বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা উত্তরের সফল ও নন্দিত মেয়র আনিসুল হকের ইন্তেকালের সংবাদটি শুনে দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কোন ঘটনায়ই সাংবাদিকদের কখনো আবেগপ্রবণ হতে নেই। এই সত্যটি জেনে এবং মেনেও একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে আমি মেয়র আনিসুল হকের ইন্তেকালের খবরটিতে নিজেকে আবেগের বাইরে রাখতে পারিনি। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। আমার মতো আমার পরিবারের সকল সদস্যও এই ঘটনায় শোকে মুহ্যমান। মনটাকে কিছুটা হালকা করার জন্য টেলিফোনে বেশ কয়েকবার বিষয়টি নিয়ে কথা বললাম ইনকিলাব সম্পাদক শ্রদ্ধেয় বাহাউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে। বাহাউদ্দীন ভাইও ছিলেন শোকে মুহ্যমান এবং আমার সাথে কথা বলার সময় বার বার থেমে আসছিল তার কণ্ঠ। আনিসুল হকের স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে বাহাউদ্দীন ভাই বলছিলেন, “দীর্ঘদিন পর আমরা ঢাকার মানুষ আনিসুল হককে মেয়র হিসেবে পেয়ে ঢাকা শহরকে উন্নত শহর হিসেবে দেখার একটা স্বপ্ন দেখতে পেয়েছিলাম। কারণ মনে এবং কর্মে মেয়র আনিসুল হক ছিলেন একজন প্রকৃত উন্নয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা। তার এই অকাল মৃত্যুতে আমাদের সেই স্বপ্ন এখন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে”। মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর সংবাদ ছরিয়ে পড়ার সাথে সাথে শোকে আচ্ছন্ন হয়ে যায় ঢাকার কোটি কোটি মানুষ। বেদনাভারাক্রান্ত কেউই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না তার এই অকাল মৃত্যুকে। আনিসুল হককে হারানোর বেদনা ঢাকার কোটি কোটি মানুষের কাছে তাদের পরিবারের আপনজন হারানোর বেদনাকেও যেন হার মানিয়েছে। মেয়র আনিসুল হকের এই আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনায় বারবার যে বিষয়টি সামনে চলে আসছে তা হলো আমরা ঢাকাবাসীরা আসলেই বড় দুর্ভাগা!!! তা নাহলে বর্তমানে ঢাকা শহরের মতো একটি অনিয়মতান্ত্রিক অপরিকল্পিত অভিশপ্ত ও অনেকটাই বসবাস অনুপযোগী একটি নোংরা শহরকে হাজারো সমস্যা আর বিরোধিতাকে মোকাবেলা করে ঠিকঠাক করার উদ্যোগ নেয়ার মতো যে সাহসী মানুষটিকে আমরা প্রথমবারের মতো মেয়র হিসেবে পেয়েছিলাম তাকে কেন এভাবে অকালে চলে যেতে হবে?
একজন মানুষ তার কর্মক্ষেত্রে সততা, দক্ষতা, আন্তরিকতা, স্বদিচ্ছা ও সাহস নিয়ে কাজ করলে যে অল্প সময়েই অনেক বেশি সফল ও নন্দিত হতে পারেন তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক। মেয়র হিসেবে আনিসুল হকের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে তিনি ঢাকা শহরের হতাশাগ্রস্ত ক্ষুব্ধ ও অসহায় কোটি কোটি মানুষকে নতুন আশার স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথমবারের মতো ঢাকা শহরের অবহেলিত জনগণ এই আশায় বুক বেঁধেছিল। “এতদিনে হয়তো আমাদের ঢাকা শহরের সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব হবে কারণ আমাদের নগরপিতা এখন আনিসুল হক”। কিন্তু সব হিশাব-নিকাশ উলোট পালট করে দিয়ে আমাদের সকলের প্রিয় মেয়র আনিসুল হক যে এভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন তা ছিল সকলের কাছেই একেবারে অপ্রত্যাশিত। মেয়র হিসেবে আনিসুল হক খুব বেশীদিন দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পাননি। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরেই তিনি দায়িত্বে থেকে রাজধানী ঢাকার উন্নয়নে যে কয়েকটি অসাধারণ কাজ করার নজির সৃষ্টি করেছেন তা ঢাকার ইতিহাসে বিরল। সবচেয়ে বড় কথা আনিসুল হকের অ্যাকশন প্ল্যানে প্রথমবারের মতো ঢাকার, আমুশ বেশ সহজেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে ঢাকাবাসীর জন্য দৃশ্যমান একজন মেয়র যে দায়িত্বে রয়েছেন। দীর্ঘদিন অবৈধ দখলে থাকা তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডটিকে আনিসুল হক যেভাবে সাহসের সঙ্গে সরিয়েছিলেন সেটি আর কোনদিন ঢাকার কোন মেয়রের পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আমাদের দেশের বিভিন্ন শ্রেণীপেশায় থাকা খারাপ মানুষ ও অপরাধীরা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় সেনাবাহিনীকে। কিন্তু সেই সেনাবাহিনী সমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের সরকারও যে কাজটি করতে পারেনি, মেয়র আনিসুল হক সেই কঠিন কাজটি করেছিলেন অত্যন্ত দ্রæততম সময়ের মধ্যেই কেবল তার সততা, দৃঢ়চেতা সিদ্ধান্ত আর সাহসের কারণে। এইরকম অসংখ্য ভালো ভালো প্রশংসনীয় কাজের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন আনিসুল হক। ঢাকায় বসে হম্বিতম্বি করা বেশ কয়েকটি বিদেশী রাষ্ট্রের দূতাবাস যেভাবে দীর্ঘদিন ধরে গুলশান আর বারিধারার রাস্তা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছিল সেগুলোকে হাত দেওয়ার কোন সাহসই কোনদিন দেখায়নি যুগ যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারগুলো। অথচ মেয়র আনিসুল হক তার একক সিদ্ধান্তে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন বিদেশী দূতাবাসগুলোর সেই সব অবৈধ স্থাপনাগুলো। একেবারে জিরো টলারেন্স দেখিয়ে এই কাজগুলো করেছিলেন তিনি। যে কারণে খুব অল্প সময়েই ঢাকার মানুষের কাছে ইতিহাসের সবচেয়ে আস্থাভাজন ও জনপ্রিয় মেয়র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন আনিসুল হক। গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকাকে পুরোপুরি যানজট মুক্ত রেখেছিলেন তিনি। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে মহাখালী পর্যন্ত সড়কটিকে আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন করতে নিয়েছিলেন স্বপ্নকেও হার মানানো পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। উত্তরা, গুলশান ও বনানীর বেশ কিছু সড়ককে তিনি আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ এমন উন্নতমানের সড়কে রূপান্তরিত করেছেন যেগুলো দেখলে মনে হয় যেন আমরা ইউরোপের কোন সড়কে দাঁড়িয়ে। মেয়র আনিসুল হকের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ আর সিদ্ধান্ত ছিল ঢাকার যানজট নিরসনে কয়েকটি কোম্পানির মাধ্যমে রাজধানীতে অত্যাধুনিক বাস সার্ভিস চালু করা এবং শাহাবাগ থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ২১টি পয়েন্টে ইউলুপ তৈরি করা। এই দুইটি বিষয়ে কাজও তিনি অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ার পরপরই তার এই উদ্যোগ সম্পূর্ণ মুখ থুবরে পড়ে যায়। অথচ এই দুটি উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে ঢাকা শহরের চেহারাই পালটে যাবে অনেকাংশে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে ঢাকাবাসীরা। পদ এবং চেয়ার কখনোই খালি থাকে না। বাস্তবতার ধারাবাহিকতায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে আবারো একজন নতুন মেয়র আসবেন। নতুন মেয়র তার মতো করে কাজ শুরু করবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে গভীরভাবে শোকাহত ঢাকা উত্তরের সন্দিহান মানুষের মনে একটাই প্রশ্ন এবং তা হলো নতুন মেয়র কি আনিসুল হকের শুরু করা ও উদ্যোগ নেয়া, প্রশংসনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেবেন? এইক্ষেত্রে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার ফলাফল কিন্তু মোটেও সুখকর নয়। মেয়র আনিসুল হকের নেয়া উদ্যোগগুলো যাতে দ্রæত এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয় সেই ব্যাপারে সরকারেরও আন্তরিক হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছেন ঢাকা উত্তরের জনগণ। আনিসুল হক আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তিনি শুধু ঢাকাবাসীর মনেই নন সারা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়েই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার সৃষ্টিশীল মনন আর কর্মের দ্বারা। একথা নিশ্চিত করেই বলা যায় ঢাকার মানুষ ভবিষ্যতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাÐের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় উপমা হিসেবে বারবার উচ্চারণ করবে কেবল মেয়র আনিসুল হকের নাম। এটাই মানুষ হিসেবে আনিসুল হকের সবচেয়ে বড় সফলতা আর প্রাপ্তি। এক কথায় মেয়র আনিসুল হকের এই অকাল বিদায় কোনভাবেই আর কারো মাধ্যমে পূরণ হবার নয়। তার এই অনুপস্থিতি অপূরণীয় এবং এই অপূরণীয় শব্দটি কেবল তার ক্ষেত্রেই যেন শতভাগ প্রযোজ্য। আমরাও শোকাহত দৈনিক ইনকিলাবের সকল সাংবাদিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অগণিত পাঠকদের পক্ষ থেকে মরহুম আনিসুল হকের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করছি যেন আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করেন। সেইসঙ্গে মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সকল সদস্য সদস্যাদের প্রতি প্রকাশ করছি গভীর সমবেদনা ও সহমর্মিতা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন