শিক্ষকরা প্রচন্ড শীতে খোলা আকাশের নিচে তাদের দাবি নিয়ে লড়াই করছে, অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তারা প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কারো ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ৭টি কলেজের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে তুলকালাম চলছে। ইতিপূর্বে পুলিশের সরাসরি টিয়ার শেল নিক্ষেপণে সিদ্দিকুর রহমান নামে এক ছাত্র চক্ষু হারিয়েছে। সম্প্রতি অন্তর্ভুক্তিকে বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র/ছাত্রীদের ছাত্রলীগ পিটিয়েছে। বেসরকারি একটি মেডিকেল কলেজের ছাত্র/ছাত্রীরা আন্দোলন করায় কলেজের মালিক আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচিত সাবেক এক এমপি ছাত্র/ছাত্রীদের মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। মিডিয়াতে ধারণকৃত এ ভিডিও দেশে ও বহির্বিশ্বে অনেকেই দেখেছে। দৃশ্যটি হয়তো প্রধানমন্ত্রী দেখেননি, অথবা তার গোয়েন্দা সংস্থা ঘটনার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেননি। তাই যদি না হয় তবে আন্দোলনরত ছাত্র/ছাত্রীদের মাথা খুলি উড়িয়ে দেয়ার হুমকি কি আইন ভঙ্গের কারণ হতে পারে না? প্রধানমন্ত্রীর প্লাটফর্মের বিরোধী কেউ যদি এভাবে হুমকি প্রদর্শন করতো তবে ‘আইন’ নিশ্চয় অগ্নিমূর্তি নিয়ে অভির্ভূত হতো। এ ক্ষেত্রে ‘আইন’ নিরব নিশ্চুপ এ জন্য যে, বাংলাদেশে একই আইন দু’ভাবে প্রয়োগ হয়, সরকারি দলের জন্য মধু ও বিপরীত চিন্তার জনগোষ্ঠির জন্য বিষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চিরকাল শুনেছি যে, আইনের হাত অনেক লম্বা। আর এখন দেখছি, আইনের হাত দিন দিন খাটো হয়ে আইন প্রয়োগকারীর হাত লম্বা হয়ে যাচ্ছে।
ড. ইউনূস বলেছেন, রাজনীতি এখন টাকাওয়ালাদের দখলে চলে গেছে। ব্যবসা, বাণিজ্য ও শিল্পে দেশকে সমৃদ্ধ করার জন্য ধনীক শ্রেণির একটি ভ‚মিকা সকলেই প্রত্যাশা করে। কিন্তু সে শ্রেণি তাদের ব্যবসায়িক খাত পরিবর্তন করে ব্যাংক লুটের পর ভ‚মি দস্যুতা, মিডিয়া, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিভাগে ঢুকে পড়েছে। এ খাতগুলি অত্যন্ত নিরাপদ, কারণ একদিকে শ্রম নিয়োগের খাত যেমন গার্মেন্টস শিল্পের মতো শ্রমিক অসন্তোষ্টির কোন কারণই নেই, দ্বিতীয়ত এগুলোতে সমাজসেবার একটি গন্ধ আছে। আর্থিক মুনাফার পাশাপাশি সম্মান রয়েছে প্রচুর। কিন্তু রাজনীতিবিদদের সম্মান ও সাংবিধানিক অধিকার নানাভাবে ক্ষুণœ ও ব্যাহত হচ্ছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে যা ছিল এখন তার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। স্বাধীন দেশের পুলিশী প্রশাসন ঔপনিবেশিক কায়দায় চলছে।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে গণসংযোগ করার সময় পুলিশ আমাকে গ্রেফতারের জন্য উদ্ব্যত হয়। একজন স্বাধীন দেশের নাগরিককে গ্রেফতারের জন্য (বিরোধী দলের হলে) পুলিশ কতটুকু মারমুখী হতে পারে মিডিয়াতে ধারণকৃত চিত্র দেখলেই বুঝা যায়। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা বলে বেড়ায় ছাত্র জীবনে ‘উমুক’ হলের (বিশ্ববিদ্যালয়ের) ছাত্রলীগের ‘উমুক’ বিষয়ক সম্পাদক ছিলাম। অন্যদিকে সেই একই লোক বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন বলতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘উমুক’ হলের ছাত্রদলের ‘উমুক’ বিষয়ক সম্পাদক ছিলাম। এসব কথা বলে নিজেদের অযাচিত ক্ষমতা জাহির করার জন্য এবং ক্ষমতাসীনদের আনুক‚ল্য পাওয়ার জন্য এ ধরনের প্রচার চালাতে থাকে এবং নিজেদের করিৎকর্মা প্রমাণের জন্য সরকার বিরোধীদের উপর নির্যাতন করে প্রমোশন পায়। অন্যদিকে বড় বড় রাজনৈতিক দলে জবাবদিহিতা নেই বলে খোলস বদলাতে বেগ পেতে হয় না। সাফারি ছেড়ে মুজিব কোট, সময় পাল্টে গেলে মুজিব কোর্ট ছেড়ে সাফারি এ দেশে একটি রুটিন ওয়ার্ক। কিন্তু এতে যাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হয় তাদের আর্তনাদ দলীয় প্রধানসহ কেউ শুনতে পায় না।
সংবাদপত্রের কণ্ঠকে রোধ করার জন্য প্রণীত আইসিটি অ্যাক্ট এর ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের মুখে সরকার তা রদ করার আশ্বাস দিলেও অধিকতর কঠিন আইন প্রস্তাব করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায়; যাতে সরকারের সামান্য সমালোচনাও কেউ করতে না পারে। আইসিটি অ্যাক্টের অধীনে যে সকল মামলা হয়েছে তাও চলবে। যদি তাই হয় তবে উক্ত আইনটি রদ ও রহিত করে লাভ কী? সরকার এখন কোনো যুক্তি মানে না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাই তাদের একমাত্র যুক্তি।
চলতি ২০১৮ সাল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। এ নির্বাচনকে সামনে রেখেই সরকারের যত আত্মঘাতী খেলা এবং এ খেলায় হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আইন আদালত। সরকার প্রধান এক সময় নিজেই বলেছিলেন, তিনি আর কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেখতে চান না। এখন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করাসহ এক তরফা নির্বাচন তথা বিএনপি ছাড়া নির্বাচন করার জন্য যতটুকু করার দরকার, সংবিধান ও নৈতিকতা বিরোধী হলেও সবই করা হচ্ছে।
১/১১ অবৈধ সরকারের আমলে দু’নেত্রীই কারাবন্দী ছিলেন। যে সকল রাজনীতিবিদ ১/১১ সরকারের সাথে হাত মেলায়নি তারাও জেলে ছিল। আমিও সে সময় ২৬ মাস জেল খেটেছি। কিন্তু কোন যাদুর সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী এমপিরা খালাস পেয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছেন আর বিরোধীরা কোর্ট আর কারাগারবাসী হয়ে রইলো এ প্রশ্নও কিন্তু একদিন না একদিন জাতির সামনে উঠে আসবে। এ মর্মে ঘধঃঁৎধষ ঔঁংঃরপব কি ব্যাহত হয়নি? আইন ও আদালতকে কি কোনদিন এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না?
খালেদা জিয়া গৃহবধু থেকে রাজনীতিতে এলেও রাজপথ থেকেই ক্ষমতায় এসেছেন। বহু ঝড়-তুফান তার পরিবারের উপর দিয়ে গিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপর দিয়েও ঝড় কম যায়নি। তারপরও কি প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদের নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের দৃঢ় প্রত্যয়ী থেকে যাবেন? সময়ের চাকা ঘুরে যখন ইতিহাস রচিত হবে তখন বিষয়টি কোন আংগিকে মঞ্চস্থ হবে? বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফেনেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল মামলাসহ গেটকো, নাইকো দুর্নীতি মামলা ছাড়াও ১৪টি মামলা বিশেষ আদালতে বিচারের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে তিন দিনই খালেদা জিয়াকে মাদরাসা আদালতে হাজির থাকতে হয়। অনুরূপ মামলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধেও ছিল, কিন্তু একই ধারায় দায়েরকৃত মামলায় শেখ হাসিনা খালাস হয়ে প্রধানমন্ত্রী, অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এখনো মামলার ঘানি টানছেন। বাকপটু মন্ত্রীরা দীপ্ত কণ্ঠে দৃঢ়তার সঙ্গে বলছেন, খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হবে, একদিনের জন্য হলেও জেলের ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘোষণা কারা দিচ্ছেন যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেও অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করতেন, যারা গণবাহিনী গঠন করে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে তারাই শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য হয়ে আদালতের রায় প্রকাশের পূর্বেই খালেদা জিয়াকে আগাম জেল দিয়ে দিচ্ছেন। দেশের সাধারণ মানুষ মনে করে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে প্রধান প্রতিবন্ধক মনে করেন। ফলে শেখ হাসিনা চাচ্ছেন বলেই তার মন্ত্রীরা দেশবাসীকে খালেদা জিয়ার জেলের আগাম বার্তা দিচ্ছেন। এতে কী প্রতিয়মান হয়? খালেদা জিয়াকে আগামী নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার জন্য তাকে সাজা দেয়ার বিষয়ে আদালতের উপর প্রভাব বিস্তার করার জন্যই কি মন্ত্রীদের এই আস্ফালন? মামলার রায় সংক্রান্ত মন্ত্রীদের আগাম বক্তব্য কি আদালত অবমাননা আওতায় পড়ে না?
সকলেই বলছেন, সর্বজন গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন হওয়া দরকার এবং এটাই বর্তমানে সকল সমস্যা সমাধানের একমাত্র উৎস। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, খালেদা জিয়া ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব হবে না। সরকার ও সরকারি দল মনে করে যে, নির্যাতিত নিপীড়িত বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের এ দেশে থাকা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে, যেমন মন্ত্রীরাই বিভিন্ন সভায় বলছেন যে, আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় না গেলে তাদের রোহিঙ্গা হয়ে যেতে হবে। এ ধরনের অনেক কথা সরকারি ঘরানার লোকেরা বলছেন। এসব কিছু মিলিয়ে সরকারের স্বস্থির নিঃশ্বাসের জন্যই কি খালেদা জিয়াকে জেলে নেয়া অত্যান্ত জরুরি? জাতির বিবেকের নিকট এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া যাবে কি?
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন