গত ৮ তারিখ বহুল আলোচিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় হয়েছে। ৬ জন অভিযুক্তর মধ্যে বেগম খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের জেল ও অন্য ৫ জনকে ১০ বছরের জেল দেয়া হয়েছে। খালেদা জিয়া ছাড়া অন্য ৫ জন অভিযুক্তকে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে এ রায় দেওয়া হয়েছে। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এ রায় জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতি ও আসন্ন নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্য ভূয়া ও মিথ্যা মামলা তৈরি করে খালেদা জিয়াকে হেয় প্রতিপন্ন করতে এই সাজা দিয়েছে। এমন অন্যায় কাজের জন্য ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। এ রায় দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনিভূত হবে। তিনি আরও বলে, অবৈধ সরকার আদালতের মাধ্যমে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করল। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা যিনি নয়বছর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন। তিনি জনগণের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, দুবার বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছেন এবং বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেছেন। সেই জনপ্রিয় নেতাকে ভূয়া ও জাল নথি তৈরি করে মিথ্যা মামলা দিয়ে সাজা দিয়েছে, যা এদেশের জনগণ কোনদিনই গ্রহণ করবে না। আমরা অত্যন্ত ঘৃণার সাথে এ রায় প্রত্যাখ্যান করছি।
এ রায় দেশের রাজনৈতিক সংকটকে ঘনিভূত করতে পারে, বিএনপি মহাসচিবের এ কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এমনিতেই দেশের অবস্থা নাজুক, তার উপর বেগম জিয়ার সাজা দেশের জনগণ খুব ভালোভাবে নেবে না। সাজা দেওয়ায় জনগণের সমর্থন ও সহানুভূতি সম্পূর্ণরূপে বিএনপির দিকে যাবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমাদের মতে, মুক্ত বেগম জিয়ার থেকে ভূয়া মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বেগম জিয়া অনেক বেশি জনপ্রিয় ও শক্তিশালী যার প্রমাণ নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জনগণ দেখিয়ে দেবে। এটি স্পষ্ট, রাজনৈতিকভাবে মামলাটি পরিচালিত হয়েছে। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেছেন, রায়ে অন্যদের অপরাধের বিষয়ে উল্লেখ করা হলেও বেগম জিয়ার অপরাধের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। অন্যদের জরিমানা করা হলেও বেগম জিয়ার জরিমানা করা হয়নি।
বিএনপির নেতাকর্মী, দেশের মানুষ এবং বেগম জিয়া পূর্বেই আঁচ অনুমান করেন যে, যেনতেনভাবে হলেও বেগম জিয়াকে সাজা দেওয়া হবে। বেগম জিয়া জাতীয় নির্বাহী কমিটি, স্থায়ী কমিটি ও নেতাকর্মীদের নিকট তার সাজার আশঙ্কা সম্পর্কে পূর্বেই আভাস দেন। ৭ তারিখ গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্ভিককণ্ঠে বলেন, ‘আমাকে জেল বা সাজার ভয় দেখিয়ে লাভ নাই। আমি মাথা নত করব না। জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি থেকে পিছু হটব না। ন্যায়বিচার হলে আমি বেকসুর খালাস পাব’। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ‘আমাকে নির্বাচন ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে আদালতকে ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। তাতে একদলীয় শাসন ও ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার আশা পূরণ হবে না। আইয়ূব খানের এবডো টেকেনি, গণঅভ্যুত্থানে আইয়ূবের পতন হয়। ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীনের অবৈধ সরকার রাজনীতিকদের হেয় করে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেননি। তারা আমার ও আমার সন্তানদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছিল। আমাকে এক বছর নয়মাস কারারুদ্ধ করে রেখেছিল। আমার সন্তানদের কারারুদ্ধ করে মিথ্যা মামলা দিয়েছিল।’ সংবাদ সম্মেলনে তিনি দেশের সার্বিক অবক্ষয় ও ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা স্মরণ করে দিয়ে বলেন, ‘আপনাদের খালেদা জিয়া কোন অন্যায় করেনি। দুর্নীতি করিনি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের সাথে আমি কোনভাবেই জড়িত নই, এক টাকাও তছরুপ হয়নি। বরং সুদে আসলে সেই টাকা তিন গুণ হয়েছে। ন্যায় বিচার হলে আমার কিছুই হবে না।’ বেগম জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের সকল কথাই জনগণ সত্য বলে ধরে নিয়েছে। শত অত্যাচারেও যিনি দেশ ছাড়েননি সেই লৌহ মানবী দেশনেত্রী কোন অন্যায় করতে পারেন একথা কেউ বিশ্বাস করে না। যার অগাধ দেশপ্রেম, দেশের প্রতি মমত্ববোধ, মানুষের কল্যাণ কামনায় যিনি সর্বদা নিয়োজিত, মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা যার ধ্যান-জ্ঞান, দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি যিনি অঙ্গিকারাবদ্ধ এরূপ মানবিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ নেতা কখনও মানুষের সাথে প্রতারণা করতে পারেন না।
৯ বছরে যাদের সম্পদের বৃদ্ধি জ্যামিতিক হারে ঘটেছে তারা বেগম জিয়াকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণে ব্যস্ত। তাদের মনে রাখা উচিত এক মাঘে শীত যায় না। শীত ঘুরে ফিরে আসে। দুনিয়ার নিয়ম অলংঘনীয়। বেগম জিয়ার আবেগঘন কণ্ঠ নিঃসৃত বাক্যগুলো আমাদের ভাবায়, মনে করিয়ে দেয় মানুষের চলাচলন কথাবার্তা তার চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলে। একজন সৎ ব্যক্তি কখনও অন্যকে অসৎ ভাবে না, অন্যকে গালমন্দ বা কটাক্ষ করে না, বিদ্রæপ উপহাস করে না। বেগম জিয়া পা থেকে মাথা পর্যন্ত একজন সৎ মানুষ। সততা তার মূলধন, যার পুরস্কার দেশবাসী তাঁকে বার বার দিয়েছে। তিনবার প্রধামন্ত্রীর আসন অলংকৃত করেছেন। পাঁচ পাঁচটি আসনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে তিনি বার বার বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। একবারও কোন নির্বাচনে হারেননি। কর্মকান্ড দিয়ে ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করা হয়। আমাদের দেশে চরিত্রের ধারাবাহিকতা প্রায়ই লংঘিত হয়। সেকারণে দেখা যায়, একবার দুবারের বেশি বেশিরভাগ রাজনীতিক তার বিজয় টিকিয়ে রাখতে পারেন না। বেগম জিয়ার সততা, ভদ্রতা, ন¤্রতা ও দক্ষতা তাকে কালজয়ী নেতার আসনে বসিয়েছে। জীবনে কোনদিন মানুষের সাথে বৈঙ্গমানী, প্রতারণা বা বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি। তার প্রতি সেকারণে মানুষের অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপিত হয়েছে। কোন কিছুতেই সে বিশ্বাসে চির ধরানো যাবে না। তিনি যতদিন বাঁচবেন, দেশের মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অটুট থাকবে। শতবার জেল দিয়েও তাকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। তার প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার স্থান হলো মানুষের অন্তর। একদিন তিনি বিজয়ীর বেশে অবির্ভূত হবেন। মহামতি সক্রেটিসের প্রহসনের বিচারের কথা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল। নিজস্ব ঈশ্বর সৃষ্টি, দেবদেবীর অপমান ও যুবকদের নষ্ট করা, এ তিনটি অভিযোগে তার বিচার করা হয়। গ্রিসে সে সময় প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চালু ছিল। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক শাসন ও বিচার কাজে অংশগ্রহণ করতে পারত। সক্রেটিসের বিচারকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০। বিচারকরা বিভক্ত হয়ে রায় দেন। অর্থাৎ অল্প সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সক্রেটিস দোষী সাব্যস্ত হন। তারা সক্রেটিসকে দোষ স্বীকার করে কিছু জরিমানা দিতে বলেন। উত্তরে সক্রেটিস বলেন, আমি কোন দোষ করিনি। অতএব, দোষ স্বীকারের প্রশ্নই আসে না। জরিমানা হিসেবে আমি এক পেনি দিতে পারি। এরূপ হাস্যকর প্রস্তাবে বিচারকেরা ক্ষুব্ধ হন এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। উল্লেখ্য, সক্রেটিসের অনেক ধনাঢ্য ছাত্র ছিল। তিনি চাইলেই টাকা যোগাড় কোন অসম্ভব বিষয় ছিল না। অনায়াসে তিনি টাকা দিয়ে সাজা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারতেন। কিন্তু তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। তাঁর জন্মই হয়েছিল সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য। সে কারণে শাসকদের রক্তচক্ষু তাঁকে টলাতে পারেনি। ইচ্ছা করলে তিনি পলিয়ে জীবন রক্ষা করতে পারতেন। জেল রক্ষককে কিছু পয়সা দিয়ে নির্বিঘেœ পালাতে পারতেন। গ্রিসে অনেক দার্শনিক জেল থেকে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছেন এমন নজির চোখের সামনে থাকতেও সক্রেটিস সে পথ অবলম্বন করেননি। সক্রেটিসের বিচারকে জুডিশিয়াল মার্ডার বলা হয়। সক্রেটিস মাথা নত না করে বিচারের রায়ে দেয় দÐ মাথা পেতে নেন। হেমলক বিষ পানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সক্রেটিস মরেও অমর হয়ে রয়েছেন। যারা তাঁর বিচারের প্রহসন করেন, তারা কেউ বেঁচে নেই। সক্রেটিস বিশ্বের প্রতিটি বিবেকমান মানুষের অন্তরে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। আজও বিশ্বের অগুনতি মানুষ সক্রেটিসের প্রহসনের বিচারকে ঠাÐা মাথায় হত্যা মনে করে। বেগম জিয়া দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, তিনি কোন দুর্নীতি বা অন্যায়ের সাথে জড়িত নন। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেবে তিনি প্রকৃত অপরাধ করেছেন কিনা। তাঁর প্রতি যেমন মানুষের অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা, মানুষের প্রতিও তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। জেল জরিমানা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। লক্ষ লক্ষ নেতা কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী তাঁর আহŸানে সাড়া দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। তাঁর সাজাতে বিএনপি কোন হটকারী ও সম্পদ বিধ্বংসী কর্মসূচী না দিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানব বন্ধন প্রভৃতি কর্মসূচীতে সীমাবদ্ধ রেখেছে। এটি খুবই ভালো লক্ষণ। এতে জনগণের সমর্থন ও সহানুভূতি পুরামাত্রায় বিএনপির পক্ষে যাবে। কর্তৃত্ববাদী সরকার বিএনপির কোন কর্মসূচিই সহ্য করতে পারছে না। ৮ তারিখের আগে থেকেই যে ব্যাপক ধরপাকর শুরু হয়েছে তার যেন শেষ নেই। প্রতিদিন নেতাকর্মী গ্রেফতার জনমনে আতংক ও ভীতি সঞ্চার করছে। শত উসকানির মধ্যেও বিএনপি নেত্রীর নির্দেশ পালিত হচ্ছে। বিএনপি এখন পর্যন্ত অহিংস, শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক ও সহনশীল রাজনীতি করছে। বিক্ষোভের মধ্যে কর্মসূচী সীমাবদ্ধ রেখে বিএনপির নেতাকর্মীরা আইনের আশ্রয় নিতে চায়। কিছুদনি থেকে বিএনপির প্রতি সরকার একটু নমনীয় ছিল। মানুষ আশা করেছিল হয়ত সমঝোতা হবে। বেগম জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে সরকার আবার মারমুখি হয়ে উঠেছে। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল। বেগম জিয়ার সাজা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। আমাদের নকআউট মার্চ থেকে সরে আসতে হবে। তা না হলে পরিণতি শুভ হবে না, অতীতে হয়নি, নতুন মাত্রা যোগ হওয়ায় আরও অশুভ হবে। সকলকে এক টেবিলে বসে সুষ্ঠু সমাধান বের করতে হবে।’ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন খান বলেছেন, বেগম জিয়ার সাজা ও নেতাকর্মীদের গ্রেফতারে সংকট ঘনিভূত হয়েছে। ইস্যুটি অনেকটা রাজনৈতিক, রাজনৈতিক সমাধান কাম্য।
বিষয়টি যে রাজনৈতিক এ বিষয়ে কারও কোন সন্দেহ নেই। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও নাইকো- এ তিনটি ১/১১ এর অবৈধ সরকারের সময় করা। অনুরূপ কিছু মামলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও করা হয়েছিল। মামলাগুলো নিঃসন্দেহে অশুভ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। দু’নেত্রীকে মাইনাস বা বিরাজনীতি করণের অশুভ উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, যা বেগম জিয়ার দৃঢ়তায় সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সকলের প্রত্যাশা ছিল, এসব অশুভ উদ্দেশ্যে করা জরুরি সরকারের দেওয়া মামলা কোয়াশ করা হবে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের মামলাগুলো তুলে নেয়া হলেও বিএনপি নেত্রী ও অসংখ্য নেতানেত্রীর মামলা চালু আছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে আরও নতুন নতুন অসংখ্য মামলা। বেগম জিয়া আপোসহীনভাবে গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক মিথ্যা মামলায় সাজা ভোগ করতে হচ্ছে। তিনি যদি প্রথম থেকে আপোসকামী হতেন সেক্ষেত্রে আরামদায়ক ঝামেলামুক্ত রাজনৈতিক জীবন পেতেন। কিন্তু কোন আপোসকামী হয়ে ঝামেলামুক্ত জীবন চাননি। তাঁর স্বামীর মতো মানুষকে শৃঙ্খলমুক্ত করে স্বাধীন ও সার্বভৌম করার ব্রত নিয়ে বেগম জিয়া রাজনীতিতে আসেন। এরশাদের সাথে হাত মিলালে, সমঝোতা করলে তাঁকে নয় বছর রাজপথে থাকতে হতো না। অনেকের মতো তিনি আপোসের পথে যাননি, সংগ্রামী জীবন বেছে নিয়েছেন। অবশ্য এদেশের জনগণ তার পুরস্কার স্বরূপ তাকে তিনবার প্রধানমন্ত্রিত্ব দান করে। কোন ছলাকলা, চাতুর্য-কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়নি। জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে তাঁকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ১/১১ এর জরুরি সরকার সমঝোতার প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। বিদেশে গিয়ে আরাম আয়াশে পরিবার পরিজন নিয়ে শান্তিপূর্ণ ঝামেলামুক্ত দিনতিপাত করতে পারতেন। কিন্তু ইস্পাতকঠিন মনোবলের অধিকারী এই নেত্রী জনগণকে বিপদে ফেলে বিদেশে পালিয়ে থাকেননি। এতে নিজে ও ছেলেদের অনেক দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হলেও জনগণের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে তিনি ছিলেন আপোসহীন। বর্তমান সরকারের অগণতান্ত্রিক দমন, পীড়ন, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন সহ্য করেও তিনি গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপোসহীন। মানুষের মৌলিক অধিকার ভোট না থাকায় তিনি সংগ্রামরত। শাসকদের অত্যাচার নির্যাতন হজম করেও তিনি আপোসহীন। আপোস করে চললে বেগম জিয়াকে মামলা, হামলা মোকাবেলা করতে হতো না। শাসকদের সমালোচনা ও নেতাদের অজ্ঞতা প্রকাশ করায় সক্রেটিসকে সাজা পেতে হয়েছিল। তিনি একটু নতি স্বীকার করে শাসকদের মন জুগিয়ে চললে তাকে শাস্তির বদলে পুরস্কৃত করা হতো। আমার মতে, সক্রেটিস ভুল করেননি। আপোস করে চললে তিনি হয়ত আর কয়েকবছর বেশি বাঁচতেন। সত্য ও ন্যায়ের জন্য জীবন দিতে হলেও সক্রেটিস আজও কোটি মানুষের অন্তরে জীবন্ত রয়েছেন।
অশুভ ও হীন উদ্দেশ্যে তাঁকে সাজানো মামলায় সাজা দেওয়ায় আমরা দুঃখিত ও ব্যথিত। সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। প্রতিদিন সমাবেশ ও প্রতিবাদমিছিল হচ্ছে। বিএনপির কর্মসূচি মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করছে। সমাবেশ, মিছিল ও মানববন্ধন থেকে সরকারকে নিন্দা ও ধিক্কার জানিয়ে তাঁর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হচ্ছে। আমরাও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ২০ দলীয় ঐক্যজোটের উদ্যোগে শিক্ষক, কর্মচারী ও কর্মকর্তারা, মানব বন্ধন ও অনশন করে বেগম জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মৌন মিছিল, মানব বন্ধন ও সমাবেশ করেছি। তবে বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে যেসব কর্মসূচি পালিত হচ্ছে তা অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছে। এত বেশি শিক্ষক কর্মচারীর উপস্থিতি কোন সময় দেখা যায় না। তাছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন থেকেও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে ডিভিশন না দিয়ে তিন দিন পরিত্যাক্ত দালানে নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাখা কতটা অমানবিক ও নিষ্ঠুর কর্ম, চিন্তা করলেই বোঝা যায়। সরকার তাকে সাজা দিয়ে নতি স্বীকারে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তবে ইস্পাত কঠিন মনোবল ও দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী এই নেতা কোনকিছুতেই দমবার পাত্র নন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতি না টেনে এ লড়াইকে এগিয়ে নিলে বেগম জিয়া কামিয়াব হবেনই। এদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে স্থায়ী আসন লাভ করবেন। ‘আমি যেখানেই থাকি না কেন, দেশ ও জনগণের পাশে থাকব। তাদের জন্যই আমার রাজনীতি। আল্লাহ নিশ্চয় আমাদের জন্য সুখবর রেখেছেন। আপনারা কেউ হটকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না। শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করবেন। আপনারা গণতন্ত্রের জন্য, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাবেন’ তার এই আহŸান কেবল, বিএনপির প্রতি ছিল না, ২০ দল সহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক দল, কৃষক শ্রমিকসহ সর্বশ্রেণিপেশার মানুষের প্রতি তার আহŸানে সাড়া দিচ্ছে মানুষ। প্রতিদিনই তাদের সংখ্যা বাড়ছে।
লেখক: প্রফেসর, দর্শন বিভাগ ও সাবেক ডীন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন