বিশ্বে এমন কোনো রাজধানী আছে কিনা যেখানে ফুটপাত, রাজপথ, অলিগলি থেকে শুরু করে ফ্লাইওভারের নিচের পথ অবৈধ দখলে থাকে, তা আমাদের জানা নাই। যদি বলা হয়, ঢাকা অবৈধ দখলের রাজধানী, তবে বেশি বলা হবে না। এখানে অনিয়মই নিয়ম হয়ে উঠেছে। ঢাকার স্থবিরতার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে অবৈধ দখল। এখানে স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দে চলাফেরা কল্পনাও করা যায় না। রাজধানীর চিরায়ত যানজট থেকে স্বস্তি পাওয়ার জন্য যেসব ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশের তলদেশও এখন অবৈধ দখলে চলে গেছে। ফ্লাইওভারের নিচের জায়গায় অবৈধ দোকানপাট, ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের কার্যালয় থেকে শুরু করে মালামালের গোডাউন পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফ্লাইওভার মানে অবৈধ দখলদারদের জন্য নতুন সুযোগ হওয়া। হানিফ ফ্লাইওভা, মহাখালি ফ্লাইওভার, নিকুঞ্জ ফ্লাইওভার, বিজয় সরণী ও তেজগাঁও ওভার পাস থেকে শুরু করে সদ্য উদ্বোধন করা মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা এখন অবৈধ দখলের কবলে। শুধু তাই নয়, ফ্লাইওভারে উঠার মুখের সড়কের আশপাশে অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের কারণেও এগুলোতে উঠতে-নামতে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ফুটপাত, সড়ক ও ফ্লাইওভারের নিচের জায়গার পাশাপাশি রাজধানীর চারপাশের ৩২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের দুই হাজার একর জমিও অবৈধ দখলে চলে গেছে বলে গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব চিত্র থেকে বোঝা যায়, রাজধানীতে এক প্রকার অবৈধ দখলের মহোৎসব চলছে।
রাজধানীকে যানজটমুক্ত করে যাতায়াত মসৃণ করার যে লক্ষ্যে ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে, এর নিচের জায়গা অবৈধ দখলে চলে যাওয়ায় সে লক্ষ্য ভেস্তে যেতে বসেছে। ফ্লাইওভার শুধু দ্রæত পথ অতিক্রমের জন্যই নয়, নগরীর সৌন্দর্য বর্ধক স্থাপনা হিসেবেও কাজ করে। ফ্লাইওভা নির্মাণ করলেই হয় না, এগুলোর উপর এবং নিচের জায়গা নিয়মিত রক্ষনাবেক্ষণ ও তদারকি করা একান্ত অপরিহার্য। দুঃখের বিষয়, এসবের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয় না। বরং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন এগুলো নির্মাণ করেই দায় সারছে। যেভাবে খুশি সেভাবে চললেও তাতে কিছু যায় আসে না। ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা এবং সড়ক অবৈধ দখলমুক্ত, মসৃণ ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার তাকিদ নগরবিদরা বরাবরই দিয়ে আসছেন। এ নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে। তাতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। ফ্লাইওভার একমুখী ও দ্রæতগতির হওয়া সত্তে¡ও দেখা গেছে, এর যেখানে-সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী উঠা-নামা করা হচ্ছে। এতে যানজট সৃষ্টির পাশাপাশি দুর্ঘটনাও ঘটছে। ফ্লাইওভার নিয়ে এমন অনিয়ম দেখার যেন কেউ নেই। ফ্লাইওভারের নিচের যে জায়গা রয়েছে, সেগুলোর সঠিক পরিচর্যা ও সংস্কারের মাধ্যমে নান্দনিকভাবে গড়ে তোলার উপর নগরবিদরা বারবার তাকিদ দিলেও রাজধানীর কোনো কর্তৃপক্ষই তা আমলে নিচ্ছে না। ফ্লাইওভারের নিচের জায়গায় যদি আইল্যান্ড করে গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন করা হতো, তবে এতে সৌন্দর্য যেমন বৃদ্ধি পেত, তেমনি পরিবেশ দূষণও কমত এবং অবৈধ দখল থেকেও রক্ষা পেত। এক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা ঘটছে। অবৈধ দখলকারীরা অবাধে এসব জায়গা দখল করে দোকানপাট বসিয়ে চাঁদাবাজি করছে। এমনকি মাদকের আখড়ায়ও পরিণত করেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র স্বীকার করেছেন, ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা অবৈধ দখলে চলে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙ্গিয়ে একটি শ্রেণী অবৈধ দখল করে চাঁদাবাজি করছে। তিনি সিটি করপোরেশনের জনশক্তি, সরঞ্জামাদি ও পুলিশের সহায়তার অভাবের কথা বলেছেন। মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্র্যাফিক বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা থেকে উচ্ছেদ কার্যক্রম চালালেও কিছুদিন পর তা আবার অবৈধ দখলে চলে যায়। বোঝা যাচ্ছে, উচ্ছেদ ও অবৈধ দখল নিয়ে এক ধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, একবার উচ্ছেদ করলে তা আবার কী করে দখলে যায়? অবৈধ দখল স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যায় না কেন? এক্ষেত্রে সদিচ্ছা এবং গাফিলতির বিষয়টি যে জড়িয়ে আছে, তাতে সন্দেহ নেই। এদিকে বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলসহ, বিভিন্ন মার্কেট, স্কুল-কলেজ, ক্লাব, কমিউনিটি সেন্টারসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সামনের সড়কে অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে এ অনিয়ম চলে আসলেও তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। মতিঝিলের সড়কগুলোর অর্ধেকের বেশি পার্ক করা গাড়ির দখলে চলে যায়। অফিস ছুটির সময় এ এলাকা একপ্রকার স্থবির হয়ে পড়ে। বিভিন্ন মার্কেটের সামনের সড়কের চিত্রও একই। অবৈধ দখলের কবলে যে শুধু রাজধানীর ফুটপাত ও সড়ক তা নয়, রাজধানীকে বেষ্টিত করে রাখা বেড়িবাঁধেও তার থাবা পড়েছে। হাজার হাজার একর জমি অবৈধ দখলে চলে গেছে। এসব উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
রাজধানীকে সচল রাখতে এবং যানজট থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেতে ফুটপাত ও সড়ক অবৈধ দখলমুক্ত করার বিকল্প নেই। আমরা দেখেছি, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি সদিচ্ছা পোষণ ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে, তবে যানজট সহনীয় হয়ে ওঠে। গাবতলী সড়ক তার অন্যতম উদাহরণ। এ সড়কটি থেকে অবৈধভাবে পার্কিং এবং যানবাহন থামিয়ে রাখা বন্ধ করায় তা এখন অনেকটাই যানজটমুক্ত। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে যদি অবৈধ দখল এবং পার্কিং চিরতরে বন্ধ করা যায়, তবে যানজট অর্ধেক কমে যাবে। নগরবিদরা মনে করছেন, যানজট থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যে ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে, তাতে উঠা-নামার প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রæত না হলে এ উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এগুলো হয়ে উঠবে জনগণের অর্থ অপচয়ের স্বারক। কাজেই অবৈধ দখল এবং পার্কিং বন্ধে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে। অবৈধ দখলদাররা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, জনস্বার্থে তাদের নিবৃত করতে হবে। ফ্লাইওভারের নিচের জায়গায় যেসব অবৈধ দোকানপাট ও স্থাপনা রয়েছে, সেগুলো উচ্ছেদে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উচ্ছেদের পর এসব জায়গা যাতে পুনর্দখলে না যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। সৌন্দর্য বর্ধক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। একশ্রেণীর লোকজন রাজধানীতে যেমন খুশি তেমন অপকর্ম চালিয়ে যাবে, তা চলতে দেয়া যায় না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন