পলিথিনের ব্যবহার ও বিস্তার বাড়ছে। কোনোভাবেই তা রোখা যাচ্ছে না। সর্বত্র পলিথিনের ছড়াছড়ি দেখে বুঝার উপায় নেই, এটি নিষিদ্ধ। ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায় এবং ৩১ মার্চ দেশব্যাপী ২০ মাইক্রোনের চেয়ে পাতলা পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, মজুদ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত) ২০০২ তে, এ ব্যাগ উৎপাদন করলে ১০ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। বাজারজাত করলে ৬ মাসের জেল এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধানও রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা, আইন, শাস্তির বিধান কোনো কিছুই কোনো কাজ করছে না। বিএনপির আমলে যখন নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা ও আইন-বিধান করা হয় তখন গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কঠোরতার কারণে আশাব্যাঞ্জক সুফল পাওয়া যায়। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায় এবং পলিথিনের বিভিন্নমুখী ব্যবহারও হ্রাস পায়। কিন্তু এই অবস্থাটি পরবর্তীতে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আগে চুরি-চামরি করে বা গোপনে ব্যাগ উৎপাদিত হলেও এখন আর তার প্রয়োজন নেই। এখন প্রকাশ্যেই তৈরি, বাজারজাত ও ব্যবহৃত হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এই অবৈধ কারবারের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। ফলে উৎপাদনে যেমন কোনো বাধা ও প্রতিবন্ধকতা নেই, তেমনি নেই বাজারজাতকরণে। যেহেতু সর্বত্র সহজে ও সুলভে এটি পাওয়া যায় সুতরাং এর ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। এও অভিযোগ রয়েছে, একটি সিন্ডিকেট পলিথিন উৎপাদন-বাজারজাতকরণের সঙ্গে যুক্ত, যার সদস্যদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার পাশাপাশি সমাজে প্রভাবও রয়েছে। একারণে সামাজিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে বলার কেউ নেই। আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের, নেই আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ম্যানেজ করার ব্যবস্থাও আছে। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট এলাকার থানা-পুলিশের সদস্যরা নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকে। প্রকৃত বাস্তবতা যখন এই, তখন পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাত ও ব্যবহার উত্তরোত্তর বাড়ার কথা, কমার কথা নয়। বাস্তবেও সেটাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
পলিথিন পরিবেশঘাতক এবং জনস্বাস্থ্যর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে ড্রেনেজ সিস্টেম প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে পরিত্যক্ত পলিথিন ও বর্জ্যে । রাজধানীর চার পাশের সব নদী বিশেষ করে বুড়িগঙ্গায় কয়েক ফুটের পলিথিন বর্জ্য জমাট হয়ে আছে। এতে নদীর বুক ভরাট হয়ে গেছে এবং ওই জমাটবাঁধা পলিথিন অপসারণ করাও প্রায় অসম্ভব। অতীতে নেয়া চেষ্টা খুব একটা ফল দেয়নি। পলিথিন এমন একটি উপাদান যা ধ্বংস করা যায় না। পোড়ালেও এর অবশেষ মাটিতে মেশে না। মাটি, খালবিল, নদীনালা পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যে অনবরত দূষণ ও ক্ষতির শিকার হচ্ছে। মাটি উর্বরা শক্তি হারাচ্ছে। নদী-জলাশয় ভরাট হয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে। রাজধানী ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। এর প্রধান কারণ ড্রেনেজ সিস্টেমের অকার্যকারিতা। পলিথিন ও অন্যান্য অবিনাশযোগ্য বর্জ্যে ড্রেন ভরাট হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্জ্য অপসারণের মাধ্যমে ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নয়ন এবং এর অপ্রতুলতা দূর করার মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই জানিয়েছেন, আবাদী জমিতে পলিথিন জমলে জমি থেকে প্রত্যাশিত উৎপাদন পাওয়া যাবে না। কারণ, পলিথিনের, ওপর কিছুই জন্মায় না। জনস্বাস্থ্যর জন্যও পলিথিন খুবই হানিকর। পলিথিন ব্যাগে খাদ্য ও পণ্যাদি পরিবহন ও সংরক্ষণ এর গুণগত মান ক্ষুন্ন করে। তা ভক্ষণে গুরুত্বর স্বাস্থ্য সমস্যা বা রোগব্যাধি হতে পারে বলে চিকিৎসাবিদদের অভিমত। কৃষি বিশেষজ্ঞদের আশংকা, আবাদী জমিতে অবিনাশী পলিথিন ও অন্যান্য বর্জ্য মিশ্রণের ফলে উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, যা খাদ্য চাহিদা পূরন ও খাদ্য নিরাপত্ত নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে হুমকি স্বরূপ। বলা বাহুল্য, পরিবেশ সুরক্ষা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিধান, মসৃন পয়:নিকাষ ব্যবস্থা এবং নদী-জলাশয় ও জমি রক্ষায় পলিথিনের ব্যবহার সম্পূর্ণ রহিত করার বিকল্প নেই।
আইন করে সুফল পাওয়া যাবেই, এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। আবার ধরপাকড় বা অভিযান চালালেই নিষিদ্ধ বস্তু বিক্রী ও ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে, এটাও কারো পক্ষে হলফ করে বলা সম্ভব নয়। পলিথিনের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আইন আছে; তার কার্যকারিতা নেই। পলিথিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে মাঝে-মধ্যে অভিযান হয়েছে; প্রত্যাশিত ফল মেলেনি। বাস্তবে বরং দেখা গেছে, পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার বেড়েছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, রাজধানীতে এক হাজারের বেশি অবৈধ পলিথিন কারখানা আছে এবং পুরানো ঢাকাতেই আছে তিন শতাধিক। দেশের অন্যত্রও কারখানা আছে। এসব কারখানা থেকে রাতদিন পলিথিন ব্যাগ তৈরি হচ্ছে এবং মানুষের হাতে হাতে চলে যাচ্ছে। দেশকে পলিথিন ব্যাগমুক্ত করতে হলে প্রথমত, পলিথিনের উপাদান আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ অথবা সীমিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কারখানাগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। তৃতীয়ত, পলিথিন ব্যাগ বিক্রেতা ও ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে শান্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। চতুর্থত, পলিথিনের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। পঞ্চমত, এ ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকর অবদান রাখতে পারে পলিথিনের বিকল্প। উপযুক্ত বিকল্প সহজলভ্য হলে পলিথিনের ব্যবহার কমবে। আগেই আমরা উল্লেখ করেছি, শুরুতে পলিথিন বিরোধী পদক্ষেপ প্রত্যাশা জাগালেও পরবর্তীতে তা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। পাটের ব্যাগ পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসাবে উপস্থাপন করা হলেও কর্তৃপক্ষীয় অবহেলার কারণে পাটের ব্যাগ স্থায়ী হতে পারেনি। তবে অন্য বিকল্প হিসাবে কাগজের ব্যাগ এখনো টিকে আছে এবং তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। জানা গেছে, পাটের পলিব্যাগ তৈরি ও বাজারজাত করার একটি উদ্যোগ সরকার নিয়েছে। এটি পলিথিন ব্যাগের মতোই পাতলা ও টেকসই। মূল্যও হবে একইরকম। পাটের এই পলিব্যাগ অবিষ্কার করেছে দেশেরই একদল বিজ্ঞানী। জানা গেছে, দুতিন মাসের মধ্যে এর বাণিজ্যক উৎপাদন শুরু হতে পারে। পাটের পলিব্যাগ পরিবেশ বান্ধব সহজে বহণযোগ্য এবং অবিনাশী নয়। সুতরাং এর উৎপাদন ও বাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হবে যদি যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যে কোনো মূল্যে পলিথিনের অভিযান থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন