সারাদেশে যখন বন্যার্ত মানুষ বেঁচে থাকার জন্য ন্যুনতম খাদ্য সংস্থানের জন্য হাহাকার করছে, তখন সরকারের একশ্রেনীর কর্মকর্তা-কর্মচারি সরকারী গুদামের চাল চুরিতে ব্যস্ত রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে দেশে ধানের বাম্পার উৎপাদন হওয়ার পরও কৃষকরা একদিকে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে অন্যদিকে খুচরা বাজারে চালের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির কারণে দরিদ্র মানুষের জীবন নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এপ্রিল মাসে হাওরাঞ্চলে অকাল বন্যা থেকে শুরু হওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখণ দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল গ্রাস করেছে। বন্যায় লাখ লাখ মানুষ যখন সরকারী ত্রাণের আশায় দিন গুনছে, তখন জানা গেল দেশের সরকারী খাদ্য গুদামগুলোতে চালের মজুদ সর্বনি¤œ স্তরে ঠেকেছে। যেখানে আপদকালীন মজুদ হিসেবে যে কোন সময় কমপক্ষে ১০ লাখ টন চাল সরকারী গুদামে মজুদ থাকার কথা, সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে চালের মজুদ একলাখ টনেরও কম। এহেন আপদকালে সরকার জরুরী ভিত্তিতে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানীর উদ্যোগ নিয়েছে। এই কঠিন সময়ে একশ্রেনীর সরকারী কর্মকর্তা তলানিতে থাকা সরকারী গুদামের চাল লুটে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সরকারী খাদ্য গুদামের মজুদ তসরুপ চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। প্রায় প্রতিমাসেই আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী হাতে দেশের কোথাও না কোথাও সরকারী খাদ্যগুদামের চালসহ সংশ্লিষ্টদের আটকের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক কয়েক মাসের চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গত মার্চমাসে আশুগঞ্জে একটি রাইসমিলে সরকারী গুদামের সিলমারা ৮০০ বস্তাচালসহ মিলমালিকও কয়েক জনকে আটক করে র্যাব। এপ্রিল মাসে নান্দাইলের কয়েকটি দোকান থেকে ২৩ বস্তা সরকারী খাদ্য কর্মসূচির ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রির চাল উদ্ধার করে স্থানীয় থানা পুলিশ। মে মাসে বরিশালের একটি খাদ্য গুদাম থেকে ২০০ বস্তা চাল পাচার করার দায়ে গুদামের ইনচার্জ ও খাদ্য পরিদর্শকসহ ৫জনকে মালামালসহ আটক করে র্যাব। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার র্যাবের অভিযানে চট্টগ্রামের একটি সরকারী খাদ্য গুদাম থেকে ৭টি ট্রাক বোঝাই ৩ হাজার ৯৬ বস্তা( ১৫৫টন) চাল পাচারকালে আটক হয়েছে খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রণয়ন চাকমা ওরফে মণি কৃষ্ণসহ ৫জন ট্রাক চালক। ১২টি ট্রাক ভর্তি হয়ে চাল পাচারের সময় র্যাবের অভিযান পরিচালিত হওয়ার মাঝখানে অবশিষ্ট ট্রাকগুলো পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় বলে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। সারাদেশে শত শত সরকারী খাদ্যগুদাম থেকে অহরহ চাল-গমসহ সরকারী খাদ্য সামগ্রী পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচারকৃত বা কালো বাজারে বিক্রিত সরকারী খাদ্য সামগ্রীর খুব সামান্যই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে। হাতে নাতে ধরা পড়ার পরও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর কোন আইনগত পদক্ষেপ না থাকায় সরকারী খাদ্যগুদামের সাথে সংশ্লিষ্ট একশ্রেনীর কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে বেপরোয়া লুন্ঠনে লিপ্ত হয়েছে।
অকাল বন্যা ও গেছে বøাস্ট রোগে লাখ লাখ টন ধান নষ্ট হওয়ার পর দেশে যখন চালের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, তখন মড়ার উপর ঘাড়ার ঘা’র মত প্রায় ২০ জেলায় দেখা দিয়েছে বন্যা। লাখ লাখ মানুষ যখন সরকারী ত্রানের জন্য হাহাকার করছে তখন জানা গেল সরকারী খাদ্যগুদামগুলো প্রায় ফাঁকা। মওসুমে কৃষকের কাছ থেকে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতার পাশাপাশি গুদামজাত চালের যথাযথ রক্ষনাবেক্ষন না থাকায় সরকারের সংশ্লিষ্টরা সম্ভবত: চালের মজুদ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পেতেও ব্যর্থ হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গুদাম থেকে শত শত টন চাল পাচার হওয়া ও ধরা পড়ার বাস্তবতা থেকে সরকারী খাদ্য সংরক্ষনে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা লুণ্ঠনের আংশিক চিত্র পাওয়া যায়। দেশের খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনায় বোঝা যাচ্ছে, সরকার একদিকে ধানে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারছেনা, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য রোধ করে খুচরা বাজারে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছেনা, অন্যদিকে আপদকালীন খাদ্য মজুদসহ সরকারী গুদামের খাদ্য সম্ভারের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে পারছেনা। চালের মত অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে চাল আমদানীকে শুল্ক কমানোর পরও বাজারে তার কোন ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়নি। অর্থাৎ শুল্ক রেয়াতের পুরো সুবিধাই চলে যাচ্ছে আমদানী কারক ও বিক্রেতাদের পকেটে। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় এনে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং খাদ্য মজুদ ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি যে কোন অনিয়ম, অস্বচ্ছতা ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন