আশশারক আল-আওসাত : পাঁচটি আরব দেশের কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত কাতার ও তার প্রতিবেশীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের গোলযোগের কাহিনীতে নতুন অধ্যায় যোগ করেছে। দোহা ও উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) মধ্যে কয়েক বছর ধরেই একটি বিভক্তি জন্ম নিচ্ছিল। সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে ২০১১ সালের আরব বসন্তের ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা কিভাবে হবে এবং সেগুলোর ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া নিয়ে এ সব দেশগুলোর মধ্যে আপস অযোগ্য মতপার্থক্য। জিসিসি প্রতিবেশীদের বিপরীতে কাতার আরব বিশে^ শাসক পরিবর্তনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছে। কাতারিরা মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড, গাজায় হামাস, তিউনিসিয়ায় আন নাহদা পার্টি এবং লিবিয়া ও সিরিয়ায় অসংখ্য মিলিশিয়া গ্রæপসহ বহু খেলোয়াড়কে অর্থ প্রদান এবং অনুকূল মিডিয়া সহায়তা দিয়েছে।
এর জবাবে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও সউদি আরব এ অঞ্চলে জোরপূর্বক কাতারিদের স্বার্থে বাধা দান, মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য মিসরের প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত, সিরিয়ায় প্রতিদ্ব›দ্বী বিরোধী গ্রæপকে অর্থপ্রদান ও লিবিয়ার জেনারেল খলিফা হাফতারের সরকারকে সমর্থন করছে।
যদিও সউদি ও আমিরাতিরা কাতারের আঞ্চলিক কর্মকান্ডে বাধা দিচ্ছে, কাতারের শাসকরা কোনো ঝামেলায় যাননি। কাতারের আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল সানি ও তার জ্ঞাতি প্রধানমন্ত্রী হামাদ বিন জসিম আল সানি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের পাকা খেলোয়াড়। গত ২০ বছর ধরে তারা মৌরিতানিয়া থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে কাতার ব্র্যান্ডের একটি জোট তৈরি করেছেন। ২০১৩ সালের আগস্টে পুত্র তামিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে কাতারের আমির হামাদের সিদ্ধান্ত সউদি ও আমিরাতিদের তরুণ আমিরকে লাইনে আনার জন্য চাপ সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করে।
কাতারের পররাষ্ট্র নীতির প্রতি ক্রমাগত বৈরী পরিবেশে আল জাজিরা আঞ্চলিক দর্শকদের রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছিল এবং কাতারের পররাষ্ট্রনীতি জিসিসি-র চাপের মুখে ক্রমেই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল।
তাই সউদি, আমিরাতি ও বাহরাইনিরা কাতারের আঞ্চলিক কর্মকান্ড থেকে সরে আসতে তামিমের প্রতি আহবান জানায়। ছয় মাসের ব্যর্থ আলোচনার পর প্রতিবাদ হিসেবে তিনটি দেশ ২০১৪ সালের গোড়ার দিকে দোহা থেকে তাদের রাষ্টদূতদের প্রত্যাহার করে।
কুয়েতের আমিরের সাহায্যে কাতার কয়েক দফা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পর তিনটি দেশের প্রত্যেকের শর্ত মেনে নিতে সম্মত হয়। ফলে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে জিসিসি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই সম্পর্ক মেরামত হয় । তবে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তা সম্পূর্ণ ঠিক হয়নি। ঐ সময় বাদশাহ সালমান দোহা সফর করেন ও সব বিরোধের প্রকাশ্য অবসান ঘটে।
তবে সকল প্রকার সদিচ্ছা সত্তে¡ও বিরোধের গভীরে যে মূল সমস্যা তা অন্তর্নিহিত থাকায় তা কখনো নিরসন হয়নি। কাতারিরা যখন আল জাজিরার কার্যক্রম সীমিত করে এবং দোহা থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডের কিছু সদস্যকে উৎখাত করে আঞ্চলিক অভিনেতা হিসেবে তাদের উচ্চাকাক্সক্ষা অব্যাহত রাখে, সে সাথে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ইসলামের সাথে তাদের বন্ধুত্ব বহাল রাখে যে বন্ধুত্ব বিশেষ করে ইউএই-র কাছে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কাতার জিসিসি-র বাইরে আরো একবার পা ফেলে। মুসলিম ব্রাদারহুড ও আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট গ্রæপগুলোর সাথে কাতারের যোগাযোগ সউদি আরব ও ইউএইর জন্য পীড়াদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। ইরানের আঞ্চলিক সহযোগীদের সাথে তার বাণিজ্য যোগাযোগ তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এপ্রিলে কাতার সে দেশে জনসংখ্যা স্থানান্তরের নিশ্চয়তার জন্য আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট হায়াত তাহরির আল শামের সাথে যোগাযোগ করে। কাতার ইরানের সাথে যোগাযোগ সাপেক্ষে জিম্মি মুক্তির চুক্তি করে যার ফলে ইরান অনুগত মিলিশিয়া গ্রæপ কাতাইব হেজবুল্লাহকে ইরাকে অপহৃত ২৬ জন কাতারি শাসক পরিবারের সদস্যদের মুক্তির জন্য মোটা পরিমাণ অর্থ দেয়া হয়।
কাতার হামাসকে প্রকাশ্যে তার রিব্রান্ডে সাহায্য করে এবং গ্রæপটি মে মাসে দোহায় এক হোটেলে নয়া নীতি লক্ষ্য চালু করে।
যুক্তরাষ্ট্র একজন প্রধান অভিনেতা হিসেবে কাজ করেছে যা থেকে সউদি আরব অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে রিয়াদ যুক্তরাষ্ট্রের আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে , ট্রাম্পের সফরকালে আরো আমেরিকান অস্ত্র কেনার প্রতিশ্রæতি দিয়ে সাহায্য করেছে। সউদিরা কাতারিদের বিরদ্ধে চাপ জোরদার করার ক্ষেত্রে নিজেদের আরো শক্তিমান মনে করেছে এতে কমই সন্দেহ আছে।
আমিরাতিরাও নিজেদের নয়া মার্কিন প্রশাসনের আনুকূল্যপ্রাপ্ত হিসেবে দেখছে। ইরান ও ইসলামপন্থীদের প্রতি যাদের ভীষণ অপছন্দ, ইউএই-র নীতি অগ্রাধিকারের সাথে তাদের মেলে। একইভাবে সউদি আরব ও ইউএই-র মধ্যে নবলব্ধ আত্মবিশ^াস দেখা গেছে যে কাতারিদের তাদের বাক্সের মধ্যে ফেরত যেতে বাধ্য করা ওয়াশিংটনের সমর্থন পাবে।
২০১৪ সালে কাতারকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা দোহার আচরণের উপর কোনো দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেনি। এটা আশ্চর্য নয় যে এবার সউদি আরব নাটকীয়ভাবে কাতারের একমাত্র স্থল সীমান্ত (শুধু সউদি আরবের সাথে তার স্থল লীমান্ত রয়েছে) বন্ধ করে দিয়েছে এবং ইউএই ও মিসরের সাথে সাথে বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে ও মিসর কাতার এয়ার ওয়েজের জন্য তার আকাশসীমা বন্ধ করেছে।
স্থল সীমান্ত বন্ধ ও বিমান চলাচল ব্যাহত হওয়ার ঘটনা কাতারের অর্থনীতি ও তার সমাজের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে যা কাতারের মত ধনী রাষ্ট্রের জন্যও অত্যন্ত ব্যয়বহুল ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কাতারের সাথে যদি প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক তথা জিসিসি দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক যদি স্বাভাবিক পর্যায়ে না আসে তবে তার জন্য গুরুতর মাশুল দিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন