শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহানগর

মহানগর দক্ষিণ আ.লীগের দ্বন্দ্ব চরমে

যেকোনো সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ

তারেক সালমান | প্রকাশের সময় : ১৬ নভেম্বর, ২০১৭, ৬:৪৮ পিএম

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কমিটিতে নিজের অনুগত লোক/নেতাকে পদে রাখাকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মো. শাহে আলম মুরাদ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের মধ্যে দ্বন্দ্ব পুরনো। শাহে আলম মুরাদ কমিটিতে তার নিজের অনুসারীদের স্থান দিতে চান। অন্যদিকে মেয়র সাঈদ খোকন তার অনুসারীদের স্থান দিতে চান। এ নিয়ে দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। সম্প্রতি বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ডের পূর্ণাঙ্গ কমিটিকে কেন্দ্র করে সেই দ্বন্দ্ব নতুন করে সামনে এসেছে। মহানগর আওয়ামী লীগ কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করলেই কাছাকাছি ভেন্যুতে একই ধরণের পাল্টা কর্মসূচি সিটি করপোরেশনের ব্যানারে হয়ে আসছে। এসব পাল্টা-পাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, চেয়ার ভাঙচুর, মঞ্চ দখল একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের ঘটনাও ঘটে আসছে। সম্প্রতি এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ময়লা-আবর্জনাও।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণকে ইউনেস্কো বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যর স্বীকৃতি দেয়ায় আগামীকাল শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক সমাবেশ করবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ওই সমাবেশ সফল করার লক্ষে গেল কয়েকদিন ধরেই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ, মহানগর উত্তর/দক্ষিণ ও বিভিন্ন সহযোগী এবং ভাতৃপ্রতিম সংগঠন নিয়মিত প্রস্তুতি সভা করেছে। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল বৃহস্পতিবার পুরান ঢাকার আজিমপুরের পার্ল হারবার কমিউনিটি সেন্টারে এক প্রস্তুতি সভার আয়োজন করে ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। কর্মসূচীতে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি। বিশেষ অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতির উপদেষ্টা সদস্য মোজাফফর হোসেন পল্টু ও খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম। কিন্তু গতকাল সকালে কর্মসূচিতে অংশ নিতে এসে কমিউনিটি সেন্টারের সামনে রাস্তায় বিপুল সংখ্যক ময়লার স্তূপ পড়ে থাকতে দেখেন নেতাকর্মীরা। স্থানীয়রা জানান, ভোরেই তারা ময়লার স্তূপ দেখেছেন, রাতের কোনো এক সময়ে তা ফেলা হয়েছে বলে ধারণা তাদের।
ময়লা ঠেলে সেখানে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী আবুল হাসনাতের সভাপতিত্বে সভা হয়। খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম সভায় বক্তব্য রাখেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সেখানে গুলির ঘটনাও ঘটে। এ সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে ১৩ জনকে আটক করে লালবাগ থানা পুলিশ। পুলিশের লালবাগ জোনের ডিসি ইব্রাহিম খান বলেন, দুই পক্ষের ঝামেলার কারণে সেখানে ৩টি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পরিস্থিতি শান্ত করতে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।
মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের অনুসারীরা বলছেন, দলীয় কর্মসূচী বাধাগ্রস্ত করতেই সিটি কর্পোরেশনের ৩-৪ গাড়ি ময়লা কর্মসূচিস্থলে ফেলা হয়েছে। এর পিছনে মেয়র সাঈদ খোকন ও কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান জড়িত বলে তাদের দাবি। শাহে আলম মুরাদের অনুসারীদের দাবি কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের রায়ে এক বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামী।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, গত মেয়র নির্বাচনের সময় থেকেই বর্তমান মেয়র সাঈদ খোকন ও ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। দুইজনই বর্তমান দায়িত্বে এসে বলয় শক্তিশালী করার পর তা আরও বেড়েছে।
এ বিষয়ে শাহে আলম মুরাদ ইনকিলাবকে বলেন, এটা সিটি কর্পোরেশনের কাজ-কারবার। আওয়ামী লীগের কর্মসূচীকে বাধাগ্রস্ত করতেই তারা এভাবে ময়লা ফেলেছে। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক ঘটনা।
পরে ময়লা সরিয়েই সভায় অংশ নেয় মুরাদের অনুসারীরা। অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক দীপু মনির অংশগ্রহণের কথা থাকলেও তিনি অংশ না নিয়ে ফিরে যান। এ বিষয়ে তার সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। এ ধরণের ঘটনা চলতে থাকলে আগামীতে সরকার ক্ষমতায় আসবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের বিষয়ে সভায় কামরুল ইসলাম বলেন, আপনারা বলেন শেখ হাসিনার সরকার বার বার দরকার। কিন্তু ঐক্য ছাড়া শেখ হাসিনার সরকার আসবে না। আজ যে দ্বন্দ্ব চলছে, এভাবে চললে শেখ হাসিনার সরকার আসবে না। নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, আপনারা যেভাবে অনৈক্য দেখাচ্ছেন তা কখনো শুভকর নয়।
এদিকে, গত কয়েকদিন আগে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার উদ্বোধনের দিন। এদিনও শাহে আলম মুরাদের অনুসারী এবং মেয়র সাঈদ খোকনের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছেন কাউন্সিলরাও। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে কাউন্সিলর আবু আহমেদ মান্নাফি ও তার ছেলের শাসন চলছে বলে অভিযোগ দলের অনেক নেতাকর্মীর। অভিযোগ রয়েছে, মান্নাফির এলাকার আওয়ামী লীগের এক নেতাকে ‘সাইজ’র করার মিশনে নেমেছেন তিনি। সে কারণে তিনি মেয়রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কাপ্তান বাজার কমপ্লেক্স-২ বেজমেন্ট এলাকায় দোকান উচ্ছেদ করে এখন টাকা দিয়ে আবার দোকান বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। কাউন্সিলরের ছোট ছেলে এসব নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বলে অভিযোগ। এছাড়াও বহুতল ভবন নির্মাণ করার কথা বলে মুরগীর আড়ত তুলে দিলেও টাকার বিনিময়ে সেখানে বরাদ্দ দেয়ার চেষ্টা চলছে। প্রতি শুক্রবার সেখানে কবুতরের হাট বসে। অভিযোগ রয়েছে, কাউন্সিলরের ছেলে বাবার নাম ভাঙ্গিয়ে হাট থেকে টাকা উত্তোলন করে। এছাড়াও কাপ্তান বাজারের পিছনে কাউন্সিল অফিসের সামনে টেম্পো স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন অর্ধলাখ টাকা চাঁদা উঠানো হয়।
গত ১ নভেম্বর আবু আহমেদ মান্নাফি লোকজন নিয়ে এসে মহানগরের বর্ধিত সভায় পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা করার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন মহানগরের নেতারা। তারা বলছেন, ১/১১-এর চক্ররা নগর আওয়ামী লীগের থানা ও ওয়ার্ড কমিটিতে নিজেদের সমর্থকদের পদে ঢুকানোর প্রতিযোগিতায় নেমে। এ জন্য তাদের তরফ থেকে ঢাকা মহানগর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের কাছে তালিকা পাঠিয়ে পদ-পদবী দেয়ার জন্য হুমকি দেয়া হয়েছে। মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আবু আহম্মেদ মান্নাফী সমর্থকদের নিয়ে নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে যাচ্ছেন। ১/১১-এর সময়ে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী নেতাদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছেন। এতে করে নগর নেতৃত্বে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি নগরের অফিস ভাংচুর ও কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। তবে এ অবস্থা বেশিদিন চলতে থাকলে আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এ অবস্থা বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন তারা।
গত ৮ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকনের ‘জনতার মুখোমুখি মেয়র’ অনুষ্ঠানেও মহানগর নেতাদের দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দ্বন্দ্বের জেরে অনুষ্ঠানে দাওয়াতই পাননি ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল আউয়াল। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বের জেরে আবদুল আউয়ালকে পাশ কাটিয়ে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ইলিয়াস রশীদকে নিয়ে অনুষ্ঠানটি করেন মেয়র। রেওয়াজ অনুযায়ী এ ধরনের অনুষ্ঠানে মেয়রের সঙ্গে একই মঞ্চে উপস্থিত থেকে স্থানীয় জনগণের সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়ে থাকেন ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। এ বিষয়ে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল আউয়ালের অভিযোগ করেন, তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি তাকে।
মহানগর নেতারা জানান, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণের প্রায় প্রতিটি এলাকায় সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব রয়েছে ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকনের। ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুল আউয়ালকে মুরাদের অনুসারী ভেবে দাওয়াত দেয়া হয়নি। তবে স্থানীয় যুবলীগ নেতা আরমান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সভাপতি ইলিয়াস রশীদ বর্তমানে সাঈদ খোকনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। শুধু তাই নয়, মেয়র সাঈদ খোকনের ‘জনতার মুখোমুখি মেয়র’ অনুষ্ঠানের দাওয়াত কার্ড ছাপিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝে বিতরণও করেছেন গত নির্বাচনে আউয়ালের কাছে পরাজিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী ইলিয়াস। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বও করেন তিনি।
এ বিষয়ে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল আউয়াল বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকায় মেয়র অনুষ্ঠান করলেন, আমাকে একটিবার দাওয়াতও দিলেন না। আমি কীভাবে যাই? এ ছাড়া আমি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, অথচ আমাকে কোনো আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়নি। কিন্তু আমার সঙ্গে কাউন্সিলর নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন এমন ব্যক্তিরা মেয়র সাহেবের অনুষ্ঠানের মূল আয়োজনে ছিলেন।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ইনকিলাবকে বলেন, যেখানে ময়লা রাখার অভিযোগ করা হচ্ছে আসলে সেটা আগে থেকেই সিটি করপোরেশনের ময়লা ফেলার ডাম্পিং স্টেশন। সেখানে আগে থেকেই ময়লা ছিল। হয়ত কোনো কারণে গত দু‘তিন দিন ময়লা সেখান থেকে ক্লিন করা হয়নি যার কারণে আজ (গতকাল) ময়লার পরিমাণটা বেশি মনে হয়েছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক কেন এ ধরণের ঘটনায় জড়াবে। এসব অভিযোগ অসত্য। কোনো ভিত্তি নেই।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের বিষয়ে দলটির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য ইনকিলাবকে বলেন, এগুলো খুবই দৃষ্টিকটু, শোভনীয় নয়। সারাদেশ যখন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ সেখানে মহানগরে এ ধরণের অনৈক্য দূর করতে হবে। তা না হলে দলের ক্ষতি হবে।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন