শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

সার্বভৌমত্ব ও রোহিঙ্গা পরিচয়

মো. মনিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৪ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বহুমাত্রিক সমাজে কখনো কখনো দেখা যায় যে, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তার পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সাথে চ্যালেঞ্জ করে বসে। আবার কখনো জ্ঞাতি বা গোষ্ঠী তাদের রাষ্ট্রসম করে দাঁড় করাতে গিয়ে সার্বভৌম শক্তির অধিকারী হওয়ার সাহস দেখায়। তখন সংঘর্ষ হয় অনিবার্য। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার বিপরীতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পরিচয়ের এই অযাচিত চর্চা রাষ্ট্রকে বাধ্য করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দমন করতে। তবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা তাদের গোষ্ঠী পরিচয়ের মাধ্যমে টিকে থাকার সামর্থ্যটুকু হারিয়ে আজ তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের এই গোষ্ঠীগত পরিচয় কোনভাবেই রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি নয়। তাহলে কেন মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা নিধনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে?
বর্তমান সময়ে রাখাইন মুসলমানদের ওপর সামরিক জান্তার নির্মম ও নিদারুণ অত্যাচার যেন ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। তাদের নিষ্ঠুরতা প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকাশিত না হলেও বর্তমান সময়ে গণমাধ্যমের বিস্তর প্রচার তা বিশ্ববিবেকের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। গণমাধ্যমের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তাঁর বক্তব্যে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে পাঁচ দফা দাবি ও সুপারিশ বিশ্ববিবেককে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালত মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও অংসান সুচিকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রভাবিত পরিচালিত সরকার ও অংসান সুচির সমালোচনা করেছে এবং শীঘ্রই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর তাগিদ প্রদান করেছে। ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের এই সংকটকে মোকাবেলা করছে। সেসময় থেকে এপর্যন্ত বিষয়টি দ্বি-পাক্ষিক একটি আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ দফা দাবি ও সুপারিশ দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার বাইরে বহু-পাক্ষিক একটি আলোচনার পথ উন্মুক্ত করেছে, একথা নিশ্চিত করে বলা যায়। আর একারণে রোহিঙ্গা সমস্যার একটা সমাধান হবে বলে প্রাজ্ঞমহল মনে করে।
রোহিঙ্গারা মূলত কট্টর উগ্র বর্ণবাদ ও ধর্মীয় নগ্ন থাবার শিকারে পরিণত হয়েছে। গৌতম বুদ্ধের সহনশীলতার অমীয় বাণীকে অগ্রাহ্য করেছে কট্টরপন্থী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। এই কারণে সামরিক বাহিনীর সাথে তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করতে তাদের ওপর চালাচ্ছে অত্যাচারের স্টিম রোলার। সহনশীলতা ভুলে হিংস্রতাকে দিয়েছে তারা প্রশ্রয়, যা বয়ে এনেছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জীবনে যন্ত্রণাদায়ক বিভীষিকা। উল্লেখ্য যে, আফগানিস্তান থেকে আগত সাদা বর্ণের মুসলমান যারা ‘পালান’ নামে পরিচিত তারা নির্যাতিত হচ্ছে না। কিন্তু কালো বর্ণের রোহিঙ্গা মুসলমানরা হচ্ছে নির্যাতিত। এদিক বিবেচনায় একথা বলতে বাধা নেই যে, ধর্মীয় উগ্রতাই নয়; বরং বর্ণবাদের বিষবাস্প রোহিঙ্গা নিধনের এই বর্বতার পেছনে অনেকাংশেই দায়ী। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান নিধনে ধর্মীয় উগ্রতা ও বর্ণবাদকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ইতিহাসের আরও একটা নগ্ন অধ্যায়, একথা নিশ্চিত করে বলা যায়। বর্তমানে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বর্ণবাদকে উসকে দিয়ে রাষ্ট্রনামক প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম এই মূল উপাদানের (সার্বভৌমত্ব) আইন বহির্ভূত প্রয়োগ আগামী দিনের রাষ্ট্রচিন্তায় রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা কোন তত্ত¡ তৈরি হবে কিনা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের হয়তো সে বিষয়ে চিন্তা করতে হতে পারে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকার রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের আইনানুগ প্রয়োগে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এই প্রত্যাশা সবার।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিআইজিএম), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন