শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

রাজধানীতে লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ির প্রতাপ

| প্রকাশের সময় : ২৪ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রাজধানীর সমস্যার অন্ত নেই। বসবাসের অনুপযোগী ও অসভ্য নগরী, শব্দ ও বায়ু দূষণ, যানজট, পানিবদ্ধতা, দক্ষিণ এশিয়ার ব্যয়বহুল জীবনযাত্রার শহরসহ যত রকমের সমস্যা রয়েছে, তা এই শহরে বিদ্যমান। অথচ এটি নি¤œ মধ্য আয় ও দ্রæত উন্নয়নশীল একটি দেশ হিসেবে পরিচিত। এ হিসেবে রাজধানীতেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে, এটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা। ঢাকার সার্বিক চিত্র দেখে মনে হওয়ার কোনো উপায় নেই, এটি কোনো উন্নয়নশীল দেশের রাজধানী। এখানে যত ধরনের অনাচার আছে, তার সবই ঘটে চলেছে। সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানের অভাব না থাকলেও, তারা কী সেবা করছে, তার কোনো নমুনা দেখা যায় না। অবস্থা দৃষ্টে এটাই প্রতীয়মাণ হয়, এ শহরের অভিভাবক বলে কেউ নেই। যেমনভাবে চলছে, তেমনভাবে চলুকÑএমন একটা প্রবণতা খুব বেশি দৃশ্যমান। সাধারণ মানুষের যাতায়াতের একমাত্র ভরসা গণপরিবহনের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, তাতে শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য বলে কিছু নেই। বছরের পর বছর ধরে এ খাতটিতে এক অরাজক পরিস্থিতি চলছে। ন্যূনতম যাত্রীসেবা বলতে কিছু নেই। নিরুপায় যাত্রীদের গন্তব্যে ফেরার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাতায়াত করতে হচ্ছে। একেতো চাহিদার তুলনায় গণপরিবহন পর্যাপ্ত নয়, অন্যদিকে লক্কর-ঝক্কর মার্কা ও চলাচলে অনুপযোগী বাস-মিনিবাসের সংখ্যাও অত্যধিক। এসব দেখার যেন কেউ নেই। মাঝে মাঝে ঘোষণা দিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও, এক-দুইদিন মহাসমারোহে ক্যামেরা ট্রায়াল চলে। কিছুদিন যেতে না যেতে যে-সে অবস্থায় গিয়ে পৌঁছে।
একটি শহরের অন্যতম সৌন্দর্য হচ্ছে, এর সুশৃঙ্খল গণপরিবহন এবং এর ভেতর ও বাইরের সৌন্দর্য। ঢাকার বাস-মিনিবাসের বাইরের যে চিত্র দেখা যায়, তাতে কোনো সভ্য যাত্রীর এসব পরিবহনে চড়ার কথা নয়। ভাঙ্গাচোড়া এসব বাসের সৌন্দর্য বলতে কিছু নেই। তার উপর আনফিট বা চলাচলে অনুপযোগী। বাসের ভেতরের অপরিচ্ছন্ন সিট ও পরিবেশ, ঠাসাঠাসি করে যাত্রী নেয়া, বাসের হেডলাইট, ইন্ডিকেটর লাইট না থাকাসহ বিভিন্ন ত্রæটি নিয়ে চলাচল করছে। এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, একটি দেশের রাজধানীতে পুরনো ও কুৎসিৎ দৃশ্যের গণপরিবহন বছরের পর বছর ধরে কেমন করে চলে। চিরকালেরর এ দৃশ্যের কি কোনোই পরিবর্তন হবে না? বিআরটিএসহ যেসব প্রতিষ্ঠানের এসব দেখভালের কথা, তারা কি এসব দেখছে না? এমন উদাসীন হয়ে রয়েছে কেন? মাঝে মাঝে পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলে সংস্থাটি যেন একটু নড়েচড়ে বসে। নামকাওয়াস্তে দুয়েক দিনের অভিযান চালানোর পর আর কোনো খোঁজ থাকে না। তাদের আগেভাগের ঘোষণায় গণপরিবহন মালিকরাও কম চালাকি করে না। তাদের লক্কর-ঝক্কর মার্কা বাসে কানো রকমে রং লাগিয়ে নতুনের ছোঁয়া দিয়ে চালানো শুরু করে। এতেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খুশি হয়ে যায়। বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী রাজধানীতে বর্তমানে ৩০,২৭৪টি বাস এবং ১০৩২৬টি মিনিবাস রেজিস্ট্রিকৃত অবস্থায় আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব বাসের বাহির এবং ভেতরের দৃশ্য কোনোভাবেই দৃষ্টিনন্দন নয়। রাস্তার দিকে তাকালে কেবল পুরনো ও বিবর্ণ বাসই চোখে পড়ে। অথচ যে কোনো দেশের রাজধানীর সৌন্দর্যের অন্যতম বাহন গণপরিবহন। নান্দনিক ও বাহারি সৌন্দর্যের গণপরিবহন সে দেশের রুচি ও সভ্যতার নির্দশন হিসেবে চিহ্নিত হয়। আমাদের দেশে বিদেশ থেকে পর্যটক এসে গণপরিবহণ দেখে মুগ্ধ হয়ে তাতে চড়ে বসেÑএমন দৃশ্য কখনোই দেখা যায় না। দ্রæত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার। অথচ পার্শ্ববর্তী কোলকাতায় গেলে কেউ মেট্রো রেলে চড়বে না, এটা কল্পনাও করতে পারে না। অনেকে বলে দেন, কলকাতা গেলে যেন অবশ্যই মেট্রো রেলে চড়ে। অথচ আমাদের রাজধানীতে চড়ার মতো এমন কোনো বিশেষ যানবাহন নেই। কেউ যদি প্রশ্ন করে ঢাকার ইতিবাচক বিশেষত্ব কি, তবে এর নির্দিষ্ট কোনো জবাব কেউ দিতে পারবে না। নগরবিদরা মনে করছেন, এক গণপরিবহনে যদি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়, তবে ঢাকার যানজট অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। ঢাকার উত্তরের মেয়র আনিসুল হক গণপরিবহণে অরাজকতা বন্ধে এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। বিভিন্ন রুটে চলাচলকারি গণপরিবহনকে পাঁচটি কোম্পানির আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যদি এ কাজটি করা যেত, তবে গণপরিবহণে যেমন শৃঙ্খলা ফিরে আসত, তেমনি এগুলোর সেবা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেত। তার এ উদ্যোগ বলা যায় এখন হিমাগারে চলে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, এ দায়িত্ব পালন করার কথা বিআরটিএ-এর। তারই এসব দেখভালের দায়িত্ব। আমরা দেখছি, প্রতিষ্ঠানটি এক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সংস্থাটি নগরপরিবহণ মালিকদের উদ্দেশে তাদের পরিবহনকে দৃষ্টিনন্দন করে তোলার জন্য একটি জরুরী বিজ্ঞপ্তি সংবাদপত্রে প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২৬ অক্টেবরের মধ্যে এ কাজ না করলে তারা আইনগত ব্যবস্থা নেবে। বিআরটিএ-এর এ বিজ্ঞপ্তি যে গণপরিবহন মালিকরা আমলে নিচ্ছে না, তা রাজধানীর সড়কে সেই পুরনো ও আনফিট বাস চলাচল থেকেই বোঝা যাচ্ছে।
গণপরিবহনকে ফিট এবং সৌন্দর্যমন্ডিত গড়ে তোলা কোনো কঠিন কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন গণপরিবহন মালিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা। আমরা বহুবার দেখেছি, আনফিট যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। তাতে কোনো লাভ হয়নি। অভিযান চলাকালে সেগুলো রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যায়। কোনোগুলো রং লাগিয়ে রাস্তায় নামায়। অভিযান বন্ধ হয়ে গেলে আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। আগামীতে অভিযান পরিচালিত হলে, একই দৃশ্যের যে পুনরাবৃত্তি হবে, তাতে সন্দেহ নেই। এটা অভিযানের নামে গণপরিবহণে এক ধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা ছাড়া কিছুই নয়। এ ধরনের প্রবণতা চিরতরে বন্ধ করা প্রয়োজন। রাজধানীতে বিভিন্ন ডিজিটাল বোর্ড বসিয়ে, অনিন্দ্য সুন্দর ভবন নির্মাণ করে সৌন্দর্য বৃদ্ধির এন্তার প্রচেষ্টা চলছে। অথচ অত্যন্ত জরুরী খাত গণপরিবহন দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায়ই রয়ে গেছে। যাতে নেই কোন সৌন্দর্য, নেই কোনো শৃঙ্খলা। গণপরিবহনকে যদি সুন্দররভাবে উপস্থাপন করা যায়, তবে শহরের মাধুর্য অনির্বচনীয় হয়ে উঠবে। আমরা মনে করি, রাজধানীর সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এবং গণপরিবহনকে সুশৃঙ্খলভাবে সাজাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। ঢাকার রাস্তায় আর কোনো আনফিট ও দৃষ্টিকটু গণপরিবহন চলতে দেয়া হবে নাÑএমন দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া যাবে না। এজন্য প্রয়োজনে দীর্ঘমেয়াদে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। গণপরিবহন মালিকদেরও এব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তাদের মধ্যে যাত্রীসেবার মনোভাব বৃদ্ধি এবং গণপরিবহকে ফিট করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন