মুহাম্মদ বশির উল্লাহ
পবিত্র রমজান মাস। আমলের মাস। এ মাসের প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মুহুর্ত এবং দিন রাত পরিকল্পনা ও হিসাব করে ব্যয় করাই মুমিন তথা ঈমানদার বুদ্ধিমানের কাজ। নি¤েœ রমজানের গুরুত্ব পূর্ণ কিছু আমলের আলোচনা পাঠকদের খেদমতে তুলে ধরা হলো।
গুনাহ বর্জন ঃ রমজানের প্রথম কাজ, সর্বপ্রকার পাপাচার ত্যাগ করা। কারণ, গুনাহ সকল প্রকার ইবাদতের নুর ও ফলাফল বিনষ্ট করে দেয়। আর মহামূল্যবান তাকওয়ার এটাই মূল দাবী।
বেশি বেশি নফল ইবাদত ঃ রমজান মাসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম নফল নামাজের পরিমান বাড়িয়ে দিতেন। যেহেতু রোজা ও নামাজ একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ জন্য বেশি বেশি নফল নামাজ পড়াও একটি অন্যতম আমল। কারন, এ মাসের একটি নফল অন্য মাসের একটি ফরজতুল্য। ফরমানে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম হচ্ছে, মাগরিবের নামাজের পর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ছয় রাকাত আউয়াবিন নামাজ পড়তেন। হযরত আবু হুরায়রা রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মাগরিব নামাজের পর ছয় রাকাত নামাজ পড়বে, যার মধ্যে সে কোন প্রকার দুনিয়াবি কথা বলবে না, তাহলে এ নামাজের বিনিময়ে মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহু তাকে ১২ বছর নফল ইবাদতের সমপরিমান ছাওয়াব দান করবেন। (তিরমিযী) এ ছাড়াও রয়েছে ফজরের পরে এশরাকের নামাজ, চাশতের নামাজ, ছালাতুল তাছবীহ, হাজতের নামাজ ইত্যাদি অনেক অনেক ফজিলতপূর্ণ আমল।
তাহাজ্জুদ নামাজ ঃ ইসলামের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার পূর্বে তাহাজ্জুদ নামাজ ফরজ ছিলো। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তা’আলা নফল নামাজের মধ্যে একমাত্র তাহাজ্জুদ নামাজের কথাই উল্লেখ করেছেন। নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা নবী রাসূলদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো। তাছাড়া পৃথিবীতে এমন কোন ওলি-আল্লাহ, গাউস-কুতুব, পির-মাসায়েখ নেই যারা বিশেষ করে তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত ছিলেন না। সুতরাং এ আমলটি প্রতেক মুসলমানদের জন্য অতীব জরুরি। কেননা, বান্দা রাতের শেষ প্রহরে মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহু’র সবচেয়ে বেশি নৈকট্য অর্জন করতে পারে এ তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে।
এস্তেগফার ও তাওবা ঃ দু’আরই অংশ গুনাহ মাফ চাওয়া। গুনাহ মাফের পূর্বশর্ত হলো অনুতপ্ত ও লজ্জিত হওয়া। নিজেকে ছোট ও গুনাহগার মনে করে কায়োমনোবাক্যে চোখের পানি ফেলে মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহু’র শাহি দরবারে দু’আ করা। কারণ, এ মাসে তাওবা কবুল ও গুনাহ মাফের নিশ্চয়তা রয়েছে।
নেক আমলের প্রতিযোগিতা ঃ এই মাসে মহান আল্লাহ তা’আলা বান্দার আমলী প্রতিযোগিতা দেখতে পছন্দ করেন। সুতরাং নিজের জানা শোনা যে কারো চেয়ে যেন আমার আমল সুন্দর ও বেশি হয় সেদিক লক্ষ্য রাখতে হবে।
ধৈর্য্য ও সহনশীলতা ঃ হাদীসে মাহে রমজানকে ছবরের মাস বলা হয়েছে। আর এটাও বলা হয়েছে যে, ছবরের প্রতিদান হলো জান্নাত। ছবর তিন প্রকার।
ইবাদতে নিজেকে ধৈয্যের সাথে যুক্ত করে রাখা।
অস্থির না হওয়া।
গুনাহ কাজের সম্মুখীন হলে নিজেকে সংযত রাখা এবং কোন বিপদের মুখোমুখি হলে ধৈর্য ধারণ করা।
সহমর্মিতা ও পরোপকার ঃ হাদীস শরিফে মাহে রমজানকে সহমর্মিতা ও পরোপকারের মাস বলা হয়েছে। উম্মুল মু’মিনীন সায়্যিদাতুনা আয়িশা সিদ্দীকা রাদি-আল্লাহ তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর বদান্যতা রমজানে অনেক বেড়ে যেত। সুতরাং এ মাসটি দান ও পরোপকারের ব্যাপারে বিশেষ যতœ নেয়ার মাস।
অধিক পরিমাণ দান ঃ এ মাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো, অধিক পরিমাণ দান সদকা করা। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এ মাসে সকল বন্দিকে মুক্তি দান করতেন এবং কোনো ভিক্ষুককে খালি হাতে ফিরাতেন না। বর্ণিত আছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম পবিত্র রমজান মাসে প্রবাহমান বায়ূর চেয়ে অধিক পরিমাণে দান-ছদকা করতেন। সুতরাং রমজান মাসে প্রতেকের নিকটাত্মীয়, মাদরাসা, মাসজিদ, লিল্লাহ বোডিং ও ইয়াতিম খানায় বেশি বেশি দান সদকা করা আবশ্যক।
কর্মচারিদের কাজ হালকা করে দেয়া ঃ পবিত্র রমজানে নিজের অধিনস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারি ও চাকরদের কাজ হালকা করে দেয়া অত্যন্ত সাওয়াবের কাজ। কেননা, এটা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর নির্দেশ। হাদীস শরিফে আছে, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করবে, মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহুও তার প্রতিদান দান করবেন।
অধিক হারে দু’আ ঃ উম্মুল মু’মিনীন সায়্যিদাতুনা আয়িশা সিদ্দীকা রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহা বলেন, রমজান এলে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর চেহারা মুবারক বিবর্ণ হয়ে যেত। নামাজ বেশি বেশি পড়তেন। অপূর্ব বিনয় ও ন¤্রতার সাথে প্রার্থনা করতেন। মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহু’র ভয় ভীতি তার হৃদয় মূলে বদ্ধমূল হয়ে যেত।
ইতিকাফ করা ঃ ইতিকাফ রমজানের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আর রমজানের অন্যান্য করণীয় ইবাদত শেষে একজন রোজাদারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ইতিকাফ করা। তাই রোজা পর্বের শেষপর্যায়ে আনয়ন করা হয়েছে ইতিকাফ। সিয়াম সাধনা মানুষকে ত্যাগের ও কৃচ্ছ্রতা সাধনের শিক্ষা দেয়। আর ইতিকাফ দুনিয়া ত্যাগের প্রবণতা শিক্ষা দেয় আর মহান আল্লাহ তা’আলার সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করে দেয় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে বান্দাকে মহান আল্লাহ তা’আলার সাথে সম্পর্কে জুড়ে দেয়। ফলে মানুষের মধ্যে মহান আল্লাহ তা’আলার ভালোবাসা সৃষ্টি হয়।
ইসলামে ইতিকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্তরকে একমাত্র মহান আল্লাহ তা’আলার প্রতি মনোনিবেশের প্রশিক্ষণ, সুন্নাত নিয়মে দুনিয়া বিরাগী হওয়ার এবং লাইলাতুল কদর তালাশ করার ক্ষেত্রে ইতিকাফ এর বিকল্প নেই। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম প্রতিবছর রমজান মাসে ইতিকাফ করতেন। একদা রমজান মাসে ও ইতিকাফ ছুটে গেলে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম তা শাওয়াল মাসে কাযা করে নেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর ইন্তিকালের পর উম্মুল মুমিনীনগণ ইতিকাফ করতেন।
ইতিকাফের মাধ্যমে শবে কদর খোঁজ করা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর মূল উদ্দেশ্য ছিল। হাদীসে এসেছে, হযরত আবু সায়িদ খুদরি রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেন, আমি প্রথম দশকে ইতিকাফ করেছি এই (কদর) রজনী খোঁজ করার উদ্দেশ্যে। অতঃপর ইতিকাফ করেছি মাঝের দশকে। মাঝ-দশক পেরিয়ে এলাম। তারপর আমাকে বলা হল, (কদর) তো শেষ দশকে। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ইতিকাফ করতে চায় সে যেন ইতিকাফ করে।’ অতঃপর লোকেরা তাঁর সাথে ইতিকাফ করল। (মুসলিম)
উম্মুল মু’মিনীন হযরতে সায়্যিদাতুনা আয়েশা সিদ্দীকা রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ’র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম কে মৃত্যু দান করার আগ পর্যন্ত তিনি নিয়মিতভাবে রমজান মাসের শেষ ১০দিন ইতিকাফ করতেন। তার পরে তার পবিত্রাতœা স্ত্রীগণও ইতিকাফ করতেন। ইতিকাফের সুন্নাত হলো অতি প্রয়োজন ছাড়া বাহিরে বের হবে না। অসুস্থ রোগীকে দেখতে যাবে না। নারীকে স্পর্শ করবেনা। জামে মাসজিদ ছাড়া ইতিকাফ করবেনা, রোজা ছাড়া ইতিকাফ করবে না। (রোজা ও তারাবীহ : ফাযাইল - মাসাইল, পৃষ্ঠা ১৩৮)
অধিক পরিমাণ দূরুদ শরিফ পাঠ করা : প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর উপর অধিক পরিমাণ দুরুদ শরিফ পাঠ করা সকল উম্মতে মুহাম্মদির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। যে কোনো আমল কবুল হওয়ার জন্য দুরুদ শরিফ শর্ত। দুরুদ শরিফ ব্যাতিত কোনো আমল কবুল হয় না। আজান, একামত, নামাজ, তিলাওয়াত সব জায়গায়ই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর সান ও মান রয়েছে। দুরুদ শরিফের রয়েছে অনেক ফজিলত। হাদিস তার প্রমাণ করে। হযরত আবু হুরায়রা রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দুরুদ শরিফ পাঠ করবে, মহান আল্লাহ তা’আলা তার প্রতি দশটি রহমাত নাযিল করবেন। (মুসলিম শরিফ)
হযরত আনাস রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দুরুদ শরিফ পাঠ করবে, মহান আল্লাহ তা’আলা তার প্রতি দশটি রহমাত নাযিল করবেন, দশটি গুনাহ ক্ষমা করবেন এবং দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিবেন। (নাসাঈ শরিফ)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর রহমাত রুপি ফরমান, ঐ ব্যক্তিই কিয়ামতের দিন আমার সবচেয়ে নিকটে থাকবে, যে আমার প্রতি বেশি বেশি দুরুদ শরিফ পাঠ করে। (তিরমিযী)
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নিশ্চয় দু’আ আকাশ ও যমীনের মাঝখানে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। তোমরা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর প্রতি সালাত ও সালাম পাঠ না করা পর্যন্ত দু’আ মোটেও উপরে উঠবে না। (তিরমিযী)
পরিশেষে মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহু আমাদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জাম’আতের মতাদর্শে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর সুন্নাহকে আকড়ে ধরে সঠিক আকিদা ও আমলের মাধ্যমে জীবন গঠনের তৈফিক এনায়েত করুণ। আমিন, ছুম্মা আমিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন