দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, সরকারের এই দাবির যৌক্তিকতা এবার খুঁজে পাওয়া যায়নি। দেশ যদি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই হয় তবে চালের দাম হু হু করে বাড়বে কেন? একথা সত্য, হাওরে এ বছর নজিরবিহীন ফসলহানি হয়েছে, বøাস্ট রোগে দেশের বিভিন্নস্থানে ধানের বেশ ক্ষতি হয়েছে। শুধু এ কারণেই চালের দাম কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে যাবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। হাওরে ১০ লাখ টনের মতো উৎপাদন-ক্ষতি হয়েছে, বøাস্ট রোগ ও অন্যান্য কারণে আরো কিছু উৎপাদন-ক্ষতি হয়েছে। এই আকস্মিক উৎপাদন-ক্ষতি মোকাবেলা করার ক্ষমতা সরকারের থাকবে না কেন? জানা গেলো, সরকারের খাদ্য গুদামগুলো খালি। সেখানে চাল নেই। অন্তত তিন-চার মাস চলতে পারে, এমন নিরাপত্তা মজুদ থাকবে না কেন? সরকারের বাইরেও চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে চাল থাকার কথা। তাও কোনো কাজে আসেনি। তারা বরং সিন্ডিকেটবাজির আশ্রয় নিয়েছে। মজুদ আটকে রেখে দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটে নিয়েছে। সরকার এই সিন্ডিকেটবাজি ঠেকাতে পারেনি। সরকারের তরফে লাগাতার বলা হয়েছে, চালের অভাব নেই। চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে দাম বাড়ছে। অথচ সেই কারসাজিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এক পর্যায়ে এসে প্রায় ১৬ হাজার চালকল মালিককে কালো তালিকাভুক্ত করেছে সরকার। ততদিনে ক্রেতাসাধারণের দফা রফা হয়ে গেছে। অত:পর চাল আমদানীর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারীভাবে চাল আমদানীর পদক্ষেপ যেমন নেয়া হয়েছে তেমনি বেসরকারী আমদানিকারকদের শুল্ক কমিয়ে আমদানির সুযোগ দেয়া হয়েছে।
আশা করা গিয়েছিল, এর সুফল দ্রæতই পাওয়া যাবে। চালের দাম কমবে এবং ক্রেতা-ভোক্তারা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলতে পারবে। বাস্তবে সে সুফল পাওয়া যায়নি এখনো। ইতোমধ্যে দেড় লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে। এছাড়া আরও কয়েক লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গত দু’মাসে চাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকার। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, চাল আমদানি জোরদার করা হলেও বাজারে তার তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। চাল আমদানির খবরে মোটা চালের দাম শুরুতে সামান্য কমলেও পরে আর কমেনি। স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। এখনো ঢাকার বাজারে মোটা চাল প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রী হচ্ছে। এ চালই আগে বিক্রী হয়েছে ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজি। অন্য এক খবরে জানা গেছে, মাঝারি ও সরু চালের দাম আগের চেয়ে বেড়েছে। মিনিকেট, যা মধ্যবিত্তদের বিশেষ পছন্দের, এখন বিক্রী হচ্ছে ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা কেজি। পাইকারী বাজারে এ চালের দাম কেজি প্রতি ৫০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, মোটা চালের আমদানি বাড়লেও মাঝারি ও সরু চালের আমদানি হচ্ছে না। ফলে দাম বাড়ছে। চালের অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় সবচেয়ে বেকায়দার পড়েছে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। তাদের আয়-রোজগারের বড় অংশটিই চলে যাচ্ছে চাল কিনতে। অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের দামও অব্যাহতভাবে বাড়ছে। মাছ-গোশত, মশলাপাতি, তরিতরকারি, শাক-সবজিÑসব কিছুর দামই বাড়ছে। এমতাবস্থায়, নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ রীতিমত বিপন্ন ও অসহায় হয়ে পড়েছে।
চালের বাজার এখনো সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। এর দৃশ্যমান প্রমাণ আমদানির পরও মোটা চালের দাম না কমা বা স্থিতিশীল থাকা এবং মাঝারি ও সরু চালের দাম বাড়া। চালের বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তদারকি কতটা আছে, তা নিয়েও সংশয়ে রয়েছে। সরকারী গুদামে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল মজুদ থাকতো তাহলে অসৎ চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটবাজি মোকাবেলা করা সরকারের পক্ষে সহজ হতো। ব্যাপকভাবে খোলাবাজারে কম দামে চাল বিক্রীর ব্যবস্থা নিলে সিন্ডিকেটবাজদের কোনো কারসাজিই কাজে আসতো না। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সিন্ডিকেট ভাঙ্গা বা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতেও সরকার অপারগ। প্রশ্ন ওঠে, সরকার প্রায় ১৬ হাজার চালকল মালিককে কালো তালিকাভুক্ত করেই কি দায়িত্ব শেষ করেছে? তারা যদি চালের দাম বাড়ানোর জন্য দায়ী বলে সাব্যস্ত হয়ে থাকে, তবে তাদের বিরুদ্ধে আরও ব্যবস্থা নেয়ার কথা। এমন ব্যবস্থা নেয়ার কথা যাতে ভবিষ্যতে অন্যরা আর জোট-ঘোঁট পাকিয়ে চালের দাম বাড়াতে সাহস না পায়। সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা হচ্ছে কি? ওয়াকিবহাল মহল ও বিশ্লেষকদের মতে, চাল নিয়ে এই দুর্ঘট ও মূল্যবৃদ্ধিজনিত পরিস্থিতির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্বশীলদের অপরিনামদর্শিতা ও ব্যর্থতা বিশেষভাবে দায়ী। উৎপাদন-ক্ষতি, সরবরাহে বিঘœ, মজুদ হ্রাস, সিন্ডিকেটবাজি ইত্যাদি হতেই পারে। এসবের কোনোটাই অসম্ভব বা অস্বাভাবিক নয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্ব হলো, যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকা এবং সময়মত প্রয়োজনীয় কার্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এটা প্রমাণিত হয়েছে, মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। কেন এই ব্যর্থতা তা খতিয়ে দেখে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। সবচেয়ে বড় কথা, চালের দাম কমাতে হবে এবং ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এনে স্থিতিশীল করতে হবে। সিন্ডিকেটবাজি রুখতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের অংশীদারিত্ব জোরদার করতে হবে। অনেকে মনে করেন, চালকল মালিকদের কবজা থেকে চালের বাজারকে মুক্ত করার জন্য সরকারের উচিৎ চালকল স্থাপন করা। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কাজ হলো, চালের নিরাপত্তা মজুদ বাড়ানো। অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ কিংবা আমদানি যেভাবেই হোক চালের পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন