বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে এমন দু’জনকে খুঁজে পাওয়া যায় না যারা হুবহু একই রকম। অনেক লক্ষণে কারো মধ্যে সাদৃশ্য থাকলেও ভিন্ন কোন লক্ষণের মাধ্যমে সহজেই তাদের পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। এজন্য দুজন যমজ সন্তানের অবয়ব বা আচরণ কখনো এক হয় না। ব্যক্তি জীবনেও প্রত্যেকের একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে। এটাই হচ্ছে তার ব্যক্তিত্ব। কারো সাথে ঘনিষ্টভাবে মিশতে পারলে তাকে ভালোভাবে বোঝার সুযোগ পেলে তবেই এই ব্যক্তিত্বের স্বরূপ জানা যায়।
বাহ্যিক কোন উত্তেজক বিষয়ের বিরুদ্ধে দেহের অদৃশ্য শক্তির প্রতিক্রিয়া করার ক্ষমতাকে প্রবণতা বা ঝঁংপবঢ়ঃরনরষরঃু বলে। কেউ তিরস্কার করলে মানুষ ক্রুদ্ধ হয়, প্রশংসায় উৎসাহিত হয়, খুশির খবরে আনন্দিত হয়, বেদনাদায়ক ঘটনায় ব্যথিত হয়, অন্যের দুঃখে মর্মাহত হয় এসবই ‘প্রবণতা’র ফল। সব মানুষের প্রবণতা কখনো এক হয় না। তাই কোন বাড়ীতে মহামারী দেখা দিলে সেই বাড়ীর বা গ্রামের সবাই তাতে আক্রান্ত হয় না। কারো শরীরে অত্যধিক প্রবণতা থাকলে তাকে অতি প্রবণতা বা ঐুঢ়বৎ ঝঁংপবঢ়ঃরনরষরঃু বলা হয়। এই অতি প্রবণতার ফলে যদি অদ্ভুত কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তখন তাকে বলা হয় এলার্জি। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্বে ভিন্ন ভিন্নভাবে এলার্জি দেখা দেয়।
এলার্জিতে সাধারণত দেহযন্ত্র আক্রান্ত হয়। দেহ ও মন অভিন্ন সত্ত¡া। এর যে কোনটায় বিঘœ সৃষ্টি হলে অন্যটার উপরও প্রভাব পড়ে। রোগ জগতের পাশাপাশি সমাজ জীবনেও বিভিন্ন ধরনের এলার্জির বিস্তৃৃতি লক্ষ্য করা যায়। ইদানীং তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অজানাকে জানার জন্য নানামুখী জ্ঞান-গবেষণায় মানুষের ‘এনার্জি’ যেমন দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে তেমনি সামাজিক পরিবেশে একে অন্যের প্রতি সহনশীলতা হারিয়ে ক্রমশ বিভিন্ন ধরনের এলার্জিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। কারো সাফল্যে অনেকে পুলকিত হতে পারেন না। ফলে উদ্যোগী ব্যক্তিকে উৎসাহিত করার প্রবণতাও কমে যাচ্ছে। গ্রাম-বাংলার নিভৃত অঞ্চলেও এমন অনেক প্রতিভা দেখা যায় উপযুক্ত উৎসাহ ও পরিবেশ পেলে যারা জাতীয় স্তরে অসাধারণ সৃষ্টি নৈপূণ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। কিন্তু প্রতিভা বিকাশের শুরুতে বিভিন্ন কারণে যে প্রতিক‚ল পরিবেশ আর নিরুৎসাহ করা হয় তা অনেকেই আর উৎরে উঠতে পারে না। মানুষের মনে পরশ্রীকাতরতার যে এলার্জি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে অনেক প্রতিভা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এখন আর আগের মত শুধুই খাদ্যদ্রব্য বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মাঝেই ‘এলার্জি’ সীমিত নেই। একের সাথে অন্যের মনের অমিল হলেই এখন এলার্জির প্রাদুর্ভাব ঘটে। কারো ব্যবসায় উন্নতি দেখে অন্যদের এলার্জি, একজনের পুত্র-কন্যার ভাল রেজাল্টে অন্যজনের এলার্জি কিংবা এক পরিবারের সুখ-সাচ্ছন্দ্যে অন্য পরিবারের এলার্জিভাব এখন প্রায়ই দেখা যায়। যান্ত্রিক সভ্যতার দিকে পৃথিবী যতই এগিয়ে যাচ্ছে সমাজ জীবনের বিভিন্ন স্তরে এলার্জি ততই জেঁকে বসছে।
এলার্জির কারণে ‘যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’ এ ধরনের মানসিক অবস্থা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে আত্মীয়-পরিজন পারে না আত্মীয়ের প্রগতিতে মুগ্ধ হতে। বংশ-মর্যাদা আর আভিজাত্যের এলার্জির শিকার হয়ে অনেক সম্ভাবনাময় দম্পতিকে তাদের নবজীবনের শুরুতেই বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়। সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত হবার আগেই অকালে ঝরে যায় অনেক প্রতিভাময় জীবন। মানুষের মনে পরশ্রীকাতরতা যেভাবে দিন দিন বাড়ছে, স¤প্রীতির সব বন্ধন ছিন্ন করে মনোজগতে হিংসা ও এলার্জি যেভাবে দ্রæতগতিতে বেড়ে যাচ্ছে, সেদিন আর বেশি দূরে নয়, এই সুন্দর পৃথিবীতে সুস্থ- সরল জীবনে এটি এক মারাত্মক দুষ্টক্ষত সৃষ্টি করবে।
বিভিন্ন কারণে অনেকের মধ্যে এলার্জি দেখা দিতে পারে। কোন বিষয়ে কারো স্বার্থ বিঘিœত হলে এক ধরনের এলার্জির হয়। আবার অন্যের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আয়-উন্নতি দেখে কারো মনে এলার্জি হয়। সে কিছুতেই অন্যের সুখ সহ্য করতে পারে না। সামান্য কারণেও কারো কারো মনে এলার্জি হয়। অন্যের ক্ষতি করতে তখন তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। পরশ্রীকাতর অনেকে কোন কারণ ছাড়াই অন্যের ক্ষতি করে মনে আনন্দ পায়। গর্ব করে তারা বলে বেড়ায় ‘আমি থাকতে সে কি করে এত সাফল্য পায় দেখে নেবো’। এদের কাজই হলো অন্যের সাফল্যকে হেয় করে দেয়া। এতেই তারা তৃপ্তি পায়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান হিংসা সম্পর্কে তার ক্ষুরধার লেখনীতে বলেন, ‘হিংসা বৃথাই হীরক-কঠিন সত্যের উপর দাঁত কাটতে পারে। পরিণামে এটা হিংসায় আক্রান্ত ব্যক্তির অস্থি-মজ্জাকেই ধ্বংস করবে’। চিকিৎসার প্রয়োজনে অনেক সময়ই চিকিৎসক এমন সব তথ্য জেনে যান, যা আইনের চোখে অপরাধ বা সমাজের চোখে নিন্দনীয়। মানসিক, এলার্জির কারণে, অন্যায়ভাবে, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কারো ক্ষতি করে নিজের অবৈধ চেষ্টাকে কখনো সমর্থন করা যায় না। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আত্মপ্রতিষ্ঠার যে প্রচেষ্টা সদাই কার্যকরি রয়েছে তার মধ্যে প্রায়ই এলার্জির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মেধা ও বুদ্ধির প্রতিযোগিতায় কেউ জয়ী হলে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়া যায়। কিন্তু অন্যায়ভাবে ভুল পথে কেউ এগিয়ে গেলে তা কখনোই সমর্থন করা যায় না।
পরিশেষে বলিÑ খাদ্যের এলার্জি ওষুধে সারানো যায়। ওষুধের এলার্জি সাবধানতা ও প্রতিষেধক দিয়ে বদ্ধ করা যায়। পোষাক বা গহনার এলার্জি থেকে আক্রান্ত মানুষকে মুক্ত করা যায়। ডাস্ট-এলার্জি নির্মল পরিবেশে কমে যায়। কিন্তু মানুষের মনের এলার্জি কমানোর কোন যন্ত্র আজ অবধি আবিস্কৃত হয়নি। নিছক ওষুধ সেবনেও এটা সম্ভব নয়। মুক্তবুদ্ধির বৃত্তে এসে নিজের চেষ্টায় কেউ যদি তার মনের এলার্জি থেকে মুক্তি পেতে চান তাহলে সাফল্য এসে একদিন ধরা দেবেই। অন্যথায় এলার্জির বিষাক্ত ছোবল থেকে এক সময় দেখা যাবে ছোট-বড় কেউই আর নিরাপদ নয়। তাই এলার্জি আর হিংসার ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হবার এখনই উপযুক্ত সময়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন