শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

গণতন্ত্রের সংকট এবং ভারসাম্যহীন রাজনীতি

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আমাদের দেশে গণতন্ত্র আছে কি নেই, থাকলেও কতটা আছে-তা সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা মুশকিল। কেন ও কোন কারণে এ ধারণার উদ্ভব হয়েছে, এ সম্পর্কেও পুরোপুরি ধারণা তাদের নেই বললেই চলে। কারণ গণতন্ত্রের মোড়কে শাসন ব্যবস্থা ও স্বৈরাচারী শাসন- এই উভয়ের মধ্যেই তাদের বসবাস করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। ফলে পরিপূর্ণ গণতন্ত্র কী, তার মর্মার্থ উপলব্ধির সুযোগ তাদের হয়নি। অথচ আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম মূল লক্ষ্যই ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। স্বাধীন হওয়ার পর সাধারণ মানুষ আশা করেছিল, গণতন্ত্রের স্বাদ তারা পাবে এবং সেই লক্ষ্য রাজনীতিবিদরা অবশ্যই পূরণ করবেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা রাজনীতিবিদদেরই কাজ এবং তারাই তা প্রতিষ্ঠা করবেন- এই অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস সাধারণ মানুষ তাদের উপর স্থাপন করেছে। দুঃখের বিষয়, তাদের এই সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে রাজনীতিবিদরা গণতন্ত্রের সার্বজনীন যে রূপ তা প্রতিষ্ঠা না করে, নিজেদের সুবিধা মতো একে ব্যবহার করেছেন এবং করছেন। স্বৈরাচার সরকারও দাবী করেছে, গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে সে শাসন কাজ চালিয়েছে। আবার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারও গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ রূপের পরিবর্তে নিজেরদের স্বার্থ এবং সুবিধা নিয়ে গঠিত একটি তন্ত্র উপস্থাপন করে দেখিয়েছে, এটাই গণতন্ত্র। ফলে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটি সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে রয়ে গেছে। সাধারণ অর্থে গণতন্ত্রের মূল সুর হচ্ছে, ‘রাইট টু পিপল’ বা জনগণের অধিকার। যেখানে জনগণের মতের উপর ভিত্তি করে শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। জনগণও বুঝতে পারবে সরকার তার ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য দেশ পরিচালনা করছে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নকামী দেশে, যেখানে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য থাকে, সেখানে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব ও অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শাসক শ্রেণী নিজেদের মতো করে গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে। এর কারণ হচ্ছে, সাধারণ মানুষ জীবনযাপনের টানাপড়েনে এতটাই ব্যস্ত ও পেরেশানিতে থাকে যে, গণতন্ত্র নিয়ে ভাবার সুযোগ খুব কমই পায়। দু’বেলা দু’মুঠো ভালোভাবে খেতে পারলেই তারা খুশি। এ সুযোগটাই শাসক শ্রেণী নিয়ে থাকে। মুখে মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে এবং নিজেদের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট গণতান্ত্রিক দাবী করে প্রকারন্তরে সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার প্রকাশ ঘটায়। গণতন্ত্রের নামে তাদের কর্তৃত্ববাদ কায়েম করে।
দুই.
৪৬ বছর একটি জাতির জন্য খুব কম নয়। যদি নিবিড় গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত থাকত, তবে এতদিনে বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হতো। দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার চার বছরের মাথায়ই গণতন্ত্র ব্যাহত হওয়ার নজির এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম এবং চারটি বাদে সকল সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ করার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। গণতন্ত্রের উপর প্রথম আঘাতটি তখনই এসেছিল। ঘটনা পরম্পরায় ’৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারি শাসন ব্যবস্থার অবসানের মধ্য দিয়ে বলা যায় গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবণতা এবং আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেও পালাক্রমে রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় গণতন্ত্র কিছুট হলেও হাঁটিহাঁটি পা পা করে এগুতে থাকে। এই চলার পথটি আবারও রুদ্ধ হয় ২০১৪ সালের দিকে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একগুঁয়েমি এবং যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকার মানসিকতার কারণে বিরোধীদলগুলোর ভোট বর্জনের মাধ্যমে একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন প্রধান বিরোধীদল বিএনপি ও তার জোট নির্বাচন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষমতাসীন দলের গণতান্ত্রিক মানসিকতায় পরিবর্তন লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠে। বিনা ভোটের নির্বাচনের দিনই এক সংবাদ সম্মেলনে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, যতটুকু নির্বাচন হয়েছে, ততটুকুই যথেষ্ট। এতেই আমরা খুশি। এই মানসিকতা থেকে সচেতন মহলের বুঝতে অসুবিধা হয় না, ক্ষমতাসীন দল লোক দেখানো একটি যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের মোড়কে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করতে যাচ্ছে এবং সামনে গণতন্ত্রের জন্য দুর্দিন অপেক্ষা করছে। গণতন্ত্র আছে, এ চিত্র দেখানোর জন্য তখন সরকার নিজের জোটের মধ্য থেকেই একটি দলকে সরকারের অংশীদার এবং বিরোধী দলে বসিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে একটি অদ্ভুত গণতন্ত্র দেখিয়ে দেয়, যা অদ্যাবধি চলছে। গণতন্ত্র নয়, উন্নয়নÑএমন শ্লোগান দেয়া হয়। গণতন্ত্রকে পেছনে ঠেলে উন্নয়নের জিকির তোলা হয়। নিজের কর্তৃত্ববাদ নির্বাধ করার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম সংকুচিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ এবং দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির ওপর স্টীম রোলার চালিয়ে দেয়া হয়। দলটিকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে এমনভাবে মাঠ থেকে বিতাড়ন করে যাতে সরকারের সামনে রাজনৈতিক কোনো প্রতিপক্ষ বা তার ভুল-ত্রæটি নিয়ে সমালোচনা করার কোনো গণতান্ত্রিক শক্তি না থাকে। সরকারের এই একচোখা নীতির কারণে সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রের সুফল থেকে যেমন বঞ্চিত হওয়া শুরু করে, তেমনি সুশাসন, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে। তাদের হয়ে কেউ যে কথা বলবে, এমন কোনো প্ল্যাটফর্ম বা মাধ্যম ক্ষীণ হয়ে পড়ে। সাধারণত কার্যকর বিরোধী দল না থাকলে, গণমাধ্যম সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। দেখা গেছে, প্রচ্ছন্ন নানা হুমকি-ধমকি এবং নিয়ন্ত্রণ ও নিবর্তনমূলক আইন করে এ মাধ্যমকেও কোনঠাসা করে ফেলা হয়েছে। গণমাধ্যম চলছে ঠিকই তবে তাতে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করার সুযোগ নেই বললেই চলে। গণমাধ্যম একটা ভীতিজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কাজ করে চলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে, এভাবেই চলতে হবে। ফলে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতিতে সরকারের ভুল-ত্রæটি বা জনবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত ধরিয়ে দেয়ার শক্তি প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। ক্ষমতাসীন জোট ক্ষমতায় থাকতে এতটাই ডেসপারেট বা মরিয়া যে, তার প্রতিপক্ষ এবং প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে, এমন দল ও মাধ্যমকে যে কোনো উপায়ে দমন করার সকল কৌশল অবলম্বন করে চলেছে। কোনো কিছু তোয়াক্কা করছে না। সরকার ভাল করেই জানে, তার বিরোধী শক্তি হিসেবে পরিগণিত বিরোধীদল ও গণমাধ্যমকে যদি স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে দেয়া হয়, তবে তারা জনসম্পৃক্ত হয়ে উঠবে। আর জনসম্পৃক্ত হলে তার ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে উঠবে। কাজেই সরকারের বিরোধী শক্তি হিসেবে গণ্য কোনো দল যাতে জনগণের কাছে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। সরকার ভাল করেই জানে, জনগণ তার প্রতি যতই অসন্তুষ্ট হোক না কেন, কখনো স্বেচ্ছায় তার বিরোধিতা করতে আসবে না। কলের পুতুলের মতো সরকারের কথা তাদেরকে শুনতে হবে এবং শুনে যেতে হবে। আবার গণতন্ত্র আছে, এমন একটি চিত্রও উপস্থাপন করতে হবে। এ ধারা অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চর্চা এবং রীতি-নীতি যে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, তা গত ৩১ জানুয়ারি লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। সংস্থাটি ১৬৫টি দেশে জরিপ পরিচালনা করে দেখায়, গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে। ২০১৬ সালে যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৪তম সেখানে ২০১৭ সালে ৮ ধাপ নিচে নেমে হয়েছে ৯২তম। আগের বছরের মতো এবারও সূচকে বাংলাদেশ ‘হাইব্রিড শাসনব্যবস্থার’ বিভাগে আছে। ‘হাইব্রিড’ বলতে এমন শাসন ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে প্রায়ই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। বিরোধী দল এবং বিরোধী প্রার্থীদের ওপর সরকারের চাপ নৈমিত্তিক ব্যাপার। দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার এবং দুর্বল আইনের শাসন। নাগরিক সমাজ দুর্বল। বিচারব্যবস্থা স্বাধীন নয় এবং সাংবাদিকদের হয়রানি ও চাপ দেয়া হয়। এ প্রতিবেদন থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ক্ষমতাসীন দল দেশের গণতন্ত্রকে কতটা নাজুক করে ফেলেছে এবং দিন দিন তা অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, সরকার যতই নিজেকে গণতান্ত্রিক ও গণতন্ত্রের কথা বলুক না কেন, গণতন্ত্র চর্চা ও প্রতিষ্ঠায় সে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি তার পূর্বের অবস্থানও ধরে রাখতে পারছে না। সরকার গণতান্ত্রিক শক্তি ও রীতিনীতি পরিহার করে নিজের ক্ষমতা ও জোরজবরদস্তির মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করে চলেছে এবং করতে চায়। স্বাধীনতার পর এই দলটিই যেভাবে গণতন্ত্রকে ছুঁড়ে ফেলে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিল, বর্তমানে এই একই দল গণতন্ত্রের পর্দা ঝুলিয়ে তার অন্তরালে একই ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তণ করে চলেছে।
তিন.
ক্ষমতাসীন দল ও তার জোট দেশে যে গণতান্ত্রিক ধারা বিকশিত করতে চায় না এবং যেমন করেই হোক লোক দেখানো নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় থাকতে চায়, তার প্রবণতা ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ গত ৩০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী নির্বাচনের প্রচারাভিযান শুরু করেছে। ঐ দিন সিলেটের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তিন মাজার জেয়ারত করে জনসভার মাধ্যমে নৌকায় ভোট চান এবং সমাবেশে আগতদের নৌকায় ভোট দেয়ার জন্য ওয়াদা করান। গত ১ ফেব্রæয়ারি সরকারের অংশীদার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও সিলেট থেকে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, গণতন্ত্রের প্রতি অনীহা প্রকাশে এই দুই দলের বৈশিষ্ট্যগত মিল রয়েছে। এরশাদ স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিত এবং গণতন্ত্রকে পদদলিত করে দেশ শাসন করেছিলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রচলন করেছিল। দুই দলের এই চরিত্রগত বৈশিষ্টের মিলের কারণে বিগত পাঁচ বছরে সংসদের কার্যক্রম নিয়ে একে অপরের ভূয়সী প্রশংসায় মেতে উঠে। একেই তারা গণতন্ত্রের উত্তম চর্চা বলে অভিহিত করেছে। যারা গণতন্ত্র সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখেন, তারা ভাল করেই জানেন, বিগত পাঁচ বছরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা সীমিত হয়ে কর্তৃত্ববাদের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা বর্তমান সংসদকে অকার্যকর হিসেবে অভিহিত করলেও তার তোয়াক্কা ক্ষমতাসীনরা করছে না। বরং এভাবে দেশ শাসন করার মধ্যেই আত্মতুষ্টি লাভ করছে। ক্ষমতাসীন দল ও তার জোট যে সীমিত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, তা তাদের ভোটের শতকরা হারের বিষয়টি বিবেচনায় নিলেই বোঝা যাবে। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সম্মিলিত ভোটের হার শতকরা ৪০ ভাগের বেশি নয়। এ হিসেবে বলা যায়, এই ৪০ ভাগ ভোটারের সমর্থন নিয়েই তাদের শাসন ব্যবস্থা চলছে। জনগণ বলতে সরকার এই অংশকেই মনে করছে। তার কাছে তাদের সমর্থনই যথেষ্ট এবং গণতন্ত্র এদের মধ্যে সীমিত থাকলেই চলবে। বাকী ৬০ ভাগ ভোটারের প্রয়োজন নেই। ক্ষমতাসীনদের ধারণা, ৬০ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব যেসব দল করে তাদের দমিয়ে রাখতে পারলেই ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে। এর মধ্যে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্বকারী বিএনপিকে দমাতে পারলে, ক্ষমতা পুরোপুরি নিষ্কন্টক এবং দীর্ঘস্থায়ী করা যাবে। কাজেই যে কোনো উপায়ে বিএনপিকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করা বা কোনঠাসা করে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে পারলে ক্ষমতায় থাকার পথটি মসৃন হয়ে যাবে। এ লক্ষ্য নিয়েই আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আগেভাগে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচনী প্রচারণার কাজে নেমে পড়েছে। তাদের মনোভাবে এটাই ফুটে উঠছে, যে কোনো উপায়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে হবে। এ নিয়ে কে কী বলল, তাতে কিছু যায় আসে না। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, শত নিপীড়ন-নির্যাতনের পরও যদি বিএনপি নির্বাচনে আসে, তবে তা তাদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। না এলে ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের মতো বিভিন্ন অভিযোগে পুনরায় দমন-পীড়ন করে নিঃশেষ করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালানো হতে পারে। অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচনে এলে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য ক্ষমতাসীন দল দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের চাপে পড়বে এবং তা করতে বাধ্য হবে। তাই সে মনেপ্রাণে চাচ্ছে, বিএনপি যেন নির্বাচনে না আসে। এজন্য বিএনপিকে ছন্নছাড়া করার জন্য দল ভাঙা থেকে শুরু করে হামলা-মামলা, গ্রেফতার-নির্যাতন এবং আদালতমুখী করে কোনঠাসা করার কৌশল নিয়েছে। এর বিপরীতে ক্ষমতাসীন জোট নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে ভোট নিশ্চিত করার জন্য ভোটারদের ওয়াদা করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ নীতি কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক হতে পারে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ওয়াদা করানোর বিষয়টি ভোটারদের স্বাধীন ইচ্ছার উপর আস্থাহীনতা ও বিশ্বাস না রাখার এক ধরনের প্রবণতা। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক প্রায়ই বলেন, বিএনপিকে মানুষ কেন ভোট দেবে এবং তারা কী এমন করেছে যে তাদের ভোট দেবে! তার এ কথার জবাবে বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই এমন যে, ভোটাররা নির্বাচনে বিরোধী দলের কর্মকাÐ খুব একটা আমলে নেয় না। তারা প্রাধান্য দেয় সরকারের কর্মকাÐকে। তাছাড়া ক্ষমতাবিরোধী এক ধরনের মনোভাব নির্বাচনের সময় জনগণের মধ্যে কাজ করে। যদি তা না হতো, তবে ২০০৬ সালে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের পরও জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করত না। তার আগের নির্বাচনগুলোতেও বিরোধী দলের কর্মকাÐ বিবেচনায় না নিয়ে জনগণ তাদের বিজয়ী করেছে। ওবায়দুল কাদের গত শুক্রবার বলেছেন, নির্বাচনে না যাওয়ার জন্য বিএনপি নানা ধরনের টালবাহানা করছে। যারা সচেতন তাদের মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগবে, বিএনপি কেন নির্বাচনে যাবে না? বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে কী করবে? দলটি তো নির্বাচনে যাওয়ার কথা সবসময়ই বলে আসছে এবং নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও নিরপেক্ষতার কথা বলছে। এটা তো সব দল এবং মহলের চাওয়া। নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যেসব বাধা রয়েছে, সরকার সেগুলো দূর করার পর যদি বিএনপি না যায়, তাহলে এ কথা বলা যেত। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকার অভিযোগে এবং বিএনপির অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না, এ আশঙ্কা থেকেই তো ২০০৬ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগ বর্জন করেছিল। একই কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনও বিএনপি বর্জন করেছিল এবং তা যে সুষ্ঠু হয়নি, এটা সবারই জানা।
চার.
গণতন্ত্রকামী দেশে যদি গণতন্ত্রের ভিত শক্ত না হয় এবং ধারাবাহিক চর্চা না থাকে, তবে সে দেশে সুষম উন্নয়ন ও অগ্রগতি হয় না। একবার গণতন্ত্র, একবার স্বৈরতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদ নিয়ে দেশ পরিচালনা করলে তা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। আবার একই সরকার যদি পরপর ক্ষমতায় থাকে এবং একবার গণতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে দেশ শাসন করার পর পরেরবার কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠে, তবে সে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া দুষ্কর। গণতন্ত্র সম্পর্কে জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। বুঝতে পারে না, তারা কোন তন্ত্রের মধ্যে আছে। গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদ- এই তিন ধারার মধ্য দিয়ে শাসন ব্যবস্থা চলমান থাকায় জনমানসে বিভ্রান্তি দৃঢ় ভিত্তি লাভ করাই স্বাভাবিক। জনগণকে এ বিভ্রান্তি থেকে বের করে আনার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। বিশেষ করে ক্ষমতায় যারা থাকে, তাদের দায়িত্ব বেশি। গণতন্ত্রের নামে কর্তৃত্ববাদ বা হাইব্রিড গণতন্ত্র কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন