শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

কাতারের সঙ্গে ৬ আরবসহ ৭ দেশের সম্পর্ক ছিন্ন

| প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম


ইরান, সন্ত্রাসী, উগ্রবাদী, সা¤প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন, অর্থ সহায়তার অভিযোগ : স্থল আকাশ ও পানিপথ বন্ধ কূটনীতিক ও নাগরিকদের দেশত্যাগের নির্দেশ : মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিপাকে বিমানযাত্রীরা : বেড়েছে তেলের দাম


ইনকিলাব ডেস্ক : তিন নিকটতম প্রতিবেশীসহ ছয়টি আরবসহ ৭টি দেশ কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। দেশগুলো হচ্ছে, সউদী আরব, বাহরাইন, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লিবিয়া, ইয়েমেন ও মালদ্বীপ। তারা বলছে, সন্ত্রাস এবং উগ্রতার বিপদ থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতেই তাদেরকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। পারস্য উপ-সাগরে অবস্থিত দেশ কাতারের সঙ্গে একমাত্র সউদী আরবের স্থল সীমান্ত রয়েছে। সাগরে সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশি বাহরাইন। পানিপথে আরেক নিকটতম প্রতিবেশি সংযুক্ত আরব আমিরাত।
কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী দেশগুলো পানি-স্থল-আকাশ পথে সব যোগাযোগও বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণার পরপরই ফ্লাই দুবাই এবং এমিরেটসের মতো বিমান সংস্থাগুলো কাতারে তাদের ফ্লাইট বাতিল করতে শুরু করে। অন্যদিকে কাতার এয়ারওয়েজও সউদী আরবে তাদের সকল ফ্লাইট বাতিল করেছে। সউদী সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশটি কার্যত স্থলপথে বাকি দুনিয়া থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
সউদী প্রেস এজেন্সি বলছে, কাতারের প্রতি একই পদক্ষেপ নিতে দেশগুলো তাদের সব ভ্রাতৃপ্রতীম দেশ এবং কোম্পানির প্রতিও আহŸান জানিয়েছে। ইয়েমেনে লড়াইরত সউদী নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে কাতারও ছিল। সেই জোট থেকেও কাতারের বহিষ্কারের ঘোষণা দেয় সউদী আরব। প্রতিবেশীদের এসব সিদ্ধান্তে কাতারে বসবাসরতদের স্বাভাবিক জীবনে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে দাবি করেছে দেশটি। তবে একইসঙ্গে সিদ্ধান্তকে ‘অবিচার’ হিসাবে উল্লেখ করে দেশটি বলছে, যে অভিযোগের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি নেই।
কাতারকে বয়কটের প্রথম ঘোষণাটি আসে সউদী আরব থেকে। এরপর অপরাপর দেশগুলোও একই ঘোষণা দেয়। বাহরাইনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কাতারের রাজধানী থেকে তারা তাদের কূটনৈতিক মিসন প্রত্যাহার করছে এবং সকল কূটনীতিককে দেশটি ছাড়তে বলেছে। কাতারের সাথে পানি-আকাশ পথে যোগাযোগ বন্ধের পরিকল্পনাও করছে তারা। বাহরাইন কাতারের বিরুদ্ধে মিডিয়া উস্কানি, বাহরাইনে বিশৃঙ্খলা এবং অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রমে দায়ী ইরানি গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থনের অভিযোগ আনে। এরপরই ইউএই অভিযোগ করে, সন্ত্রাসী, উগ্রবাদী, সা¤প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন, অর্থ সহায়তা করছে কাতার। মিসর বলছে, কাতার সন্ত্রাসী সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডকে সহায়তা করে।
কাতারের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদ সংস্থায় প্রকাশিত একটি খবরকে কেন্দ্র করে গত মে মাসে উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর মধ্যে এই উত্তেজনা শুরু হয়। কাতারের কর্মকর্তাদের মতে, হ্যাকাররা কাতারের আমিরকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করে একটি খবর ছড়িয়ে দেয়। সেখানে উপসাগরীয় নেতাদের সমালোচনার পাশাপাশি আঞ্চলিক শত্রু ইরানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আহŸান জানানো হয়। বলা হয়, কাতারের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক ভালো।
মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে গণতন্ত্র নেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে নিয়মিত। তবে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সউদী আরব সরকারের উদ্যোগ এবং আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। অস্ত্র ক্রয়ে ৩ হাজার ১৬১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ২০১৫ সালের শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশ হয়ে গেছে সউদী আরব। ২০১৪ সালে এ তালিকায় শীর্ষে ছিল ভারত, সউদী আরব ছিল দ্বিতীয় স্থানে।
উপসাগরীয় দেশগুলো এতে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তারা কাতারভিত্তিক স্যাটেলাইট নিউজ নেটওয়ার্ক আল জাজিরাকেও বয়কট করতে শুরু করে। কাতারকে বয়কটের এই ঘোষণার পর পারস্য উপসাগরের অপর প্রান্তে অবস্থিত দেশ ইরান এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে।
ইরানের প্রেসিডেন্টের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হামিদ আবু তালেবি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই পদক্ষেপ সমস্যা সমাধানের পথ নয়। আগ্রাসন এবং দখলদারিত্ব অস্থিতিশীলতা ছাড়া আর কোনো ফল বয়ে আনে না। গ্যাস সমৃদ্ধ কাতারে মার্কিন সামরিক বাহিনীর বড় ঘাঁটি রয়েছে।
আধিপত্য বিস্তারের স্বার্থেই সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ৬ দেশ : কাতার
সউদী আরবসহ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নকারী ছয় দেশকে নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে কাতার। এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে আধিপত্য বিস্তারের বাসনাকে কারণ বলে দাবি করেছে তারা। একে অবিচার ও সার্বভৌমত্বের প্রতি আঘাত হিসেবে দেখছে দেশটি।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন দাবিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর লক্ষ্য পরিষ্কার। তারা আমাদের উপর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার এবং খবরদারি করতে চায়। এটা কাতারের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত।’
সউদী আরব ও বাহরাইনের ধারাবাহিকতায় মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লিবিয়া এবং ইয়েমেন কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেয়।
সউদী আরবের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা এসপিএ দাবি করে, ‘কাতার মুসলিম ব্রাদারহুড, আইএস, আল-কায়েদাসহ কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠনকে সমর্থন দিয়ে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। তাদের নিজেদের সংবাদমাধ্যমে সন্ত্রাসীদের বার্তা পৌঁছে দেয়।’ এছাড়াও কাতারের বিরুদ্ধে শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত বাহরাইনের পূর্বাঞ্চলে ইরান সমর্থিত বাহিনীকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ করে তারা।
কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নকারী অন্য দেশগুলোও কাতারের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে সমর্থন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্টের অভিযোগ তোলে।
কাতারে বিমানবন্দরে সউদী আরবগামী যাত্রীরা বিপাকে
কাতারের সঙ্গে সউদী আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করায় সউদী আরবগামী কিছু বাংলাদেশি যাত্রী দোহার হামাদ বিমানবন্দরে আটকা পড়েছেন। এছাড়া কাতারে সফররত শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে সউদী আরবে যাওয়ার করার কথা ছিল। কিন্তু কাতারের সঙ্গে সউদী আরবের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ায় দেশ দু’টির মধ্যে বিমান চলাচল বন্ধ থাকার কারণে তিনি ঢাকা ফিরে আসছেন। কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমেদ এ তথ্য জানান।
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা এখানকার বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘটনাটি আমরা আজ জানতে পেরেছি।’ তিনি বলেন, ‘আকাশ পথ বন্ধ থাকায় সউদী আরবগামী অল্পসংখ্যক যাত্রী আটকে আছেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। শুধু বাংলাদেশিরা নন, অন্য অনেক দেশের সউদী আরবগামী যাত্রীরাও আটকা পড়েছেন।’
এদিকে ঢাকায় শিল্পমন্ত্রীর পিএস সামসুল আরেফিন বলেন, ‘মন্ত্রী একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কাতারে গেছেন। সেখান থেকে গতকাল তার সউদী আরব যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেশটিতে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে তিনি ঢাকায় ফিরে আসছেন। আজ তিনি আবার  ওমরাহ করার জন্য সউদী আরব যাবেন।’
সউদী আরবের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ কাতারের
কাতারের সঙ্গে ছয় দেশের সম্পর্ক ছিন্নের জবাবে পাল্টা পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে দোহা। সউদী আরবের সঙ্গে সাময়িক ফ্লাইট চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্স কাতার এয়ারওয়েজ। অনতিবিলম্বে তা কার্যকর করার কথাও বলা হয়েছে। এর আগে সউদী আরবের পক্ষ থেকেও কাতারের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। দোহাভিত্তিক এয়ারলাইন্সটির পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গ্রিনিচ মান সময় ১১:৫৯ পর্যন্ত সউদী আরবের সঙ্গে সব ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রাখছে কাতার এয়ারওয়েজ।’
এক মুখপাত্র বলেন, ফ্লাইট চলাচল বন্ধের মেয়াদ আরও বাড়ানো হবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়।
এদিকে পররাষ্ট্র দফতরের এক বিবৃতিতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কাতারের রাজধানী দোহা থেকে কূটনৈতিক মিশন প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেয় বাহরাইন। বাহরাইনে নিয়োজিত কাতারের কূটনীতিকদেরও ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় ওই বিবৃতিতে। সংযুক্ত আরব আমিরাতও কাতারি কূটনীতিকদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশে ফিরে যেতে বলেছে।
মিসরের পররাষ্ট্র দফতরের বিবৃতিতে জানানো হয়, জাতীয় নিরাপত্তার সুরক্ষা নিশ্চিতে দেশটি নিজস্ব আকাশসীমা ও সমুদ্র বন্দর দিয়ে কাতারি পরিবহনের প্রবেশ বন্ধ রাখছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিমান ইতিহাদ এয়ারওয়েজ জানিয়েছে,  আজ (মঙ্গলবার) সকাল থেকে কাতারের সঙ্গে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রাখা হবে। সউদী আরবও কাতারের সঙ্গে তাদের সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে আকাশ ও নৌ পথে যান চলাচলও বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়।
বাড়লো তেলের দাম
কাতারের সঙ্গে সউদী আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লিবিয়া, ইয়েমেন ও বাহরাইনের সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণার পর পরই বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দামে ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে। তেলের আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ট ১.১ শতাংশ বেড়ে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৫০.৪৮ শতাংশ হয়েছে। আর ইউএস হেনরি হাবে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ১.৩৭ শতাংশ বেড়ে মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট প্রতি ৩.০৪০ ডলার হয়েছে। গতকাল সকালে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয় সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশ।
আর এ ঘোষণার প্রভাব পড়তে দেখা যায় বিশ্ব বাজারে। জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বেড়ে যায়।
উল্লেখ্য, সউদী আরব বিশ্বের বড় তেল রফতানিকারক দেশগুলোর একটি। সংযুক্ত আরব আমিরাতও তাই। আর বিশ্বে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), কম ঘনত্বের তরল জ্বালানি এবং প্রাকৃতিক গ্যাসজাত শোধিত দ্রব্যের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী দেশ কাতার। বিশ্বের মোট এলএনজি চাহিদার প্রায় এক তৃতীয়াংশই কাতার সরবরাহ করে থাকে। কাতারের তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের নিয়মিত ক্রেতা মিসর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। থমসন রয়টার্স এইকনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে প্রতিমাসে ৮ লাখ ৫৭ হাজার ঘন মিটার তরল গ্যাস কাতার থেকে আমদানি করেছে মিসর। আর একইসময়ে এক লাখ ৯০ হাজার ঘন মিটার গ্যাস কাতার থেকে আমদানি করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।
কাতার কতটুুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
আল-জাজিরা : আন্তর্জাতিক এই গণমাধ্যম ক্ষুদ্র কাতারকে পরিচিত করতে সাহায্য করেছে। কাতারের সাথে সউদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মিসরসহ ছ’টি দেশ শুধু কূটনৈতিক সম্পর্কই ছিন্ন করেনি, একই সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কও ভেঙে পড়বে। তাহলে, আঞ্চলিক সম্পর্কের হঠাৎ এই অবনতির কী প্রভাব পড়বে কাতারের অর্থনীতিতে এবং সেই দেশের অধিবাসীদের ওপরে?
মাত্র ২৭ লাখ মানুষের বসবাস আরব উপদ্বীপের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই ছোট রাষ্ট্রে। তবে কাতার তার ওজনের চেয়ে অনেক ওপরের পর্যায়ে খেলার চেষ্টা করে। মানুষ কাতারকে চেনে ঠিকই, কিন্তু তার জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে আংশিকভাবে দেশের জাতীয় বিমান পরিবহন সংস্থা কাতার এয়ারওয়েজকে এবং তার আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরাকে।
আরো পরিচিতি এসেছে ক্রীড়া জগতে কিছু সাফল্যের মাধ্যমে, যেমন ২০২২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের অধিকার অর্জন এবং বিশ্বের সব চেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল দলগুলোর মধ্যে অন্যতম বার্সেলোনাকে স্পন্সর করে। আর রাজধানী দোহার ব্যাপক আধুনিক উন্নয়নের মাধ্যমে অনেক বহুজাতিক কোম্পানিকে সেখানে অফিস খুলতে অকৃষ্ট করেছে। কাজেই, এই সঙ্কট অনেক কিছুকেই প্রভাবিত করতে পারে।
কাতার এয়ারওয়েজ : আবু ধাবির এতিহাদ এয়ারওয়েজ এবং দুবাই-ভিত্তিক এমিরেটস আজ (মঙ্গলবার) থেকে তাদের দোহাগামী বা দোহা থেকে সকল ফ্লাইট স্থগিত করবে। বর্তমানে এই দুই বিমান সংস্থা দোহাতে দিনে চারটি ফ্লাইট পরিচালনা করে।
স্বল্প ব্যয়ের বিমান সংস্থা ফ্লাইদুবাই এবং এয়ার অ্যারাবিয়াও তাদের দোহা ফ্লাইটগুলো বাতিল করছে। ধারণা করা হচ্ছে, অন্যান্য বিমান সংস্থা যেমন বাহরাইনের গালফ এয়ার এবং মিসরের ইজিপ্টএয়ারও তাদের দোহা ফ্লাইট বাতিল করবে। এর আগে সউদী আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশর ঘোষণা করে যে, তারা কাতারের সাথে বিমান যোগাযোগ ছিন্ন করবে এবং নিজেদের আকাশপথ কাতার এয়ারওয়েজের জন্য বন্ধ করে দেবে।
কাতারের জাতীয় বিমান সংস্থা এখানে সব চেয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। প্রথমত, দুবাই, আবু ধাবি, রিয়াদ এবং কায়রোর মত জায়গায় তাদের ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাবে। তার মানে, দিনে কয়েক ডজন ফ্লাইট। তারা ইতোমধ্যেই সউদী আরবের সাথে তাদের সকল ফ্লাইট বাতিল করেছে।
কিন্তু অঞ্চলের আকাশপথের একটি বড় অংশ তার জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা বাধ্য হবে তাদের যাত্রাপথ বদলাতে। এর ফলে অনেক রুটে সময় বেশি লাগবে।
সময় বাড়লে শুধু বেশি জ্বালানি খরচ হবে তাই না, যাত্রীদের মন-মেজাজও খারাপ হতে পারে। কাতার এয়ারওয়েজ তার ব্যবসা স¤প্রসারণ করেছে নিজেকে একটি ‘হাব এয়ারলাইন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, দোহার মাধ্যমে ইউরোপ এবং এশিয়াকে যুক্ত করে।
রাজধানী দোহা : অনেক বহুজাতিক কোম্পানি সেখানে অফিস খুলেছে। ‘ইউরোপে যাবার যে যাত্রা আগে ছয় ঘণ্টা লাগতো, সেটা যদি এখন রুট বদল করার ফলে আট-নয় ঘণ্টা লাগে তাহলে যাত্রীদের জন্য আর সুবিধাজনক থাকবে না এবং তারা বিকল্প খুঁজতে পারে,’ বলছেন করনারস্টোন গেøাবাল নামে একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির পরিচালক ঘানেম নুসেইবেহ।
খাদ্য
মরুভূমির দেশগুলোর স্বাভাবিক কারণেই খাদ্য ফলাতে কষ্ট হয়। খাদ্য নিরাপত্তা কাতারের জন্য বড় একটি বিষয়, কারণ স্থলপথে দেশে প্রবেশ করার একটিই পথ এবং সেটা হচ্ছে সউদী আরব সীমান্ত দিয়ে। প্রতিদিন শত শত ট্রাক এই সীমান্ত দিয়ে আসে এবং খাদ্যদ্রব্য তাদের মালামালের একটি বড় অংশ। ধারণা করা হয়, কাতারের খাদ্য আমদানির ৪০ শতাংশ এই পথে আসে। সউদী আরব বলেছে, তারা এই সীমান্ত বন্ধ করে দেবে এবং ট্রাক আসা বন্ধ হলে কাতার বিমান এবং সমুদ্রপথে মালামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ‘এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে যেটা সাধারণ মানুষকে সরাসরি আঘাত করবে,’ -বলছেন মিঃ নুসেইবেহ।
‘যদি জিনিসপত্রের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে, তাহলে আপনি দেখবেন সরকার বদলের দাবিতে বা দেশের নীতি পরিবর্তনের জন্য রাজকীয় পরিবারের ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়তে থাকবে’।
নির্মাণ শিল্প
কাতারে এই মুহূর্তে কয়েকটি বড় নির্মাণ প্রকল্প চলছে, যাদের মধ্যে আছে একটি নতুন বন্দর, মেডিকেল এলাকা, মেট্রো প্রকল্প এবং ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য আটটি স্টেডিয়াম।
নির্মাণ শিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন কনক্রিট এবং ইস্পাত জাহাজে আসলেও স্থলপথ দিয়ে সউদী আরব হয়েও আসে। সীমান্ত বন্ধ হলে খাদ্যদ্রব্যের মত নির্মাণ উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাবে এবং কাজ সময়মত শেষ করা কঠিন হয়ে যাবে। দীর্ঘ সময়ের জন্য আকাশপথ এবং স্থলপথ বন্ধ হলে বিশ্বকাপ প্রস্তুতির সময়সীমা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
জনগণ
সউদী সরকার বলেছে, সম্পর্ক ছিন্ন করার অংশ হিসেবে সউদী আরব, মিসর, বাহরাইন, আরব আমিরাত, লিবিয়া এবং ইয়েমেনের নাগরিকদের কাতারে যাওয়া, সেখানে বসবাস করা বা কাতার হয়ে অন্য কোন দেশে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদেরকে ১৪ দিনের মধ্যে কাতার ছাড়তে বলা হয়েছে। একই সাথে সউদী আরব, আরব আমিরাত এবং বাহরাইনে বসবাসরত কাতারিদেরও একই সময়ের মধ্যে চলে যেতে বলা হয়েছে। তবে মিসর যদি একই রকম নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাহলে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। সা¤প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, কাতারে এক লাখ আশি হাজার মিসরীয় নাগরিক বাস করছে, যাদের বেশিরভাগ নির্মাণ শিল্পের পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি এবং আইন পেশায় কর্মরত। এ বিশাল কর্মী বাহিনী কাতার ছেড়ে চলে গেলে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়বে।
আল-জাজিরা বন্ধ করছে সউদী আরব
সউদী আরবে কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার স¤প্রচারের লাইসেন্স বাতিল এবং কার্যালয় বন্ধের জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছে সউদী সরকার। দেশটির সাংবাদিকদের কাতারভিত্তিক এ সংবাদ মাধ্যমের চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসারও আহŸান জানিয়েছে সউদী সরকার।
পরে হুতিদের সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগে দোহার সঙ্গে ইয়েমেন কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এরপর একই সিদ্ধান্ত আসে মালদ্বীপের পক্ষ থেকেও। সউদী আরবের রিয়াদে আরব ইসলামিক অ্যামেরিকান সামিটের প্রায় এক সপ্তাহ পর এ ধরনের ঘোষণা আসল। কাতারের একটি বার্তা সংস্থা সেদেশের আমিরের বক্তব্য প্রকাশ করেছিল। যেখানে তিনি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলেন।
ওই ঘটনার পর কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ওই এজেন্সির সাইট হ্যাক করে হ্যাকাররা আমিরের বক্তব্য প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে কাতারের আমিরের কিছুই করার ছিল না। আঞ্চলিকভাবে ইরানের সঙ্গে সউদী আরবের মত পার্থক্যের কারণে আগে থেকেই দ্ব›দ্ব চলছে। সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, ডয়েচে ভেলে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন