শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অপরিকল্পিত উন্নয়ন কষ্টের শহর

টাকা পায় ছালাম গালি খায় নাছির

শফিউল আলম ও রফিকুল ইসলাম সেলিম : | প্রকাশের সময় : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

 ‘আসল ডাক্তার রোগীর অপারেশনের সময় ও আগে-পরে কী করতে হবে তা ভালোভাবেই জানেন। কিন্তু হাতুড়ে ডাক্তার-বৈদ্য ভেবেচিন্তে কিছুই করে না। সে দা-ছুরি-বেøড দিয়েই অপারেশন চালিয়ে যায়। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) এক হাতুড়ে বৈদ্যের হাতেই চট্টগ্রাম আজ বলতে গেলে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ যথেচ্ছ ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন’।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের উন্নয়নের নামে বেহালদশা প্রসঙ্গে আলাপচারিতায় দুই জন বিশিষ্ট নাগরিক ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলী উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন। এদিকে উঁচুনিচু পাহাড় টিলা উপত্যকা বঙ্গোপসাগর বন-জঙ্গল নদী-খাল-ছরা-ঝরণা হ্রদে ঘেরা নিটোল প্রকৃতির অপরূপ ঠিকানা চট্টগ্রাম। বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মহানগরীর রয়েছে আপন ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য রূপ-নিসর্গ। বিশ্বের অনেক দেশেই বিরল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শহরকে টিকিয়ে রাখার তাগিদে ‘পরিবেশ-প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল)’ এলাকা ঘোষিত হয়। চট্টগ্রামের জন্য তা জরুরি হলেও অনুপস্থিত। বরং চুক্তিতে নিয়োগের মেয়াদ বারে বারে বৃদ্ধি করিয়ে নিয়ে সিডিএর ‘কর্ণধার’ সেজে শহরময় পোস্টার ব্যানার বিলবোর্ড টানিয়ে আবদুচ ছালাম নিজেকে নিজে ‘কর্মবীর’ ঘোষণা করে আসছেন ঠিকই। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ নগর পরিকল্পনাবিদ, বর্তমান ও সাবেক মেয়র, চট্টগ্রামের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, এলাকার সংসদ সদস্য, সিটি কাউন্সিলরসহ জনপ্রতিনিধিদের পুরোপুরি উপেক্ষা করেই তা ফ্রি-স্টাইলে এবং এলোপাতাড়ি ‘উন্নয়ন’ চালিয়ে যাচ্ছেন। সতেচন নগরবাসীর মুখে বলতে শোনা যায় ‘এগুলো উন্নয়ন নয়; উন্নয়ন যন্ত্রণা। এর সরাসরি কুফলে চট্টগ্রাম হয়েছে আজ কষ্টের শহর’।
গত ১১ সেপ্টেম্বর সোমবার এক সভায় আবদুচ ছালাম স্বীকার করেন ‘আমি সাধারণ শিক্ষিত লোক। আমার কোন টেকনিক্যাল জ্ঞান নেই। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ‘ই’ অক্ষরটির জ্ঞানও ছিল না’। আবার একই সভায় তিনি দাবি করেন, ‘আমি আর্কিটেক্ট অব চিটাগাং ডেভেলপমেন্ট’। অনুসারীদের উদ্দশে বলেন, ‘একটাই অনুরোধ করবো ভাইদের প্রতি, নিজেদের ঢোল নিজেদের পেটাতে হবে। এই কাজ আপনাদের’। (দৈনিক আজাদী ১২ সেপ্টেম্বর’১৭ইং)।
এদিকে গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তিন মেয়াদে নির্বাচিত সাবেক সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ইনকিলাবকে জানান, একে একে তিনটি ফ্লাইওভার এবং সম্প্রতি পানিবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার ৬শ’ কোটি টাকাসহ ৮ হাজার কোটি টাকার বিশাল বিশাল প্রকল্প নিয়ম মাফিক কোন ধরনের ফিসিবিলিটি স্টাডি (প্রাক-সমীক্ষা) ছাড়াই সিডিএর কর্মবীর কর্ণধার সেজে ছালাম কীভাবে পেয়ে যাছেন? এসব অপরিকল্পিত প্রকল্পের বহর দিয়ে উন্নয়ন করতে গিয়েই চট্টগ্রাম মহানগরীর ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। এর নানামুখী কুফলের কারণে জনদুর্ভোগও বৃদ্ধি পেয়েছে। ছালাম তো জনপ্রতিনিধি নন। নিজেকে মনে করে বড় এক আমলা। জনগণের কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হয় না। কিন্তু সরকারকে জনগণের কাছে যেতে হয়। ছালামের এসব কর্মকান্ডে সরকারের ইমেজ ক্ষুণœ হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরাও বলছেন একই কথা। সিডিএ চেয়ারম্যান ছালামের হাতে চট্টগ্রামে উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। এরফলে মহানগরী হয়ে উঠছে বেসামাল, ভারসাম্যহীন, ক্রমশই বসবাসের অযোগ্য। পাহাড়-টিলা নির্বিচারে কেটে-খুঁড়ে ভবন ও বস্তির সারি, খাল-ছরা ও নালার উপর ঘরবাড়ি ও মার্কেট, পুকুর-দীঘি বেপরোয়াভাবে ভরাট ইত্যাদি নেতিবাচক কর্মকান্ডে প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং শোভা হারিয়ে যাচ্ছে। যথেচ্ছ বেড়ে উঠছে চট্টগ্রাম। প্রায় ৬০ লাখ নগরবাসীর কষ্ট-দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। পানিবদ্ধতা ও পাহাড়ধস তার অন্যতম নজির। তাছাড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে হরেক রকম নাগরিক যন্ত্রণা।
রাজধানী ঢাকার পর দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নগরী চট্টগ্রামে জনসংখ্যার চাপ বেড়েই চলেছে। সেই অনুপাতে আবাসন, সড়ক, পার্ক-বিনোদন, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় মাদরাসাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, পানি ও পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা, গণপরিবহনসহ অপরিহার্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রতিনিয়ত ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে লোকসংখ্যা। প্রতিবছর গড়ে যোগ হচ্ছে অন্তত ৬০ হাজার নবাগত নাগরিক। তাদের জন্য দরকার ১২ থেকে ১৫ হাজার ইউনিট অতিরিক্ত ফ্ল্যাট বা বসতঘর। এছাড়া দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র, অফিসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ১শ’ থেকে ১৪০ হেক্টর ভূমিতে আবাসনের চাহিদা বাড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, সমুদ্রবন্দর, শিল্প-কারখানা, পরিবহন, শিক্ষা, প্রশাসনিক সব কাজকর্মের গুরুত্বকে ঘিরে নগরমুখী জনস্রোত বাড়ছে। ইউএনডিপি, গৃহায়ন অধিদফতর, সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন ও পরিবেশ অধিদফতরের বিভিন্ন জরিপ তথ্য-উপাত্তে তা জানানো হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামী ৫০ কিংবা একশ’ বছরের চাহিদাকে সামনে রেখে চট্টগ্রামের যে সুপরিকল্পিত উন্নয়ন তা উপেক্ষা করা হচ্ছে। এর দায় মূলত সিডিএ’র।
কয়েকজন নগর প্রকৌশলী অভিমত দিয়েছেন, সিডিএর মাস্টার প্ল্যানকে পাশ কাটানো এবং বড়সড় প্রকল্প নেয়ার আগে যথারীতি সমীক্ষা-যাচাই না করার কারণেই উন্নয়নের নামে নিত্যনতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যয় হলেও চট্টগ্রামবাসী সুফল পাচ্ছে না। সার্বিক ভারসাম্য হারাচ্ছে নগরী। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে গৃহীত আরবান, ট্রান্সপোর্ট ও ড্রেনেজ- এই তিনটি নাগরিক চাহিদার সমন্বয়ে প্রণীত মাস্টার প্ল্যান এবং ২০০৮ সালের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) অনুসরণের তাগিদ দিয়ে তারা বলেন, সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকান্ড হতে হবে চসিকের সমম্বয়ে এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা অনুসারে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের পরিবেশ-প্রতিবেশ, ভূ-প্রাকৃতিক বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো সুরক্ষা নিশ্চিত করা হলেই পরিকল্পিত নগরায়ন হবে। তা উপেক্ষিত হলে আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়াতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। ভূমিকম্প প্রতিরোধী কারিগরি নির্মাণ শৈলীর পাশাপাশি পানিবদ্ধতা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াস, বন্যা, পাহাড়ি ঢলসহ সম্ভাব্য দুর্যোগের দিকগুলো দূরদর্শী পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার দিয়ে নগরায়ন নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
ব্রিটিশ শাসনামলের মাঝামাঝি এদেশের অন্যতম প্রাচীন পৌর শহর হিসেবে ১৮৬৩ সালের ২২ জুন ‘দি চিটাগাং মিউনিসিপ্যালটি’র সূচনা হয়। তখন মাত্র ৬ বর্গমাইল আয়তনের ৫টি ওয়ার্ড নিয়ে শহরটি প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা করে। ১৮৬৯ সালের আদম শুমারিতে চট্টগ্রাম শহরে জনসংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৫৯৮ জন। এখন ৪১টি ওয়ার্ড নিয়ে জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন