বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মহানগর

নাব্য সঙ্কটে ক্ষতির মুখে ব্যবসায়ীরা

মৃতপ্রায় বুড়িগঙ্গা-তুরাগ

| প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : অপরিকল্পিত ড্রেজিং, দখলদারদের ছোবল ও অবৈধ স্থাপনায় মৃতপ্রায় রাজধানীর সঙ্গে নদী পথে যোগাযোগ ও ব্যবসার অন্যতম মাধ্যম বুড়িগঙ্গা-তুরাগ নদী। নাব্য সঙ্কটে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে নদীটি। দীর্ঘদিন থেকে ‘এই চালু, এই বন্ধ’ এভাবেই চলছে ওয়াটার বাস ও বাল্ক হেড/নৌযান চলাচল। সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, নদীতে দু’একটি ছোট নৌ-যান চলাচল করলেও তা খুবই সীমিত। একই সঙ্গে জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে বিপাকে পড়েছে সিন্নিরটেক, আশুলিয়া, গাবতলী ল্যান্ডিং স্টেশনসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার ব্যবসায়ীরা। এই এলাকার ব্যবসায়ীদের মতে, নদী পথে রাজধানীর সঙ্গে ব্যবসার অন্যতম মাধ্যম এই নদী। অথচ অপরিকল্পিত ড্রেজিং, নদী ভরাট করে দখল ও অবৈধ স্থাপনায় মৃতপ্রায় নদীটি। বর্তমানে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাদের মতে, সম্ভাবনাময় এ খাত থেকে সরকার রাজস্ব পেলেও তা খুবই কম। সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোলে এখান থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেতে পারে।
সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প হিসেবে রয়েছে ঢাকা মহানগরীর চারপাশের নদীগুলো পূনরুদ্ধার, সার্কুলার নৌ-রুট এবং সড়ক নির্মাণ (ইস্টার্ন বাইপাসসহ)। তারপরও এ কাজ গতি পাচ্ছে না। জানা যায়, বিভিন্ন সরকারের সময়ে বুড়িগঙ্গা-তুরাগ নদীর নাব্য ধরে রাখা, ড্রেজিং কার্যক্রম এবং নদীর দু’পাশের দখলদার উচ্ছেদে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়। কিন্তু সঠিক তদারকি ও পরিকল্পনার অভাবে তা কাজে আসেনি।
এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, বিএনপি সরকারের সময়ে ২০০২ সালে ঢাকার চারদিকের নদী পথকে গুরুত্ব দিয়ে নৌ-পথকে সচল করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ওই সময় যাত্রী চলাচলের জন্য ওয়াটার বাস প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। কিন্তু তা আর আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীতে বর্তমান সরকারের সময়ে সড়ক পথে চাপ কমাতে যাত্রী চলাচলের জন্য ওয়াটার বাস চালু করা হয়। অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান কয়েক দফায় ওয়াটার বাস চালু করে।
বিআইডবিøউটিএ’র পরিচালনায় ২০১০ সালের ২৮ আগস্ট ‘তুরাগ’ ও ‘বুড়িগঙ্গা’ নামে দুটি ওয়াটার বাস চালু হয়। দ্বিতীয় ধাপে চারটি এবং তৃতীয় ধাপে আরও ৬টি ওয়াটার বাস চালু করা হয়। কিন্তু নদীর নাব্য না থাকা এবং যাত্রী না পাওয়ায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিøউটিএ) প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার টাকা লোকসানে পড়ে। তাই একাধিকবার বন্ধ করে দিতে হয় এই প্রকল্প। এতে এলাকার ব্যবসা বাণিজ্যে পড়েছে ভাটা। সম্প্রতি বিআইডব্লিউটিএ বাল্কহেড চলাচলে নিষেধাজ্ঞা, উচ্ছেদ অভিযান ও নদীর নাব্যতা না থাকার কারণে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইজারা মূল্য মওকুফ করার আবেদন করেছে সূচনা সমবায় সমিতি লিমিটেড।
সরেজমিনে গাবতলী থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত পরিদর্শন করে দেখা যায়, নাব্য সঙ্কটে ওয়াটার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। আসছে না বড় কোন বলগেট বা নৌ-যান। বলতে গেলে ছোট ছোট নৌকা ও নৌ-যান ছাড়া অন্যন্য নৌ-যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে ছোট কয়েকটি বাল্কহেড চলাচল করলেও জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। নাব্য সঙ্কটের কারণে বালুবাহী বড় বাল্কহেডগুলো চলাচল একেবারেই বন্ধ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, অতি শীঘ্রই পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং না করানো হলে নৌ-যান চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে।
ইজারাদার প্রতিষ্ঠান সূচনা সমবায় সমিতি লি. সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ঈদুর ফেতর এবং ঈদুল আযহাতে কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার ফলে ৪০ দিন, শ্রমিক ধর্মঘটে ৫দিন, নৌ দুর্ঘটনায় চ্যানেল বন্ধ থাকায় ৬দিন, মোবাইল কোর্ট এবং উচ্ছেদ অভিযানের কারণে ৩৬দিন, ঘনকুয়াশার কারণে ৬দিন এবং নদীর নাব্যতা না থাকায় ২০দিনসহ মোট ১১৪ দিন বন্ধ ছিল বাল্কহেড চলাচল। এ সময়ে ইজারা এবং বেতন বাবদ বিশাল অঙ্কের অর্থের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে সমিতিকে।
এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাবতলী থেকে আশুলিয়া এলাকার নৌ-পথে সকল ধরনের ব্যবসা প্রায় বন্ধের পথে। নৌ-পথে এই এলাকার অন্যতম ব্যবসা ‘বালু ব্যবসা’। নাব্যসঙ্কটে নৌ-যান ঢুকতে না পারায় এই ব্যবসাও এখন বন্ধের পথে। ব্যবসায়ীদের মতে, নাব্যসঙ্কটে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ওই এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার (৪৫) জানান, দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় আছি। ৭/৮ বছর পূর্বে এই নদীর অবস্থা কিছুটা ভালো ছিলো। দিন যত গড়াচ্ছে আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদী। তিনি জানান, নাব্য না থাকায় ৬ ফুটের উপরের বড় বলগেট ঢুকতে পারে না। এছাড়াও অন্যান্য বড় নৌ-যানও আসছে না। তাই কিছুটা হলেও বিপাকে এই এলাকার ব্যবসায়ীরা।
সিন্নিরটেক-আশুলিয়া ল্যান্ডিং স্টেশনের ইজারা পাওয়া সূচনা সমবায় সমিতি লি.-এর সাধারণ সম্পাদক মুজিব সারোয়ার মাসুম বলেন, নাব্যসঙ্কটে নৌ-যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট ছোট কিছু নৌ-যান আসলেও পানি না থাকায় বড়গুলো আসতে পারছে না। এ কারণে আমাদের পাশপাশি এখানকার ব্যবসায়ীরাও বিপাকে। আর্থিকভাবে প্রতিনিয়ত ক্ষতির মুখে পড়ছি আমরা। তিনি বলেন, ৬৮ লাখ টাকায় সিন্নিরটেক-আশুলিয়া নদীর উভয়তীরে নৌ-যানের মালামাল উঠানামার জন্য সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছি। নৌ-যান বাল্কহেড চলাচল বন্ধ থাকায় ইজারা আদায় করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে প্রতিদিন কর্মচারীদের বেতন বাবদ ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। এতে করে সমিতির সদস্যরা মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
গাবতলী ল্যান্ডিং স্টেশন শুল্ক আদায় ও লেবার হ্যান্ডলিংয়ের (কেন্টিনসহ) ইজারাদার মিয়া মো. আক্তার হোসেন জানান, ২ কোটি ২২ লাখ টাকা দিয়ে তারা স্টেশনের ইজারা নিয়েছেন। অথচ নাব্য সঙ্কটে নৌ-যান আসতে না পারায় তারা এখন বিপাকে। ব্যবসা তো দূরের কথা ইজারার অর্ধেক টাকাই উঠানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা বলেন, বিভিন্ন সময়ে নদী ড্রেজিং ও নাব্য সঙ্কটে পদক্ষেপ নিলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কোন কিছুই সম্ভব হয়ে উঠেনি। তাদের দাবি সরকার নাব্য সঙ্কট দূর করতে পারলে সড়ক পথের পাশপাশি নৌ-পথে রাজধানীর সঙ্গে ব্যবসাসহ মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হতো।
নাব্য ও দখলদারদের উচ্ছেদ এবং সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিøউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর এস মোজাম্মেল হক ইনকিলাবকে বলেন, রাজধানীর চারপাশের নদীর নাব্য ও উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রতি সপ্তাহেই আমি পরিদর্শনে যাচ্ছি। যেখানে যেখানে চর দেখা দিয়েছে তার প্রত্যেকটা স্থান চিহ্নিত করে খনন করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। একই সঙ্গে শীতকালে পানির ফ্লো কম থাকে। মার্চ থেকেই পানি বাড়বে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এ নিয়ে কাজ করছে আশাকরি খুব শিগগিরই এর সমাধান হবে বলে জানান এস মোজাম্মেল হক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন