মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ব্যবসা বাণিজ্য

ঝিনাইদহে লোকাল গভর্নেন্স সাপোর্ট প্রজেক্টের টাকা নয় ছয়!

| প্রকাশের সময় : ২৪ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ঝিনাইদহ জেলা সংবাদদাতা : রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ইউপি চেয়ারম্যানদের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে ঝিনাইদহে লোকাল গর্ভনেন্স সাপোর্ট প্রজেক্টে (এলজিএসপি-২) বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও পকেট ভারি হয়েছে দুর্নীতিবাজ জনপ্রতিনিধিদের। ব্যক্তি স্বার্থে প্রকল্পের টাকা ব্যবহার করায় বৃহৎ জনগোষ্ঠির কল্যাণ মুখ থুবড়ে পড়েছে। লোকাল গর্ভনেন্স সাপোর্ট প্রজেক্টের নীতিমালা ভঙ্গ করে ব্যক্তিগত খাতে এই প্রকল্পের অর্থ ব্যয় করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জেলার বেশ কয়েকজন ইউপি সচিবকে কারণ দর্শানো নোটিশ করেও প্রকল্পের অর্থ লুটপাট ঠেকানো সম্ভব হয়নি। ফলে আগামী বরাদ্দ থেকে বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে ১৭টি ইউনিয়নে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে লোকাল গর্ভনেন্স সাপোর্ট প্রজেক্ট (এলজিএসপি-২) প্রকল্পের আওতায় ২৫৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ঝিনাইদহ জেলা ফ্যাসিলিটেটর মোঃ ওমর ফারুক জানিয়েছেন সদর উপজেলায় এলজিএসপি-২ প্রকল্পের মাধ্যমে ২ কোটি ২৮ লাখ ১ হাজার ৯শ’ ৮৪ টাকা ব্যয় করা হয়। বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে ইউনিয়নের প্রত্যন্ত পল্লীতে রাস্তা ম্যাকাডাম, ইউড্রেন, কালভার্ট নির্মাণ, টিউবয়েল স্থাপন, স্প্রে মেশিন বিতরণ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলমীরা, সিলিং ফ্যান, বেঞ্চ, খেলার সামগ্রী সরবরাহ, হতদরিদ্রদের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ ও ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য কেন্দ্রে ল্যাপটপ, প্রিন্টার্স কম্পিউটার কেনা দেখানো হয়েছে। এদিকে লোকাল গর্ভনেন্স সাপোর্ট প্রজেক্টের তালিকা নিয়ে জেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, এই প্রকল্পের অর্থ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তি নামে ব্যয় দেখানো হয়েছে। চেয়ারম্যান বা রাজনৈতিক নেতাদের পছন্দের লোকজনদের মাঝে সেলাই মেশিন, টিউবয়েল ও স্প্রে মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। এ সব পণ্য কেনার ক্ষেত্রে একেক চেয়ারম্যান একেক রকমের দাম নির্ধরণ করলেও জিনিসের মান বজায় রাখা হয়নি। মধুহাটী ইউনিয়নের চোরকোল গ্রামের জাকিরুলের বাড়িতে ব্যক্তিগতভাবে টিউবওয়েল দেয়া হয়েছে। একইভাবে হাজিডাঙ্গার খোকাই মন্ডল, টিটো, শ্যামনগরের আজিজুর, দুর্গাপুরের আব্বাস, যাদবপুরের মুক্তার ও কুবিরখালির জামিরুলসহ অসংখ্য ব্যক্তির বাড়িতে এলজিএসপির নিয়ম নীতি ভঙ্গ করে টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। এ ভাবে ওই ইউনিয়নে বিভিন্ন ব্যক্তিকে সেলাই মেশিন ও স্প্রে মেশিন সরবরাহ করা হয়েছে। এলজিএসপির প্রথম কিস্তিতে মধুহাটী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ৫২টি স্প্রে মেশিন সরবরাহ দেখানো হয়েছে। যার প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮শ’ টাকা করে। কিন্তু যে স্প্রে মেশিন দেয়া হয়েছে তার বাজার মূল্য হবে ১৫শ’ টাকা করে। বাকী টাকা লোপাট করা হয়েছে। ঘোড়শাল ইউনিয়নে ৫টি পরিবারের মধ্যে ১৪টি সেলাই মেশিন বাবদ ব্যায় দেখানো হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪০০ টাকা। প্রতিটি সেলাই মেশিনের দাম ধরা হয়েছে ৮ হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু বাজারে এই দামের কোন সেলাই মেশিন নেই। সাগান্না ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ৫টি সেলাই মেশিনের দাম ধরা হয়েছে ৯ হাজার টাকা করে ৪৫ হাজার টাকা। কালীচরণপুর ইউনিয়নে ৮ সেট রিং স্লাবের দাম ধরা হয়েছে ৮০ হাজার টাকা, কিন্তু ৮ সেট রিং সøাবের দাম সাকুল্যে হবে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এ ভাবে ইউনিয়নে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে এলজিএসপি-২ প্রজেক্টের লাখ লাখ টাকা পকেটস্থ করা হলেও তদারকী কর্মকর্তারা কোন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এলজিএসপি-২ প্রকল্পের ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরের প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিপালনীয় বিষয়সমূহের মধ্যে উল্ল্যেখ করা হয়েছে ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে উন্মুক্ত সভার মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণ ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালিকা প্রণয়ন, প্রতিটি প্রকল্পের নাম সম্বলিত বিস্তারিত বিবরণসহ নির্দিষ্ট ফরমেটের সাইন বোর্ড টানানো, ব্যক্তি পর্যায়ে কোন টিউবওয়েল, স্প্রে মেশিন, কালভার্ট দেয়া যাবে না। আরো বলা হয়েছে, এলজিএসপি-২ এর আওতায় বরাদ্দকৃত টিউবওয়েল ও স্প্রে মেশিনে এলজিএসপি-২ এর নাম লিপিবদ্ধ (মার্কিং) করতে হবে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ১৭ টি ইউনিয়নের মধ্যে অধিকাংশ ইউনিয়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিপালনীয় যে সব নির্দেশনা দেয়া আছে তা লংঘন করে ব্যক্তির নামে টিউবওয়েল ও স্প্রে মেশিন সরবরাহ করা হয়েছে। কাগজে-কলমে দেখানো হলেও ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে উন্মুক্ত সভার মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণ ও অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি বলে ইউপি মেম্বররা অভিযোগ করেন। তাদের ভাষ্য চেয়ারম্যানরা পকেট ভারি করার জন্য নিজেদের ইচ্ছামত প্রকল্প দাখিল করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ইউপি সচিবরা এতে বাধা দিলেও কাজে আসেনি। হরিণাকুন্ডুর রঘুনাথপুরে এমন কাজে বাধা দেয়ায় এক ইউপি সচিবকে মারপিট করা হয়েছিল। এদিকে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এলজিএসপি কাজে নয় ছয় করার বিষয়টি দৃষ্টিতে আসলে ৪ জন ইউপি সচিবকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা এমনকি এমপিদের সুপারিশে জেলা প্রশাসন ইউপি সচিবদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারিনি। এ বিষয়ে ডিষ্ট্রিক ফ্যাসিলিটেটর মোঃ ওমর ফারুক কিছু অনিয়মের কথা স্বীকার করে জানান, আগামী থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশোধন আনা হয়েছে। বিশেষ করে দুর্নীতি বন্ধে সেলাই মেশিন, টিউবওয়েল ও স্প্রে মেশিনের মতো জিনিস বাদ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সারা জেলার অনিয়ম অনুসন্ধান করা সম্ভব নয়, কেউ তথ্য দিলে আমি ব্যবস্থা নিতে পারি। তিনি যোগ করেন, প্রকল্প নিয়ে কথা ওঠার কারণে কয়েকজন ইউপি সচিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়েও বাধার সম্মুখিন হতে হয়েছে। তিনি বলেন এই প্রকল্পের অনিয়মের ব্যাপারে সাংবাদিকদের অনুসন্ধান অমূলক নয়। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলেও তিনি জানান। তবে এ ব্যাপারে কয়েকজন চেয়ারম্যানের বক্তব্য জানতে ফোন করা হলে তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন