প্রশ্ন: মালিক-শ্রমিক কি একে অন্যের সহযোগী?
উত্তর: বর্তমানে শ্রমিক মালিকের পারস্পরিক সম্পর্কে এক বিরাট জটিল সমস্যা বিদ্যমান। মালিক শ্রমিকের মাঝে এক রুক্ষ ও কৃত্রিম সম্পর্ক বিরাজমান। সকলেই নিজ স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত। যার ফলে মালিক শ্রমিক আজ দুটি মারমুখি প্রতিদ্বন্ধি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের পরস্পরে কোন সোহর্দপূর্ণ ও গঠনমূলক সম্পর্ক কায়েম হয়ে উঠতে পারছে না। বরং উভয়ের মাঝে এক চিরন্তন দর কষাকষি বিদ্যমান। মালিক সমিতি শ্রমিকদের সমান্য শ্রমের মজুরির বিনিময়ে তারা শ্রমিকের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু সব কিছুরই যেন তারা হর্তাকর্তা হয়ে যায়। তাদেরকে গোলাম এমনকি পশুর চেয়েও হীন এক জীব বলে মনে করতে থাকে। দরিদ্র ও সর্বহারা এই শ্রমিক শ্রেণির অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের উপর এক ঘৃণ্য রাজত্ব চালাতে শুরু করে দেয়।
তারা এটাকে শুধু বৈধ মনে করে না বরং নিজেদের আরাম প্রিয়তার এক শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম বলে মনে করে। মজুরের রক্তের উপর নিজেদের আয়াশ ও তানায়ামের ভিত গড়ে তোলা, নিজেদের শোষণকে আরো মজবুত করার লক্ষ্যে প্রশাসন ব্যবস্থার আশ্রয় নেয়। আর তারা নির্বিচারে হামলা চালায় নিপীড়িত শ্রমিক শ্রেণীর উপর। তাদের এই অহেতুক বিলাশপ্রিয়তাই আজ মানুষের জীবনকে করে তোলেছে দুর্বিসহ।
পক্ষান্তরে ইসলাম হল একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাতে রয়েছে মানবজীবনের সকল সমস্যার সমাধান। যা মানুষকে নিরাপত্তা ও শান্তির রাস্তা দেখিয়েছে। শোষণের সব রকম মাধ্যমকেও মূল উৎপাটন করে ইনসাফ কায়েম করেছে। ইসলাম জুলুম ও শোষণের ঘৃণ্যতা এবং তার বিভৎসতা সম্মন্ধে প্রত্যেকটি মানুষের মনে এক অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। যাতে সে মন থেকে একে ঘৃণা করতে পারে, ফিরে থাকতে পারে। ইসলাম মানুষের মানবৃত্তিকেই আমূল পরিবর্তন করে দেয়। যে মানুষকে প্রথম থেকেই এমনি করে গড়ে তোলে। যাতে তার মধ্যে পাশবিক ও শোষণমূলক বদভাব-ধারার জন্ম না হয়। এর বিকাশ তার মধ্যে না ঘটে। মানুষ যেন সহানুভূতিশীল মানবতাবাদী এবং শোষণমুক্ত মনের অধিকারী হয়ে উঠতে পারে এব্যবস্থা ইসলাম করে।
ইসলাম কেবল মালিকদের শ্রমিকের উপর সাধ্যাতিত কাজের চাপ দিয়ে স্বার্থ উদ্ধারের কথা বলতে আসেনি। শুধু শ্রমিকদেরকে মালিকদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষার জিকির তুলে তাদেরকে দায়িত্বহীন করে তুলতে আসেনি। বরং ইসলামের অন্যতম লক্ষ হলো, সামঞ্জস্যপূর্ণ পৃথিবী গঠন করা। যেখানে সকলেই আপন আপন ন্যায়ানুগ অধিকার সংরক্ষিত রেখে নিরাপদে তা ভোগ করতে পারে। ইসলাম তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতির ভিত্তিতে এক সৌভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক কায়েম করে। ইসলাম উভয়কে এমন কতকগুলি বিধি-নিষেধ দ্বারা আবদ্ধ করে দিয়েছে যাতে তাদের ওই ব্যবস্থাগত সম্পর্ক কঠিন না হয়ে ভ্রাতৃত্বমূলক প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইসলাম মালিককে সহনশীল হতে শিক্ষা দেয় । ক্ষমাসুন্দর মনোভাব নিয়ে শ্রমিকের দোষ-ত্রæটি মাফ করার প্রতি উৎসাহিত করে। শ্রমিকদের সমস্যা নিরসনে এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করণে অত্যন্ত সজাগ, বাস্তব ও ন্যায়ানুগ দৃষ্টিভঙ্গি রাখে। এব্যাপারে ইসলাম অত্যান্ত কঠোর নির্দেশ দিয়েছে।
নবী করীম সা. এদের সম্পর্কে বলেছেন “এরা তোমাদের ভাই। তোমাদের খেদমত করছে। আল্লাহ এদেরকে তোমাদের অধিনস্ত করে দিয়েছেন। তাই যার যে ভাই তার অধীনে রয়েছে তাকে যা সে নিজে খায় তা থেকে তাকে খেতে দিবে। যা সে নিজে পরে তাই তাকে পরাবে। আর যে কাজ তার জন্য অতি কষ্টকর সে কাজের বোঝা তার উপর চাপিয়ে দিও না। অগত্যা যদি সে রকমের কাজ করাতেই হয় তবে নিজে তাকে সাহায্য কর। (বুখারী)
‘যারা তোমাদের কাজ করে তারা তোমাদের ভাই’ অর্থাৎ- এদের সাথে তোমাদের সম্পর্ক প্রভুত্যের নয়। বরং মালিক-শ্রমিক তোমরা ভাই ভাই। একজন ভাই তার সহদর ভাই থেকে যা আশা করতে পারে, পেতে পারে তারাও তোমাদের কাছে তাই আশা করতে পারে। ভাই তার ভাইকে কষ্টে থাকতে দেখলে বসে থাকতে পারে না। তাই তাদের জন্য কষ্টকর এমন কাজের বোঝাা চাপিয়ে দিও না।
নবী করীম সা. একবার অত্যন্ত তাগিদ দিয়ে বলেছেন “তোমরা তোমাদের আপনজন ও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করে থাক তাদের সঙ্গেও অনুরূপ ব্যবহার করবে। আর মানুষ হিসেবে তারা তোমদের চেয়ে কোনক্রমেই কম নয়। তোমাদের যেমন অন্তর আছে তাদেরও তেমনি অন্তর আছে। তোমরা কি দেখ না! আমি যায়েদ কে আযাদ করে আমার ফুফাতো বোনের সাথে বিয়ে দিয়েছি এবং বিলালকে মুয়াজ্জিন মনোনিত করেছি। কেননা সে আমাদের ভাই। তোমরা আরো দেখ, আনাস আমারর কাছে থাকে আমি তাকে নিকৃষ্ট মনে করি না। সে কখনো কাজ না করলে আমি তাকে বলি না যে, তুমি তা করনি? আর যদি সে ভুলক্রমে ক্ষতি করে বসে তবুও তার প্রতি আমি রাগ করি না। (বুখারী)
হুজুর সা. এর উক্ত কার্যক্রম এবং নির্দেশনাবলী সাহাবায়ে কিরাম তথা মুমিনদের জীবনে অত্যন্ত আশ্চার্য রকমের প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। এবং শ্রমিক-মালিকের মাঝে হৃদ্যতার সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল।
মোটকথা, ইসলাম মালিককে সহনশীল হৃদয়বান এবং সহানুভূতি সম্পন্ন হতে শিক্ষা দেয়। মালিক নিজের মনের মধ্যে মজুৃরের কোন প্রকার শোষণের অভিপ্রায়ও রাখতে পারে না। সাধ্যাতিত কোন কাজ তাকে নির্দয়ভাবে নিযুক্ত করে দিতে পারে না। বরং সে মজুরের কষ্টকে নিজের কষ্ট বলে মনে করবে। তার কল্যাণ সাধনে সচেষ্ট হবে। তার আনন্দের সঙ্গী হবে। সর্বোপুরি একজন মজুরকে নিজের সহোদরের মর্যাদা দিবে।
অন্যদিকে ইসলাম শ্রমিককেও নির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ মেনে চলতে বলে। ইসলাম একজন শ্রমিককে এই নির্দেশ দেয় যে, মালিকের যে কাজেরর দায়িত্ব সে নজের পছন্দানুযায়ী গ্রহণ করে নিয়েছে তা এখন নিজের কাজ বলে মনে করবে। পূর্ণ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ও মনযোগ সহকারে একাজ আঞ্জাম দিবে। নচেত সে পরকালীন সফলতা লাভ করতে পারবে না।
সৎকর্মশীল শ্রমিক যে আল্লাহ এবং মালিকের হক আদায় করতে থাকে সে ইসলামের দৃষ্টিতে দ্বিগুণ সাওয়াবের অধিকারী। হুজুর সা. বলেন তিন প্রকার লোকদের দ্বিগুণ সাওয়াব দেয়া হবে। তাদের একজন সে-ই যে নিজের মালিকের হক আদায় করে। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর হকও আদায় করে। (মিশকাত)
উত্তর দিচ্ছেন: ইমামুদ্দীন সুলতান
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন