রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য সংকটের আশঙ্কা

| প্রকাশের সময় : ২৫ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হাওরে অকাল বন্যায় বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার পর ধানের বøাস্টরোগসহ দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বন্যায় বোরো ও আমন ধানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় চলতি বছর দেশের সামগ্রিক খাদ্য উৎপাদনে অন্তত ৫ ভাগ ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রায় এক কোটি বানভাসি মানুষের জরুরী খাদ্যের চাহিদা পুরনে সরকারী ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা এবং সরকারি গুদামে আপদকালীন খাদ্যের মজুদ অস¦াভাবিক কমে যাওয়ার যে চিত্র পাওয়া গেছে তা দেশের খাদ্য পরিস্থিতিকে আরো জটিল ও নাজুক করে তুলেছে। পরবর্তী ফসল না উঠা পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্যের যোগান নিশ্চিত রাখা এবং কৃষি ও অবকাঠামো খাতে বন্যা উত্তর পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আগামী দিনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যে কৃষকরা দেশকে খাদ্যে স্বনির্ভর করার কঠিন চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন করছে, অকাল বন্যা ও প্রাকৃতিক সদুযোর্গে সে সব প্রান্তিক কৃষক ও দরিদ্র মানুষকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ করে দিতে হবে। চলতি বছরের বন্যা দেশীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আমাদের জন্য বড় ধরনের অভিজ্ঞতা। এ ধরনের দুর্যোগ যতটা না প্রাকৃতিক তার চেয়ে বেশী মানবসৃষ্ট। কয়েক মাস আগেও পদ্মা ও তিস্তা পারের কৃষকরা পানির অভাবে জমিতে সেচ দিতে না পারায় অনেক জমি অনাবাদি রাখতে বাধ্য হয়েছে। আর এখন ফারাক্কা ও গজলডোবার সব বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে।
জমির উর্বরতা এবং কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে এমনিতেই বিশ্বে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মত জনঘনত্বপূর্ণ দেশে এটি ক্রমে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই) নামের একটি আন্তর্জাতিক খাদ্য গবেষণা সংস্থার সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে গত এক দশকে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হ্রাসের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ২০০৭-১১ সালে বাংলাদেশে যেখানে খাদ্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪.৭ ভাগ, ২০১২-১৬ সালে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্ধেকে(২.৩ ভাগ) নেমে এসেছে। খাদ্যে স্বনির্ভরতা এবং সকলের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা আমাদের জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। সেখানে খাদ্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার বাস্তবতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং দু:খজনক এই যে, তা উত্তরণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগও দেখা যাচ্ছেনা। বিশেষত: বন্যা, খরা ও জলবায়ু পরিবর্তনজণিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় কাঙ্খিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছেনা। নদীভাঙ্গণ, নাব্য হ্রাস এবং বন্যার গ্রাসে নতুন করে হাজার হাজার পরিবার ফসলি জমি ও বাড়িঘর হারাচ্ছে। ভ’মিহীন কৃষকের হার বেড়ে চলেছে। আএফপিআরআই’র রিপোর্ট অনুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষকদের মধ্যে শতকরা৩৬ ভাগ বা এক-তৃতীয়াংশের বেশী ভ’মিহীন এবং ২৭ ভাগ ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক কৃষক। বন্যা ও নদীভাঙ্গণে ভ’মিহীন বর্গাচাষি এবং প্রান্তিক কৃষকদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাচ্ছে। অন্যদিকে দেশের সামগ্রিক আবাদি জমির শতকরা ৭৫ ভাগে ধানচাষ করেও খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করা যাচ্ছেনা।
দেশের সরকারী খাদ্য গুদামগুলোতে ৭ লাখ টন আপদকালীন খাদ্য মজুদ থাকার কথা থাকলেও বন্যার সময় এক পর্যায়ে তা ২ লাখ টনের নিচে নেমে যাওয়ার তথ্য জানা যায়। এ খাদ্য মজুদ নিয়ে প্রায় এক কোটি বন্যার্ত মানুষের দু’ সপ্তাহের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সরকার খাদ্য আমদানীর শুল্ক কমিয়ে দেয়ার পাশাপাশি সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে জরুরী ভিত্তিতে লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানী করছে। এরপরও চালের মূল্য বেড়েই চলেছে। আপদকালীন খাদ্য মজুদের পরিমান ৭ লাখ টন থেকে বাড়িয়ে ১১ লাখ টন করা হচ্ছে বলে জানা যায়। বিগত বছরে দেশে পর্যাপ্ত ধান উৎপাদিত হওয়া সত্তে¡ও সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল ক্রয় করে মজুদের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল তা অর্জন করতে চরমভাবে ব্যর্থ হওয়া দেশের সরকারী খাদ্য মজুদের বর্তমান দুরবস্থার একটি বড় কারণ। চলতি বছর ৭ লাখ টন ধান এবং ৮ লাখ টন চাল সংগ্রহের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে ২ লাখ টনের কম। মূলত সরকারের সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি, অনিয়ম ও দলবাজির কারণেই ধান-চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছেনা। একদিকে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে কৃষক পুঁজি ও উৎসাহ হারাচ্ছে অন্যদিকে বন্যা, খরা ও নদীভাঙ্গনের মত দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকার পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিচ্ছেনা। গতকাল প্রকাশিত টিআইবি’র একটি গবেষনা প্রতিবেদনে জলবায়ু তহবিলের প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য জানা যায়। জলবায়ু তহবিলসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ফসল রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় সব প্রকল্পে এমন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এবার হাওরে ব্যাপক ফসলহানির জন্য পাউবো’র প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতিকে দায়ী করা হচ্ছে। এসব দুর্নীতি-অনিয়মের রাস্তা স্থায়ীভাবে বন্ধের পাশাপাশি কৃষি, জলবায়ু ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তায় আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং-এর মাধ্যমে নদনদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি, গঙ্গা বাঁধসহ বৃহদাকার রির্জাভার নির্মাণের উদ্যোগ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন