বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

ব্যাংকিং খাতে সুশাসন অপরিহার্য

| প্রকাশের সময় : ২০ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জালাল উদ্দিন ওমর
ব্যাংকিং খাতে একটা অস্থিরত চলছে এবং সময়ের সাথে খেলাপি ঋণ কেবল বাড়ছেই। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৬ শেষে এদেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে ৬২,১৭২ কোটি টাকা ব্যালেন্সশিটে অন্তর্ভুক্ত আর রাইট অফ করা প্রায় ৪২০০০ কোটি টাকা , যা ব্যালেন্সশিটে অন্তর্ভুক্ত নয়। ২০০৮ সালের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২২,৪৮১ কোটি টাকা আর রাইট অফ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫,৬৬৭ কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণ ছিল ৩৮,১৪৮ কোটি টাকা। সেই ঋণ বেড়ে ২০১৬ সালের শেষে এসে দাঁড়িয়েছে ১,০২,১৭২ কোটি টাকা। সুতরাং খেলাপি ঋণ কী হারে বাড়ছে তা সহজেই পরিমেয়। ব্যাংকগুলো প্রতি বছর বিশাল অংকের খেলাপি ঋণকে রাইটঅফ করে এবং তা ব্যালেন্সশিট থেকে বাদ দেয়। রাইট অফ করা এই ঋণ ব্যাল্যান্সশিটের অন্তর্ভুক্ত থাকে না বিধায়, তা খেলাপি ঋণ হিসাবে ব্যাংকগুলো প্রকাশ করে না। তাছাড়া ব্যাংকগুলো আরো বিশাল অংকের খেলাপি ঋণ বিভিন্ন মেয়াদে রিসিডিউল করেছে, যা খেলাপি ঋণ হলেও রিসিডিউল করার কারণে আর খেলাপি ঋণে হিসাব করা হয়নি। ২০১৫ সালে বড় বড় শিল্প গ্রæপসমূহ ১৫০০০ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছে। যদি রিসিডিউল এবং পুনর্গঠন করা ঋণ হিসাব করা হয়, তাহলে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো অনেক বেশি হবে। এদিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০১৬ সালে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে চারটি ব্যাংকই লোকসানে আছে। সোনালী, রূপালী, কৃষি এবং রাকাব এই চার ব্যাংক ২০১৬ সালে এক হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান দিয়েছে। সুতরাং খেলাপি ঋণের প্রভাব কতটা ক্ষতিকর তা সহজেই বোঝা যায়। এই খেলাপি ঋণের ভারে ব্যাংকগুলো এখন আক্রান্ত এবং অর্থনীতি মন্দা। খেলাপি ঋণের বোঝা বহন করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি ও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে প্রদত্ত সুদের হার কমিয়ে দিয়েছে এবং এই সুদের হার কোনো অবস্থাতেই এখন ৫ শতাংশের বেশি নয়। অথচ দেশের মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ৭ শতাংশ। ফলে আমানতকারীদের আয় কমে গেছে এবং যারা আমানতের বিপরীতে অর্জিত আয় দিয়ে সংসার চালান তারা কষ্টে আছেন। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের পরিমাণকে কমিয়ে আনতে হবে। তার জন্য ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের বিকল্প নেই।
ব্যাংকসমূহ ঋণ প্রদানের মাধ্যমেই মূলত আয় করে থাকে। কিন্তু গ্রাহক যখন এই ঋণ নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করে না, তখন তা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। এই অবস্থায় ব্যাংকের কোনো আয় তো হয়ই না, অধিকন্তু মূল টাকাটাই গ্রাহকের হাতে আটকে থাকে। ফলে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর আয় কমে যায় এবং ব্যাংকগুলোতে সৃষ্টি হয় দায়বদ্ধতা। খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর গতিকে পুরোপুরি আটকে রাখে। কারণ এই বিশাল পরিমাণ টাকা থেকে একদিকে ব্যাংক যেমন কোনো প্রকার আয় করতে পারে না, ঠিক তেমনি এই ঋণ অনাদায়ী হওয়ার কারণে তা নতুন করে অন্য কোনো সেক্টরে বিনিয়োগও করতে পারে না। ফলে ব্যাংকের আয় কমে যায়, বিনিয়োগ কমে যায় এবং ব্যাংকের আর্থিক গতিশীলতাও কমে যায়। অপরদিকে এই খেলাপি ঋণের বিপরীতে আয় থেকে প্রভিশন রাখতে হয় বিধায়, ব্যাংকের আয়ের বিশাল একটি অংশ খেলাপি ঋণের ঘাটতি মেটাতে ব্যয় করতে হয়। এক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যদি ব্যাংকের আয়ের সমান হয় তাহলে আয়ের পুরোটাই প্রভিশন ঘাটতির পিছনে ব্যয় করতে হয়। এ অবস্থায় ব্যাংকের কোনো আয় অবশিষ্ট থাকে না। অপরদিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যদি ব্যাংকের আয়ের চেয়ে বেশি হয় তাহলে সেক্ষেত্রে ব্যাংক ক্ষতির অবস্থানে থাকে। ফলে ব্যাংকসমূহ আয় করেও তা ভোগ করতে পারে না। এ অবস্থায় ব্যাংকের অবস্থা দিন দিন নাজুক থেকে নাজুকতর হতে থাকে। খেলাপি ঋণের কারণে সরকারি ব্যাংকগুলোতে বহুদিন থেকেই স্থবিরতা চলছে। একইভাবে খেলাপি ঋণের কারণে অনেক বেসরকারি ব্যাংক ও সমস্যার মধ্যে আটকা পড়েছে। সুতরাং খেলাপি ঋণ কমানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের ডিপোজিটররা তাদের ন্যায্য লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ এসব টাকা এদেশের হাজার লক্ষ কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষদের কষ্টার্জিত অর্থ। আর এসব টাকা আজ গুটিকয়েক মানুষের পকেটে ঢুকে আছে। বাংলাদেশে আজ যত টাকা খেলাপি ঋণ আছে, তা যদি খেলাপি না হতো, তাহলে শুধুমাত্র এই টাকা দিয়ে দেশে হাজারো স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, হাসপাতাল এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যেত। তখন তো এই দেশ অনেক উন্নত হতো ।
ব্যাংকগুলোর অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, বাচবিচারহীনভাবে ঋণ প্রদান এবং কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেয়া অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের টার্গেট খেলাপি ঋণ সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী। অনেক ক্ষেত্রে একটি প্রজেক্টের গুরুত্ব এবং ভবিষ্যৎ যথাযথভাবে বিবেচনা না করে ঋণ প্রদান করা হয়। অধিকন্তু ঋণ গ্রহীতা ঋণের টাকা পুরোপুরিভাবে ঐ প্রজেক্টের উন্নয়ন এবং পরিচালনায় ব্যয় করছে কিনা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা মনিটরিং করে না। যার ফলে একজন গ্রাহক তার গ্রহণকৃত ঋণ থেকে বিরাট একটি অংশ অন্য কাজে যেমন জমি কেনা, দামি গাড়ি কেনা এবং বিলাসবহুল বাড়ি তৈরির জন্য ব্যয় করে। ফলে প্রয়োজনীয় এবং পুরোপুরি অর্থ যথাযথভাবে শিল্পপ্রতিষ্টানে ব্যয় না হওয়ার কারণে উক্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান যথাসময়ে উৎপাদনে যেতে পারে না। ফলে ঐ শিল্প দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ঋণগ্রহীতা যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারে না। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হয়। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ গ্রহণ করার সময় ঐ প্রতিষ্ঠানের মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি।
সুতরাং অতিরিক্ত ঋণ প্রদান শুরুতেই খেলাপি ঋণের সুযোগ সৃষ্টি করে। অপরদিকে প্রয়োজনের তুলনায় কম ঋণ প্রদান ও অনেকক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ সৃষ্টি করে। কারণ পরিমাণ মতো ঋণ না পাওয়ায় গ্রাহক প্রজেক্ট কমপ্লিট করতে পারেন না। ফলে আয় হয় না এবং গ্রাহক ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে পারেন না। ফলে এখানেও খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হয়। এদিকে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতা ও ব্যাংকের পরিচালকদের প্রভাব ও খেলাপি ঋণ সৃষ্টির জন্য অনেক সময় দায়ী। সরকারি ব্যাংকগুলোতে সিবিএ এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক সময় প্রভাব সৃষ্টি করেন। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সিবিএ এবং রাজনৈতিক প্রভাব না থাকলেও এখানে প্রভাব বিস্তার করেন ব্যাংকের প্রভাবশালী পরিচালকরা। ফলে অনেক সময়ে যথাযথ প্রতিষ্ঠানের পেছনে ঋণ প্রদান না করে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বর্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানের পেছনে ঋণ প্রদান করা হয়। এসব ঋণ সময়ের ব্যবধানে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেয়া অত্যধিক মুনাফা অর্জনের টার্গেট এবং মুনাফা অর্জনের অসম প্রতিযোগিতা ও খেলাপি ঋণ সৃষ্টির জন্য দায়ী। তাছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দাভাবও খেলাপি ঋণ সৃষ্টির জন্য বহুলাংশে দায়ী। রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা না থাকলে ব্যবসা বাণিজ্যে গতি আসে না, শিল্পকারখানা ঠিকমত চলে না। এসব ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী/শিল্পপতিরা ক্ষতির সম্মুখীন হন। ফলে তারা ব্যাংকের ঋণ ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারেন না। যার কারণে ঋণখেলাপি হন। খরা, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ব্যবসায়ীরা যখন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তখনো তার প্রভাবে খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হয়। সরকারের ট্যারিফ নীতির কারণেও ব্যবসায়ীরা অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হন, ফলে খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হয়। সুতরাং এইসব ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কল্যাণে বাস্তবতার আলোকে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
এদিকে ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য পর্যাপ্ত আইন নেই। অর্থাৎ আইনের আশ্রয় নিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করাটা কষ্টকর। এ অবস্থায় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংক কর্মকর্তা খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য প্রচÐ চাপে থাকেন। একই সাথে ব্যাংক কর্মকর্তাকে ঋণ গ্রহীতার প্রভাবকে মোকাবেলা করতে হয়, যা আরো কষ্টকর। অধিকন্তু খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আদালতে মামলা করা হলেও তা দীর্ঘসময় ধরে কেবল চলতেই থাকে এবং মীমাংসা হতে দীর্ঘসময় লেগে যায়। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য সরকার অর্থঋণ আদালত গঠন করলেও তা খেলাপি ঋণ আদায়ে খুব বেশি গতি আনতে পারেনি। মামলা বেশি হওয়ার কারণে এখানেও জট লেগে আছে। তাছাড়া অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা এখন অনেক বেড়ে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারছে না। আর এক্ষেত্রে ঋণখেলাপিরা সুবিধা পাচ্ছেন। অপরদিকে নিলামের মাধ্যমে বন্ধকিকৃত সম্পদ বিক্রি করাও অনেক সময় সম্ভব হয় না। বন্ধকিকৃত সম্পত্তি বিক্রির জন্য ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিলাম আহŸান করা হলেও, তা অধিকারে যেতে পারবে না মনে করে ক্রেতারা কিনতে কম আগ্রহ দেখান। কোনো ক্রেতা আগ্রহী হলেও তিনি ঐ সম্পত্তির জন্য অপেক্ষাকৃত কম মূল্য দিতে চান। ফলে খেলাপি ঋণ যথাযথভাবে আদায় করাটা সম্ভব হয় না আর এর পরিমাণ কেবল বাড়তেই থাকে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গেøাবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) কর্তৃক ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫৫৮৮ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোস ফ্রম ডেভেলাপিং কান্ট্রিজ : ২০০৪-২০১৩ শীর্ষক প্রতিবেদনটির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে ২০০৪ সালে ৩৩৫ কোটি ডলার, ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৮ কোটি ডলার, ২০০৭ সালে ৪১০ কোটি ডলার, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ডলার, ২০০৯ সালে ৬১৩ কোটি ডলার, ২০১০ সালে ৫৪১ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি ডলার, ২০১২ সালে ৭২২ কোটি ডলার এবং ২০১৩ সালে ৯৬৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এসব অর্থ বাংলাদেশিরা বিদেশে পাচার করেছেন। যদি ১ ডলারের গড় মূল্য ৭৫ টাকা হিসাব করা হয়, তাহলে এ দশ বছরে পাচার হওয়া অর্থের বাংলাদেশি টাকায় পরিমাণ ৪,১৯,১০০ কোটি টাকা। আর শুধুমাত্র ২০১৩ সালে পাচারকৃত মুদ্রার বাংলাদেশি মান হচ্ছে ৭২,৫২৫ কোটি টাকা এবং গড়ে প্রতি বছর পাচার হওয়া অর্থের বাংলাদেশি পরিমাণ ৪১,৯১০ কোটি টাকা। জিএফআই-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ডেভ কার এবং অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্পেনজারস এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী যেহেতু প্রতি বছরই অর্থ পাচার হয়েছে, সুতরাং অর্থ পাচারের এই ধারা ২০১৪-২০১৫ সালেও অব্যাহত ছিল এবং ২০১৬ সালেও অব্যাহত থাকাটা স্বাভাবিক। এদিকে ২০১৪ সালের জুন মাসে ইউএনডিপি কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতার পর থেকে চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির আকারের প্রায় ৩০ শতাংশ। সে হিসাবে গত চার দশকে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই অর্থ যে এদেশের বড় বড় শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীরা পাচার করেছেন সে বিষয়ে তো সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কারণ এদেশের সাধারণ মানুষেরা অর্থ পাচারের কথা কল্পনাও করতে পারেন না। এইসব টাকা যে ব্যাংক থেকে গ্রহণ করা ঋণেরই একটি অংশ, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ অবস্থায় ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে এবং নতুন খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পথ বন্ধ করতে হবে। এজন্য নতুন ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে এই ঋণকে যথাযথভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব, সিবিএ প্রভাব এবং পরিচালকদের প্রভাবমুক্ত না হলে তা কখনো সম্ভব নয়। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে। অধিকন্তু অর্থঋণ আদালতসহ আইনি প্রক্রিয়াকে আরো উন্নত এবং সংস্কার করতে হবে, যাতে আইনের সাহায্য নিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করা যায় এবং ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। তাছাড়া গ্রাহককে যেনতেন প্রকারে ঋণ প্রদান করে মুনাফা অর্জনের টার্গেট ব্যাংকগুলোকে পরিহার করতেই হবে। মুনাফা অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা ব্যাংকিং সেক্টরকে বিশাল ক্ষতির মুখোমুখি করেছে। ব্যাংকগুলোকে তার ঋণ নীতিমালা পুনর্বিন্যাস করতে হবে। তাদের ঋণকে বিভিন্ন সেক্টরে বণ্টন করতে হবে। তাছাড়া ব্যাংকগুলোর ঋণ/বিনিয়োগের বিপরীতে বিদ্যমান সুদ/মুনাফার হার আরো অনেক কমাতে হবে। বর্তমানে এই হার বছরে ১২-১৪ শতাংশ। বাস্তবতা হচ্ছে ১২-১৪ শতাংশ সুদ/মুনাফায় ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ গ্রহণ করে ব্যবসা করে মুনাফা অর্জন করা এবং ব্যাংকের টাকা যথাসময়ে পরিশোধ করা আসলেই একটা কঠিন ব্যাপার। একজন উদ্যোক্তা যদি ব্যাংক থেকে এক কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে এবং সুদের হার যদি ১৩ শতাংশও হয়, তাহলে বছরে শুধুমাত্র ব্যাংকের কাছে তাকে পরিশোধ করতে হচ্ছে সুদ বাবদ ১৩ লক্ষ টাকা। তার অফিস ভাড়া, মেশিনারি, স্টাফ খরচ, বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং অন্যান্য খরচ তো রয়েছেই। এসব পরিশোধের পর তার আয়। সুতরাং ঐ উদ্যোক্তাকে টিকে থাকতে হলে কমপক্ষে ৩৫ শতাংশ মুনাফা করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে এমন ব্যবসা খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টকর, যেখানে এত বেশি মুনাফা আছে। তাছাড়া ব্যবসায় কিন্তু সবসময় মুনাফা হয় না। সুতরাং ঋণ/বিনিয়োগের বিপরীতে ব্যাংকের সুদ/মুনাফার হার কমাতে হবে এবং আমি মনে করি সেটার পরিমাণ সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। আশা করি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখবেন। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে সৎ এবং যোগ্য ব্যক্তিদেরকে নিয়োগ দিতে হবে। কারণ অভিজ্ঞতা সবসময় যোগ্যতার বিকল্প হতে পারে না। অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞ না হলে এবং অর্থনীতির গতি প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান ও দূরদর্শিতা না থাকলে তাদের পক্ষে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ব্যাংকিং খাতকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া কখনো সম্ভব নয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ বিষয় সতর্ক না হলে এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণ কমবে না, ব্যাংকে উন্নয়ন ও গতিশীলতা আসবে না। একই সাথে অর্থনীতির চাকাও গতিশীল হবে না। তাই ব্যাংকিং সেক্টর ও একই সাথে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে খেলাপি ঋণ কমানোর কোনো বিকল্প নেই। তার জন্য ব্যাংকিং খাতে সুশাসন অপরিহার্য ।
য় লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মিলটন ২১ এপ্রিল, ২০১৭, ৬:০১ এএম says : 0
এর জন্য দায়ী সরকারী দলের সিবিএর লোক
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন