রোববার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রাজধানীতে দুই জোড়াখুন

| প্রকাশের সময় : ৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বার ঘন্টা সময়ের ব্যবধানে রাজধানীর কাকরাইলে নিজ বাসায় মা ও ছেলে এবং বাড্ডায় পিতা ও কন্যা দুর্বৃত্তদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। গতকাল প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কাকরাইলে হোটেল রাজমণী ঈশা খাঁ’র বিপরীত পাশে মায়াকানন নামক বাড়ির ৫ম তলায় ৪৬ বছর বয়েসী মা ও ১৯ বছর বয়েসী ছেলে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নিহত হওয়ার পর বৃহষ্পতিবার সকালে বাড্ডায় একটি বাসার কক্ষ থেকে পিতা ও কন্যার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পিতাকে ছুরিকাঘাতে এবং ৯ বছর বয়েসী শিশুকন্যাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিক আলামতে জানা গেছে। গত মাসেও উত্তর বাড্ডায় বার বছর বয়েসী শিশুকন্যার সামনেই মাদকাসক্ত স্বামী ও তার সহযোগিদের হাতে এক গৃহধু খুন হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর তিনদিনের মাথায় ১০ অক্টোবর মতিঝিলের অফিস থেকে বের হওয়ার পর একটি অনলাইন নিউজপোর্টালের সাংবাদিক উৎপল দাস নিখোঁজ হন। উৎপল দাস গুম হওয়ার পর তার মোবাইল নম্বর স্পুফিং করে দুর্বত্তরা পরিবারের কাছে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছে বলেও জানা গেছে। ইতিমধ্যে তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও উৎপলের সন্ধান পায়নি পুলিশ। একইভাবে সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে সংঘটিত কোন হত্যাকান্ডেরই মোটিফ খুঁজে বের করতে পারেনি পুলিশ। 

এটি শুধুমাত্র রাজধানী শহরের চিত্র। গতমাসে নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলীতে শশুর বাড়িতে খুন হয় নববধু মনী আক্তার। সে ঘটনায় ব্যাপক সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলেও পুলিশ আসামীদের ধরতে গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কয়েকদিন দেরি করে মামলা নিলেও আসামী পলাতক দেখিয়ে অদ্যাবধি পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি বলে জানা যায়। এমনিতেই পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে নাভিশ্বাস অবস্থা। দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক মন্দা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রবণতায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় একধরনের সংকট বিরাজ করছে। সেই সাথে ক্রমবর্ধমান সামাজিক অবক্ষয়, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, পারিবারিক কলহ ও নির্মমতার শিকার হচ্ছে শিশু ও নারীরা। শহরে, গ্রামে, রাস্তায়, কর্মস্থলে, আবাসস্থল সর্বত্র খুন-গুম ও নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা ভর করেছে। কোন সভ্য সমাজ দীর্ঘদিন এভাবে চলতে পারেনা। সব দেশে, সমাজেই কমবেশী গুম-খুনের ঘটনা ঘটে, অপরাধ সংঘটিত হয়। আমাদের সমাজে সবচেয়ে উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, অপরাধ বাড়লেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধিদের ধরে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে পারছেনা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় একশ্রেনীর মানুষ অব্যাহতভাবে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধে লিপ্ত থাকলেও তাদের কোন বিচার হয়না। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এই পরিস্থিতিকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই গুম-খুনসহ সামাজিক অপরাধ বেড়েই চলেছে।
জননিরাপত্তা তথা সামাজিক নিরাপত্তা যে কোন সভ্য সমাজের উন্নয়ন-অগ্রগতির অন্যতম পূর্বশর্ত। আমরা যখন নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সামনে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখছি, আগামী দশকে একটি মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ বিনির্মানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক রোডম্যাপ জাতির সামনে তুলে ধরছি, তখন সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তা আমাদের সব সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে চলছে একধরনের অচলাবস্থা। গার্মেন্ট রফতানীখাতে নেতিবাচক প্রবণতা বিদ্যমান। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মত গুরুত্বপূর্ণ খাতেও সুখবর নেই। এই সঙ্গে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তথা সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে বিরাজ করছে। পশ্চিমা কয়েকটি দেশ বাংলাদেশে কার্গো নিষেধাজ্ঞা জারি, গার্মেন্ট ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ প্রত্যাহার এবং বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে ভ্রমণ সতর্কতা জারির মত ঘটনা দেশের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থার পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবেই বাংলাদেশে সার্বিক জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার অভাব, মূল্যবোধের সংকট এবং মামলা দিয়ে বিরোধি রাজনৈতিক দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মীকে হয়রানি করার পাশাপাশি শত শত মানুষ গুম-খুন হওয়ার পরও অপরাধিদের আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার কারণেই কার্যত দেশে এখন নিরাপত্তাহীনতার সংকট তৈরী হয়েছে। নাগরিক সমাজকে জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা থাকতে পারেনা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমূল বদলে দিয়ে সব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই নাগরিক সমাজের একনম্বর দাবী ও প্রত্যাশা। হত্যাকান্ড ও গুম-অপহরণের সাথে জড়িতদের যত দ্রæত সম্ভব খুঁজে বের করে বিচারের সম্মুখীন করার মধ্য দিয়েই নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন