রাজধানীতে কিশোর গ্যাং-এর উৎপাত আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে উত্তরায় বিভিন্ন নামে গ্যাং গ্রুপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গ্রুপগুলো নিজেদের মধ্যে যেমন দ্ব›েদ্ব লিপ্ত, তেমনি তাদের ভয়ে এলাকাবাসী আতঙ্কিত। গতকাল প্রকাশিত একটি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কিশোর গ্যাং গ্রুপের পাঁচটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। বিচিত্র নামের এসব গ্যাং গ্রুপের মধ্যে রয়েছে ডিসকো বয়েজ, নাইন স্টার ক্লাব, নাইন এমএম, সেভেন এমএম এবং বিগ বস। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার। গ্যাং গ্রুপগুলোর অধিকাংশ সদস্যই স্কুল পড়–য়া কিশোর। তারা ফেসবুকে হত্যা, খুনসহ নৃশংস বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। সেই সঙ্গে দল বেঁধে মাঠে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, নিরীহদের মারধর করে বেড়ায়। ফেসবুকের মাধ্যমে তারা অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দলে ভেড়ানোর ঘোষণা দিয়ে থাকে। গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা উত্তরার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী। এর বাইরে কিছু শ্রমজীবী কিশোরও রয়েছে। উচ্চ, মধ্য ও নিম্নবিত্ত তিন ধরনের পরিবারের সদস্যরাই গ্যাং গ্রুপগুলোর সঙ্গে জড়িত। একটি গ্রুপ যখন আরেকটির উপর আক্রমণ করে তখন তার সহযোগিতায় অন্য গ্রুপগুলোও এগিয়ে আসে। ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের উপর হামলা চালায়। কিশোর গ্যাং গ্রুপের দৌরাত্ম্যে একদিকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অস্থির, অন্যদিকে এলাকাবাসীও আতঙ্কিত। তাদের ভয়ে অনেকে চুপ থাকে। অনেকে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়।
গত বছরের ৬ জানুয়ারি উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র আদনানকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে কিশোর গ্যাং গ্রুপ অস্তিত্ব জানান দেয়। আদনান তার সমবয়সী ও দু-এক ক্লাস ওপরে পড়া ছাত্রদের হাতে খুন হয়েছিল। এরা নাইন স্টার গ্রুপের সদস্য। হত্যাকান্ডের পর গ্রেফতারকৃত ২২ আসামির মধ্যে ১৫ জন জামিনে বেরিয়ে আসে। জামিনে বেরিয়ে এসে আদনানের বাবা কবীর হোসেনকে মামলা প্রত্যাহার করার জন্য হুমকি দিতে থাকে। তাদের হুমকিতে তিনি এখন উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছেন। শুধু আদনানের পরিবার নয়, এমন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে অন্যরাও। আদনান খুন হওয়ার পর উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এক ডজন কিশোর গ্যাং-এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ধরপাকড় হওয়ায় কিছুদিনের জন্য গ্রুপগুলো আড়ালে চলে গেলেও গত বছরের সেপ্টেম্বরে ফেসবুকে পুণরায় ফিরে আসার ঘোষণা দেয়। তারপর থেকে গ্রুপগুলো একের পর এক ঘটনা ঘটাতে থাকে। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ স্কুলের শিক্ষার্থীদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে দলে বেড়ানো, বাসা থেকে টাকা আদায়, হোস্টেলের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দিন হিসেবে চাঁদা আদায় থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে। এলাকায় তাদের নাম জানান দেয়ার জন্য দেয়ালে দেয়ালে স্প্রে করে গ্রুপের নাম লিখে দেয়া হয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় এ ধরনের কিশোর সন্ত্রাসী গ্রুপের উত্থান এবং তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা ও অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে সন্ত্রাসী গ্রুপের সাথে জড়িত কিশোরদের পরিবারই মূলত দায়ী। সন্তানের প্রতি পরিবারগুলোর উদাসীনতা এবং প্রশ্রয় তাদের দুর্বিনীত করে তুলেছে। সন্তান স্কুলে ঠিকমতো যাচ্ছে কিনা, কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে-এ বিষয়গুলো উপেক্ষা করে যাওয়ায় তারা অসৎ সঙ্গে পড়ে বিপদগামী হয়ে পড়ছে। কিশোর মনের অ্যাডভেঞ্চারিজম দ্বারা তাড়িত হয়ে এবং নিজেকে শক্তিমান ভাবা থেকেই তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়াতে উৎসাহী হয়ে উঠছে। মনোবিদরা মনে করছেন, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের যত্মশীল না হওয়া এবং পড়াশোনার বাইরে ভিডিও গেমস, ফেসবুক ইত্যাদিতে আসক্ত হয়ে পড়ার ফলে তাদের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটছে। বিশেষ করে ভিডিও গেমসে বিভিন্ন অ্যাকশন গেমস তাদের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। এ থেকে উৎসাহী হয়ে বাস্তব প্রয়োগ ঘটানোর জন্য নিজেরাই গ্যাং গ্রুপ গড়ে তুলছে। এক গ্রুপের পাল্টাপাল্টি হিসেবে আরেক গ্রুপের জন্ম হয়। একে অপরের শক্তি পরীক্ষার জন্য সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে নৃশংসতা সৃষ্টি হলেও, একেই তাদের বীরত্ব প্রতিষ্ঠা হিসেবে মনে করছে। তাদের আধিপত্য ও অপকর্ম বিস্তারের লক্ষ্যে গ্যাংয়ের বাইরে সাধারণ মানুষের উপর হামলা চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে। কিশোর মনের এই অতি উৎসাহী ও অনিয়ন্ত্রিত মনোভাবের কারণে তারা খুন করতেও দ্বিধা করছে না। সমাজের জন্য এ এক নতুন প্রপঞ্চ হয়ে উঠেছে।
কিশোর গ্যাং গ্রুপ গড়ে ওঠা প্রতিরোধে পরিবারের ভূমিকা অপরিহার্য। পরিবারের অভিভাবকদের এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তানের দৈনন্দিন কার্যক্রম ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কোনো ধরনের অনিয়ম ও অসামঞ্জস্য আচরণ পরিলক্ষিত হলে তাকে সচেতন ও শাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বৈষয়িক উন্নতির দিকে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে অনেক অভিভাবক সন্তানের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ছেন। সন্তান সারাদিন কী করে, কোথায় যায়, কখন বাসায় ফিরে-এসব বিষয়ে কোনো খোঁজ-খবর রাখেন না। বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যকার এ দূরত্বই সন্তানকে অনিয়ন্ত্রিত আলাদা জগতে নিয়ে যায়, যেখানে সে নিজের মতো করে চলাচল শুরু করে। সঠিক গাউডেন্সের অভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে মারাত্মক অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়ে। সন্তানের এই বিপথে যাওয়ার দায় বাবা-মাকেই নিতে হবে। আমাদের সমাজে সন্তান অপকর্ম করলে প্রথমেই ‘কার সন্তান’ এ প্রশ্ন ওঠে। কাজেই পরিবারের সম্মান ও সমাজে বিশৃঙ্খলা এড়াতে অভিভাবকদের সন্তানের প্রতি যত্মশীল ও খেয়াল রাখার বিকল্প নেই। উত্তরাসহ রাজধানীর যেসব এলাকায় কিশোর গ্যাং গ্রুপ গড়ে উঠেছে, তা নির্মূলে অভিভাবকদের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। অপরাধী গ্রেফতার হয়ে জামিনে বের হয়ে এসে পুনরায় যাতে একই অপরাধে জড়িয়ে না পড়ে, এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অভিভাবকসহ সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এলাকাভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন