সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে এখন নানা রকম বিশ্লেষণ চলছে। বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয় অনেকের কাছেই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তারা বলছেন, নির্বাচনে জয়-পরাজয় বিস্ময়কর কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু প্রায় দশ বছর ধরে টানা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দলের প্রার্থীর এমন পরাজয় কোন কারণে- অনেকেই তা ভেবে পাচ্ছেন না। কেউ কেউ এ ফলাফলকে সরকার ও জাতীয় পার্টির গোপন সমঝোতার প্রতিফলন বললেও অনেকেই তা মেনে নিতে পারছেন না। কারণ জাতীয় নির্বাচনের আগে এ গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে হেরে যাওয়াটা সরকারের ভাবমর্যাদার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, সে আশঙ্কা ছিল। সুতরাং বিএনপিকে ঠেকাতে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ওয়াক ওভার দিয়েছে- এটা ভাবা বাস্তব সম্মত হবে বলে মনে হয় না।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, মেয়র পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতাকারী প্রধান তিন প্রার্থীই পুরনো। আগেরবারও তারা মেয়র পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছিলেন। এ তিন প্রার্থীর মধ্যে বিজয়ী প্রার্থী জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা এবং বিএনপি প্রার্থী কাওসার জামান বাবলার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা এবার বেড়েছে। শুধু আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, বর্তমান সরকারের ওপর রংপুরবাসীর আস্থা অনেকাংশেই কমেছে। এটাকে যদি সারাদেশের ভোটারের মনোভাবের প্রতিফলন হিসেবে ধরে নেয়া হয়, তাহলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফলাফল কী দাঁড়াবে তা অনুমান করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়।
রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল ও অন্যান্যদের প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। একটি বিষয়ে সবাই একমত পোষণ করেছেন যে, নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। ভোট গ্রহণ হয়েছে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে। ভোটাররা নির্বিঘেœ ভোট দিতে পেরেছে। কোথাও কোনো জবরদস্তি, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেনি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখা গেছে, শান্তিপূর্ণভাবে লাইন ধরে ভোটাররা ভোট দিচ্ছেন এবং কেউ কোনো অভিযোগ করছেন না। বরং ভোট পরিস্থিতিতে সবাই সন্তোষ প্রকাশ করছেন।
নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার ঘটনাকে অনেকেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেন না। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়াটা স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। এর পেছনের কারণ উদঘাটনে দলটি আদৌ কোনো পদক্ষেপ নেবে কীনা তা নিয়ে সচেতন মহলের সন্দেহ রয়েছে। তবে, একটি বিষয় অনেকের চোখেই ধরা পড়েছে। তাহলো, রংপুর সিটি নির্বাচনে প্রার্থী দিলেও বিজয়ী হওয়ার বা সম্মানজনক ব্যবধানে পরাজয়ের কোনো চেষ্টা দলটির নেতাকর্মীরা করেনি। এর আগে নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা যেভাবে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন, রংপুরের ক্ষেত্রে তা ছিল একেবারেই অনুপস্থিত। অনেকেই মনে করছেন যে, অবধারিত পরাজয়ের বিষয়টি আঁচ করতে পেরেই বিএনপি রংপুর নির্বাচনে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ পন্থা অবলম্বন করেছে।
রংপুর নির্বাচনের ফলাফল দেশের রাজনীতি ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হিসাব-কিতাব অনেকটাই এলোমেলো করে দিয়েছে। প্রথমত সরকারের জনসমর্থন যে ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিষয়টি সরকারি দলের নেতারাও প্রকান্তরে স্বীকার করছেন। তাদের কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন যে, এত উন্নয়ন কাজ করার পরও মানুষ কেন ভোট দিল না তা বোধগম্য নয়। অবশ্য তারা এটাও বলছেন যে, জাতীয় পর্যায়ে সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন করলেও রংপুরের মেয়র ঝন্টু তার মেয়াদকালে নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। ফলে রংপুরবাসী তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল এই নির্মম পরাজয়ের নেপথ্য কারণ, এমন কথাও বলছেন কেউ কেউ। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড এ পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান ও তদানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য সিটি নির্বাচন ও উপ-নির্বাচনে রংপুরের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। অবশ্য নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এবং তাতে গণতন্ত্রের জয় হয়েছে বলে আত্মতুষ্টি লাভের একটি চেষ্টা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন যে, আওয়ামী লীগের পরাজয়কে তারা গণতন্ত্রে বিজয় বলে মনে করেন কীনা। সে রকম হলে আগামী নির্বাচনগুলোতে গণতন্ত্রকে বিজয়ী করতে দেশবাসী যদি রংপুরের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তাহলেও কি তারা একই অনুভূতি ব্যক্ত করবেন?
দ্বিতীয়ত এরশাদের জাতীয় পার্টির শক্তিশালী অবস্থানের ঘোষণা। রংপুরের নির্বাচনের ফলাফল বলে দিচ্ছে যে, এক সময়ের নিন্দিত ও পতিত রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল ইতোমধ্যে মন্তব্য করেছেন যে, আগামীতে জাতীয় পার্টির সমর্থন ছাড়া বড় দুই দলের কোনোটির পক্ষেই রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব হবে না। সুতরাং এরশাদ তথা জাতীয় পার্টিকে কাছে পেতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে যদি এখন থেকেই টানাটানি শুরু হয়ে যায়, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
তৃতীয়ত বিএনপির নড়বড়ে সাংগঠনিক অবস্থারও জানান দিয়েছে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। অনেকে হয়তো বলবেন, রংপুর জাতীয় পার্টির ঘাঁটি। সেখানে বিএনপির জয়লাভ সম্ভব নয়। বাস্তবতা সেটাই বলে। তবে, একেবারে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়াটা কি মেনে নেয়ার মতো? সেখানে তো বিএনপির অন্যতম শরীক জামায়াতেরও ভোট ছিল। সে ভোটগুলো কোথায় গেল? তাহলে কি বিএনপির রংপুরের নেতারা জামায়াতের সঙ্গেও সঠিকভাবে লিয়াঁজো করতে পারেনি? পরাজয়ের কারণ খুঁজে বের করার জন্য বিএনপি কোনো উদ্যোগ নেবে কীনা এখনও জানা যায়নি। সে রকম কোনো আভাস-ইঙ্গিতও দলটির পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি।
রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে নির্বাচন কমিশন। তারা প্রমাণ করেছে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা সক্ষম। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও তারা এমন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে পারবে- এমন একটি বার্তা দেশবাসীকে দেয়ার চেষ্টা লক্ষণীয়। কিন্তু স্থানীয় সরকারের নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনের গুরুত্ব যেমন এক নয়, তেমনি সে নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্তরা একই রকম ভূমিকা পালন করবে এমনটি ভাবাও ঠিক নয়। তাছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকার পরিবর্তনের কোনো আশঙ্কা থাকে না। ফলে ক্ষমতাসীনরা সেসব নির্বাচনে মরিয়া হয়ে নাও উঠতে পারে। আর রংপুর সিটি নির্বাচনটি অনুষ্ঠি হয়েছে এমন সময়ে, যখন বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থা নেতিবাচক। সরকার চেয়েছে নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হোক, যাতে দেশবাসীকে দেখানো যায়, এ সরকারের অধীনে বর্তমান নির্বাচন কমিশন প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম। অবশ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আরো পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন রয়েছে। রংপুর নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাব সেগুলোতে কতটুকু পড়বে, আর সরকারের মনোভাব কতটা পরিবর্তন হবে, তা এখনই বলা যাবে না। সিটি হারানোর ঝুঁকি নিয়ে সরকার সেসব নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার অবস্থানে থাকবে, নাকি ২০১৫ সালের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে সে কথা বলার সময়ও এখন পর্যন্ত আসেনি। তবে, এটা বলা যায় যে, সরকার এখন ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে। আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য সিটি নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও অবাধ করলে পরাজয়ের সমূহ আশঙ্কা, আবার না করলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবির যৌক্তিকতা শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়। ফলে বড় মাছ জালে ফেলার আশায় সরকার ছোট মাছ ছেড়ে দেবে কীনা সেটা এখন দেখার বিষয়।
এদিকে রংপুর নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি রয়েছে ফুরফুরে মেজাজে। দলটির চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ নেতারা বলছেন যে, আগামীতে তাদেরকে ভাগ না দিয়ে কেউ সরকার গঠন করতে পারবে না। বাস্তবতাও প্রায় সে রকমই। এই নির্বাচন এরশাদ তথা জাতীয় পার্টিকে দর কষাকষির একটি মোক্ষম সুযোগ এনে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ তো জাতীয় পার্টির পুরনো দোস্ত। এখন বিএনপিও ক্ষমতায় যাবার আশায় জাতীয় পার্টির দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে পারে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি কী করবে তা এখনই বলা যাবে না। তারা যে দিকে পাল্লা ভারী সেদিকেই ভর দেবে। অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটা অনুমান করা যায় যে, এরশাদের জাতীয় পার্টি হয়তো শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধবে। যদিও দলটির চেয়ারম্যান এরশাদ বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি তিন শ’ আসনেই প্রার্থী দেবে। এদিকে আগামীতে এরশাদের ভূমিকা বা অবস্থান কী হবে সে সম্পর্কে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে, এরশাদের শেষকথা কোনটা তা বলার সময় এখনও আসেনি। বস্তুত সাম্প্রতিককালে সকাল-বিকাল কথা ও অবস্থান পরিবর্তনের যে দৃষ্টান্ত এরশাদ স্থাপন করেছেন, সে পরিপ্রেক্ষিতে ওবায়দুল কাদের যথার্থই বলেছেন।
শেষ কথা হলো, রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় রকমের একটি ঝাঁকুনি দিয়েছে। এটা আগামী দিনের রাজনীতিতে কিছু না কিছু প্রভাব ফেলবেই। উদ্ভূত সে নতুন পরিস্থিতিতে যে দল সঠিকভাবে কৌশল প্রয়োগ করতে পারবে, সাফল্য হয়তো তাদের হাতেই ধরা দেবে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন