মোহাম্মদ আবদুল গফুর
এটা কি করে ঘটতে পারলো? দেশের দুটি বৃহৎ দলের অন্যতম বিএনপির মহা সচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের গাড়ী বহরে রাঙ্গুনিয়ায় হামলা চালালো সরকার দলীয় কর্মীরা। বিএনপি শুধু দেশের দুটি প্রধান দলের অন্যতমই নয়। একাধিক বার অবাধ নির্বাচনে জয়ী হয়ে বাংলাদেশে সরকার গঠন করেছে। নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচনে দেশে যে দু’টি রাজনৈতিক দল পর পর বিজয়ী হয়ে একাধিক বার দেশ চালনার সুযোগ লাভ করে তার একটি বিএনপি, আরেকটি আওয়ামী লীগ।
এহেন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের গাড়ী বহরে হামলা দেশে গণতন্ত্রের উপর হামলা হিসাবেই বিবেচিত হবে। এদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ এ হামলাতে এতটাই বিক্ষুব্ধ হয়েছে যে, এ হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলই। এমন কি যে দলের কর্মীরা এ হামলা চালিয়েছে, সেই দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদেরও এ হামলার নিন্দা না করে পারেননি।
এ প্রেক্ষাপটেই প্রশ্ন জাগে, যে দলের কর্মীরা এ অনাকাংখিত হামলা চালিয়েছে, সে দলের সাধারণ সম্পাদকও যদি হামলার বিরোধী হন তাহলে এ হামলা আদৌ ঘটতে পারলো কী করে, এর রহস্য কোথায়? এর প্রকৃত রহস্য বুঝতে হলে যেতে হবে আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গভীরে। একথা সবাই জানেন আমাদের দেশে পাকিস্তান আমলে বেসামরিক ও সামরিক ব্যুরোক্রাটদের অতিরিক্ত ক্ষমতা-ক্ষুধার কারণে ঐ আমলে দেশে কখনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থিতিশীলতা লাভ করতে পারেনি।
এ কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম দাবীই ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে যে কোন মূল্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর দেশের প্রথম সংবিধানে যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি স্থান লাভ করে তার মধ্যে একমাত্র গণতন্ত্রই যে আগাগোড়া অপরিবর্তিত থাকে, তার কারণ ছিল গণতন্ত্রের প্রতি এদেশের জনগণের অকুণ্ঠ এবং নি:শর্ত সমর্থন। কিন্তু দেশের অন্যতম প্রধান দল আওয়ামী লীগ যে আদৌ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না তার বড় প্রমাণ, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম (আওয়ামী নেতৃত্বাধীন) সরকারের আমলেই গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একটি মাত্র সরকারী দল রেখে দেশে এক দলীয় বাকশালী ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। শুধু তাই নয়, গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করে দেশে চারটি মাত্র সরকারী দৈনিক পত্রিকা রেখে অন্য সব দৈনিক বন্ধ করে দেয়া হয়।
বহু দু:খজনক ঘটনার মধ্যদিয়ে দেশে বহু দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুন:প্রতিষ্ঠিত হলেও এক পর্যায়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে দেশে সেনাশাসন প্রতিষ্ঠা করে বসেন তদানীন্তন সেবা প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে সময় সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে ঐ সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন দিয়ে বসেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। এর কারণ সম্ভবত এই যে উৎখাত হওয়া ঐ নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। এতে কী প্রমাণিত হলো? প্রমাণিত হলো আওয়ামী নেত্রীর কাছে নির্বাচিত সরকারের চাইতে সেদিন অধিক গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল সামরিক ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেলের শাসন।
এর পর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের একটানা দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসন। স্বৈরাচারী সে শাসনের বিরুদ্ধে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করলেও আওয়ামী লীগ প্রথম দিকে বহু দিন সে আন্দোলনে যোগ দেয়নি। ফলে রাজনীতিতে নবাগতা বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আপোষহীন নেত্রী হিসাবে জনগণের কাছে আবির্ভূত হন। বহু পরে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিলেও স্বৈরাচার বিরোধী নেত্রী হিসাবে খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তির মত উচ্চতায় উঠতে সক্ষম হননি। তার প্রমাণ পাওয়া যায় দেশকে গণতন্ত্রের ফিরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত পরবর্তী নির্বাচন।
এ নির্বাচন যাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় সে লক্ষ্যে দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন প্রশ্নে একমত হয়। যেমনটা আশা করা গিয়েছিল নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু ও অবাধ হয়। নির্বাচনে নিজস্ব ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ভোট দানের পর সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতাকালে এক পর্যায়ে বলেন, আমি সব জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন ভোটে হেরে গিয়ে কেউ যেন এর মধ্যে আবার কারচুপি আবিষ্কার না করে। ভোট গণনা শেষে যখন জানা গেল, আওয়ামী লীগ নয়, নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি, শেখ হাসিনা অবলীলাক্রমে বলে ফেললেন, নির্বাচনে সূ² কারচুপি হয়েছে। এর অর্থ হলো আওয়ামী নেত্রীর দৃষ্টিতে নির্বাচন যত সুষ্ঠুই হোক আওয়ামী লীগের বিজয় না হলে ধরে নিতে হবে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে!
এটা কিন্তুু আওয়ামী লীগের গণতন্ত্রে আস্থার প্রমাণ বহন করে না। গণতন্ত্রে জনগণের অবাধ রায়ের স্থান সর্বোচ্চে। আর জনগণের আস্থা সব সময় যে একই দলের উপর থাকবে, তাও সঠিক নয়। যাহোক, এরশাদ-পরবর্তী আমলে প্রথম নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে আসন গ্রহণ করে। বিএনপির শাসন আমলের মেয়াদ-শেষে নতুন নির্বাচনের প্রশ্ন উঠলে প্রধানত তদানীন্তন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবীর মুখেই দেশে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান সংবিধানে বিধিবদ্ধ হয়।
এই বিধান মতে দেশে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে বেশ ক’টি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে পর পর দেশের দু’টি প্রধান দল বিজয়ী হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করে। এতে প্রমাণিত হয় নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনই এদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য সবচাইতে উপযুক্ত পদ্ধতি। কিন্তু এক পর্যায়ে অতিরিক্ত ক্ষমতা- ক্ষুধার কারণে এই সুন্দর পদ্ধতিটিকেও পচিয়ে ফেলা হয়। এরপর এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে সংবিধান পরিবর্তিত করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে বিএনপি আওয়ামী লীগের সাথে অতীত সমঝোতা লংঘনের অভিযোগ এনে সে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়।
দেশের একটি প্রধান দল নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ায় নির্বাচন হয়ে পড়ে অনেকটা অর্থহীন। বিএনপি সমর্থকরা তো দূরের কথা, অনেক আওয়ামী নেতাকর্মীও কষ্ট করে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার গরজ অনুভব করেননি। তারা নিশ্চিত ছিলেন, বিরোধী দল বিহীন এ ভোটে তারা না গেলেও তাদের ভোট দানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাকর্মীদের মাধ্যমে। বাস্তবে হয়ও তাই। বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাকর্মীরা ইচ্ছামত ব্যালটপত্রে সীল মেরে আওয়ামী প্রার্থীদের ভোট সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে তোলার সুযোগ গ্রহণ করেন, যদিও ভোটকেন্দ্রগুলি ভোটের নির্দিষ্ট সময় ছিল প্রায় ফাঁকা।
জনগণ এ কারণে ৫ জানুয়ারীর এ নির্বাচনকে নাম দেয় ভোটারবিহীন নির্বাচন। বর্তমানে যে সরকার দেশ শাসন করছে, এই ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমেই সে সরকার ক্ষমতাসীন হয়। সুতরাং আনুষ্ঠানিকতার নিরিখে এ সরকার বৈধ হলেও নৈতিকতার নিরিখে এ সরকারের বৈধতার কোন ভিত্তি নেই। গণতন্ত্রের স্বার্থে দেশ-বিদেশে তাই বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন যাতে দেশের সকল রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় তার দাবী ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠছে।
এ গেল দেশে গণতন্ত্রের অতীত ও বর্তমান নিয়ে একটি বাস্তবতাভিত্তিক তথ্যসমৃদ্ধ পর্যালোচনা। এবার যে ঘটনার পটভূমিতে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের পর্যালোচনা, সেই ঘটনায় ফিরে আসা যাক। সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের গাড়ীবহরে সরকার দলীয় কর্মীরা রাঙ্গুনিয়ায় যে হামলা চালায় তার নিন্দা জানিয়েছে দেশের তাবৎ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। এ হামলা এমন ন্যাক্কারজনকভাবে প্রকাশ্যে চালানো হয়েছে যে, স্বয়ং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদেরও তার নিন্দা না জানিয়ে পারেননি। পরবর্তীকালে জানা গেছে, পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালায় আওয়ামী সমর্থক কিছু কর্মী।
বিশেষ লক্ষনীয় যে, আওয়ামী লীগে নেতা ওবায়দুল কাদের এ ঘটনার নিন্দা জানালেও এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এ ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেও এখনও এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি এবং অপরাধীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জনাব ওবায়দুল কাদেরের পরবর্তী মন্তব্যে বুঝা যাচ্ছে তিনি বিএনপি মহাসচিবের গাড়ী বহরে হামলার কথা অস্বীকার করার পটভূমি রচনায় মনোনিবেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি তো মাইনাসে আছে, আমি কেন তাকে প্লাস করতে যাব।
এটা এখন স্পষ্ট যে, বিএনপি মহাসচিবের গাড়ী বহরের উপর হামলার ব্যাপারে আওয়ামী সরকার হামলার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করবে না। অন্য কথায় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের জুলুমবাজির কোন প্রতিকার করতে আওয়ামী সরকার মোটেই প্রস্তুত নয়। আওয়ামী লীগের মহাসচিব জনাব ওবায়দুল কাদের যে বলেছেন, তিনি বিএনপিকে মাইনাস বলে মনে করেন, একথাও সত্য নয়। আসলে আওয়ামী সরকারের কর্মকাÐ প্রমাণ করে, তারা বিএনপিকে প্রচÐভাবে ভয় করে। তাই অবাধ নির্বাচনে বিএনপিকে মোকাবেলা করতে তারা ভয় পায়।
আওয়ামী লীগ যদি অবাধনির্বাচনে বিএনপিকে মোকাবেলা করতে ভয় না পেতো, তাহলে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিকে মোকাবেলা করতে রাজী হচ্ছে না কেন? অথচ এরশাদ পরবর্তী বেগম খালেদা সরকারের আমলে প্রধানত আওয়ামী নেত্রী শেখ হাসিনার দাবীতেই নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে সকল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান সংবিধানে বিধিবদ্ধ হয়েছিল। সেদিন শেখ হাসিনার নিকট যা এত গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল, তা এখন কেন ভীতিজনক মনে হচ্ছে আওয়ামী নেত্রীর কাছে, জনগণ যদি তা জানতে চায় তাঁর কী জবাব আছে?
রাঙ্গুনিয়ায় বিএনপির গাড়ী বহরে হামলা সম্পর্কে আরেকটি কথাও এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে। এ গাড়ী বহরে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ-সামগ্রীও নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এ গাড়ী বহরে হামলার মাধ্যমে সরকার দলীয় কর্মীরা শুধু গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্যও দায়ী বিবেচিত হতে বাধ্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন