হাসান সোহেল : নকল ও নিম্নমানের ভারতীয় রডে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। ভুয়া গ্রেড সিল ব্যবহার করে দীর্ঘ দিন ধরে অসাধু রি-রোলিং মিল মালিকেরা জালিয়াতির মাধ্যমে নকল রড বাজারজাত করে আসছে। এমনকি এ মুহূর্তে উৎপাদনে থাকা ২০০রি-রোলিং মিলের মধ্যে মাত্র ৩৬টির লাইসেন্স আছে, বাকিগুলোর বৈধ-অবৈধ কোনো লাইসেন্স নেই। মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনুমোদন ছাড়াই রড উৎপাদন এবং বাজারজাত করে আসছে ওই মিলগুলো। এদের বেশির ভাগ রি-রোলিং মিলের মালিক কিছু অসাধু দোকানদারের যোগসাজশে ভোক্তাদের ঠকিয়ে অধিক মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে। এদিকে আমদানি শুল্ক না থাকায় ভারত থেকে মাত্রাতিরিক্ত ফসফরাসযুক্ত ইনগট আমদানি বাড়ায় এই শিল্পের বাড়ছে নির্মাণ ঝুঁকি। এছাড়া এই খাতের দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে বিপাকে। রড তৈরির কাঁচামাল বিলেট ও ইনগট আমদানিতে গত অর্থবছরের আগে প্রায় ১২হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু ভারতের সাথে বাংলাদেশের সাপটা চুক্তির কারণে ইংগট আমদানির ক্ষেত্রে ১২ হাজার টাকা শুল্ক উঠিয়ে দিয়ে মাত্র ৮০০টাকা করা হয়। ইংগট আমদানীকারকরা এই ছাড় পেলেও স্থানীয় বিলেট ও ইংগট উৎপাদনকারী শিল্পগুলো তা পাচ্ছে না। অথচ একই বাজারে রড বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে স্থানীয় স্টিল শিল্পগুলো অসম প্রতিযোগিতায় পড়ছে। একই সঙ্গে সুযোগ পেয়ে একটি চক্র নি¤œমানের ইংগট আমদানি করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে বর্তমানে কিছু মিল বিএসটিআইর অনুমোদন নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের রড উৎপাদন করছে। বুয়েটের পরীক্ষায় এসব রড উত্তীর্ণ। অন্য দিকে অনেক রি-রোলিং মিল জালিয়াতির মাধ্যমে উন্নত মানের রডের সিল ছাপ দিয়ে নিম্নমানের এবং নকল রড উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। এসব রডে নির্মিত ভবন, সেতু ও কালভার্টসহ যে কোনো স্থাপনা সাধারণ ভূকম্পনে যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়ে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তারা রড ব্যবহারকারী ভোক্তাদের কেনার আগে যথাযথ পরীক্ষা করে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বুয়েটের ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. ফাহমিদা গুলশান বলেন, বাজারে বিভিন্ন মানের ইস্পাত রড পাওয়া যায়। এগুলোর শক্তি, নমনীয়তা, রাসায়নিক গঠন ও অন্যান্য গুণাবলিতে পার্থক্য রয়েছে। রাসায়নিক গঠনই (কেমিক্যাল কম্পোজিশন) রডের গুণাবলি নিয়ন্ত্রণ করে। রড সংযোগযোগ্য কিনা, তাও মূলত নির্ভর করে এর রাসায়নিক গঠনের ওপরই। এক্ষেত্রে ফসফরাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ত্রুটিমুক্ত ও টেকসই কাঠামো তৈরিতে ইস্পাত রডে ফসফরাসের মাত্রা সঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ ইনকিলাবকে বলেন, নি¤œমানের রড আসছে ভারত থেকে। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে ভোক্তারা প্রত্যারিত হচ্ছে। একই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। তিনি বলেন, ভুয়া সিল ব্যবহার করে ৫০০ ডবিøউ (টিএমটি) ৪০০ ডবিøউ (৬০ জি) গ্রেডের ছাপ দিয়ে রড তৈরি ও বাজারজাত করা হচ্ছে। শিঘগিরই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে ভবন ধ্বসে পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে রড ও স্টিল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যথাযথ পদ্ধতি ও প্রযুক্তি অনুসৃত হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাঁচামাল ঠিকভাবে মেল্ট না করেই রড ও স্টিল তৈরি করা হয়। উন্নত বিশ্বে ৫০ বছর মেয়াদি বাড়ি তৈরি করলে তা টেকে ১০০ বছরের বেশি। অথচ দেশে একই মেয়াদের জন্য নির্মিত বাড়ি অর্ধেক মেয়াদেই ধ্বংস হতে শুরু করে। এর পেছনে অন্য সব কারণের মধ্যে নিম্নমানের রডের ভূমিকাই বেশি। রডের মান মূলত ভার সহ্য করার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। রড ও অ্যাঙ্গেল বার তৈরির উপকরণ হিসেবে আমদানিকৃত ইনগটে রাসায়নিকের উপস্থিতি-বিষয়ক নির্দেশনা অনুসৃত না হওয়ায় অবকাঠামোর স্থায়িত্ব কমার পাশাপাশি ভূমিকম্পে ক্ষতির ঝুঁকিও বাড়ছে।
স্টিল শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে প্রায় ৮০ লাখ টন রড উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। আর উৎপাদন হয় প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টন। ভূয়া প্রতিষ্ঠান বছরে প্রায় ১০ লাখ টন নিম্নমানের রড বাজারজাত করছে। যা রডের বাজারের ২৫ শতাংশের বেশি। এর আনুমানিক বাজারমূল্যে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। যার পুরো অংশটাই রাজস্ব পাচ্ছেনা সরকার। এই রড প্রকৃত বাজারমূল্য থেকে ৫ হাজার টাকা কম দামে বাজারে সরবরাহ করা হয়। ফলে ভোক্তার পাশাপাশি প্রকৃত রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও ঠকছে। একাধিক স্টিল মিল মালিক জানান, ম্যানুয়াল রড মিলগুলো ৫০০ ডাবিøউ ৬০ গ্রেডের রড তৈরির সক্ষমতা না থাকলেও তারা নকল সিল মেরে রড বাজারজাত করছে। একই সঙ্গে নজরদারি না থাকায় নিম্নমানের রড সরবরাহকারীদের বাজারজাত করা রড থেকে ২৫ শতাংশ রাজস্ব কম পাচ্ছে সরকার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ইংগটের মান বিলেটের চেয়ে ভালো হয় না। বিশেষ করে ভারতে ইংগট তৈরি হয় স্পঞ্জ আয়রন দিয়ে বা ওর থেকে। এর মধ্যে ফসফরাস, সালফার কন্ট্রোল করা সম্ভব হয় না, তাতে ফসফরাস, সালফার বেশি থাকে। এ জন্য ইংগটের স্ট্রেন্থ সঠিক মাত্রায় হয় না। নিম্নমানের ইংগটে তৈরি রডও নিম্নমানের হয়। ফলে এসব রড দিয়ে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ে যেসব স্থাপনা নির্মাণ করা হবে তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। এমনিতেই আমাদের দেশ ভূমিকম্পপ্রবণ, তাই স্থাপনাগুলো ঝুঁকি থেকে রক্ষাকল্পে এবং দেশীয় বিলেট ও ইংগট উৎপাদনকারী স্টিল শিল্পগুলোকে অসম প্রতিযোগিতার কবল থেকে মুক্ত করতে এবং শিল্পগুলোকে বাঁচানোর জন্য বিলেট আমদানির মতো ইংগট আমদানির ওপর ১৫শতাংশ ভ্যাট, ২০শতাংশ আরডি এবং ট্যারিফ ভ্যালু ৩৮০ ইউএস ডলার প্রতি মেট্রিক টনে নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে এসআরও জারি করা।
এদিকে মাত্রাতিরিক্ত ফসফরাসযুক্ত ইনগট আমদানিতে ঝুঁকিতে পড়ছে ভোক্তারা। বাড়ছে ভবন নির্মাণ ঝুঁকি। বুয়েটের ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তথ্যমতে, রাসায়নিক গঠন রডের গুণাবলি নিয়ন্ত্রণ করে। এ রাসায়নিকের মধ্যে ফসফরাস ও সালফার খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ত্রুটিমুক্ত ও টেকসই অবকাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত রডে এ রাসায়নিক উপাদানগুলো সঠিক মাত্রায় থাকাটা খুবই জরুরি। সাধারণভাবে রডের মধ্যে ফসফরাসের পরিমাণ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশের বেশি থাকলে তা ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পণ্যমান নির্ধারণের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইএসওর (ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন) প্রতিবেদনেও রডে দশমিক শূন্য ৪ থেকে ব্যবহারভেদে সর্বোচ্চ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ পর্যন্ত ফসফরাস উপযুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রডে ফসফরাসের উপস্থিতির পরিমাণ বেশি হলে ভঙ্গুরতার ঝুঁকি তৈরি হয়।
বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শহীদ উল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, সাপটা চুক্তির আওতায় এখন ইনগট ভারত থেকে ফ্রি আসছে। নি¤œমানের এই ইনগট আমদানি করে রড তৈরি করা হচ্ছে। নিম্নমানের এসব রড ব্যবহারে নির্মিত স্থাপনা যে কোনো সময় সাভারের রানা প্লাজা ধসের মতো বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, বিষয়গুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে লিখিতভাবে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং রহস্যজনকভাবে এ ব্যাপারে সংশ্লিস্ট বিভাগ নীরব রয়েছে। এখনই বিএসটিআইর মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে এসব অনিয়ম বন্ধ এবং ঝুঁকি থেকে জাতিকে রক্ষার আহŸান জানান তিনি। একই সঙ্গে বিলেটের মত ইনগটেও শুল্ক আরোপের দাবি জানান।
বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সার্টিফিকেশন মার্ক) প্রকৌশলী এস এম ইসহাক আলী বলেন, বিএসটিআই ভেজাল রড সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে বাজারে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে আসছে। বিভিন্ন সময়ে ভেজাল রড বাজার থেকে সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন