো নেই। মিথ্যা মামলা, পুলিশি নির্যাতন ও হয়রানির পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্তে¡ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির আন্দোলনে সফল না হওয়ার পেছনে মধ্য ও শীর্ষ সারির বেশিরভাগ নেতার নিষ্ক্রিয়তার জন্য তাদের সম্পদ রক্ষা ও ব্যবসায়িক স্বার্থে গোপন সমঝোতার অভিযোগ করেন তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, তাকে ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাকেই টাকা দিয়ে কেনা যায়। অর্থাৎ সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধহীন ধনলিপ্সু ও অসাধু ব্যবসায়ীরা আমাদের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ণ ঘটিয়েছেন এবং আস্থার সংকট তৈরি করেছেন।
এ মুহূর্তে দেশের রাজনীতির প্রধান আলোচ্য বিষয় আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্ভাব্য নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে গত ডিসেম্বর মাসে ১৩ দফা সুপারিশমালা উপস্থাপন করার পর রাষ্ট্রপতির সংলাপের আহ্বানের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর মধ্যে যে নতুন আশাবাদ তৈরি হয়েছিল, ৬ সদস্যবিশিষ্ট সার্চ কমিটির নাম প্রকাশিত হওয়ার পর মানুষের মধ্যে প্রাথমিক আশাভঙ্গের হতাশা দেখা দিয়েছে। সার্চ কমিটি ৩১টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ৫ জনের সম্ভাব্য নামের তালিকা চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে বিশিষ্ট কিছু নাগরিকের সঙ্গে মতামত বিনিময় করেছে। দলনিরপেক্ষ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন এই মুহূর্তে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মূল দাবি হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের গ্যারান্টি দিতে পারছে না। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন কমিশন গঠনের এখতিয়ার দেয়া হলেও সংবিধানের মূল স্পিরিট হচ্ছে এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা। স্বাধীনতার সাড়ে চারদশক পেরিয়ে এসেও দেশে নির্বাচন কমিশন গঠন, কর্তৃত্ব ও দায়-দায়িত্ব সম্পর্কিত আইন না হওয়া বিস্ময়কর। এখন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদের মধ্যে নির্বাচন কমিশন আইন করার সময় না থাকলেও গত সোমবার মহামান্য হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ থেকে নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নে সরকারকে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না মর্মে একটি রুল জারি করে আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাইকোর্টের একজন আইনজীবীর রিট পিটিশনের শুনানি শেষে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এবং বিচারপতি জেবিএম হাসানের বেঞ্চ এই আদেশ দিয়েছেন। এবারের নির্বাচন কমিশনে যারাই আসুন, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সকলের অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রকৃতিই হবে প্রধান ফ্যাক্টর।
একদিকে প্রধানমন্ত্রী আগামীতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন, অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা সংবিধান অনুসারে শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়ে চলেছেন। সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করতে এবং হারতে বাধ্য হবে বলেও তারা জোর গলায় দাবি করছেন। ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অধীনে, নিজেদের বশংবদ নির্বাচন কমিশন, সিভিল প্রশাসন, পুলিশবাহিনী দিয়ে নির্বাচন করিয়ে সম্ভবত আগেই বিজয় নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিকদল জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে বিএনপির নিবন্ধনও বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন আইনগত মারপ্যাচে ফেলে বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করার রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করতে পারে সরকার। তবে আগামী নির্বাচনের মান ও গ্রহণযোগ্যতার ওপর দেশের অনেক কিছুই নির্ভর করছে। নির্বাচনকালীন সরকারের সদিচ্ছা ও নিরপেক্ষতার পাশাপাশি বিচার বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আইনগত এবং পেশাগত নিরপেক্ষতা বজায় রেখে নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ দেয়া হলে নির্বাচন কমিশন ছাড়াও জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটে, এমন নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসেই এর একাধিক প্রমাণ আছে। কোনো নির্বাচন কমিশন ছাড়াই ১৯৫৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছিল। আবার ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রে এবং বাংলাদেশে সামরিক শাসন বলবৎ থাকার মধ্যেই সেনাবাহিনীর অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শাসকদলের চরম পরাজয় ঘটেছিল। অবশ্য সে নির্বাচনে একদিকে নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সততা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার যেমন বিশেষ ভ‚মিকা ছিল, সেই সাথে সেনাবাহিনী কেন্দ্র শাসিত হলেও সেনাবাহিনীর দলনিরপেক্ষ ভ‚মিকা নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন নিশ্চিত করেছিল এবং এ দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। তবে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা করলেও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় এমন কোন ক‚টকৌশল গ্রহণ করেনি। নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা এবং নির্বাচনের সময় সকল রাজনৈতিক দলের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম নিরপেক্ষ ভ‚মিকা পালন করলে এখনো একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনমতের প্রতিফলন এবং ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর নিশ্চিত করা অসম্ভব নয়। যে বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনের ম্যান্ডেটকে প্রতিষ্ঠিত করার পথ ধরেই লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরে আমরা যদি আবারো একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন করতে ব্যর্থ হই, এই ব্যর্থতা জাতির এ যাবৎ সকল অর্জনকে মøান করে দিতে পারে।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন