‘বাঘ’ থেকে হঠাৎ করেই ‘সর্পে’ পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ভুজঙ্গের সেই বিষাক্ত দংশনে নীল হয়ে নিদাহাস ট্রফি ত্রিদেশীয় টি-২০ সিরিজ থেকে বিদায় নিয়েছে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা। তাদের দর্শক বানিয়ে ফাইনালে উঠেছে সফরকারী দুই দল বাংলাদেশ ও ভারত। টুর্নামেন্টে দু’বার বাগে পেয়েও ভারতকে দংশিতে পারেনি বাংলাদেশ। আবার এসেছে সেই সুযোগ। মঞ্চটাও বড়। ফাইনাল। এবার পারবেন তো মুশফিক-মাহমুদউল্লাহরা? পারলে বড় একটি স্বপ্ন পূরণ হবে বাংলাদেশেরÑ ত্রিদেশীয় কোন সিরিজে প্রথম শিরোপা জয়। কিন্তু আশার মাঝেও শঙ্কার বিষয় হলো, ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম সংস্করণে ভারতকে কখনোই হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। তার মানে এই নয় যে আগে পারেনি বলে আর পারা যাবে না। চলতি টুর্নামেন্টই এক্ষেত্রে হতে পারে প্রেরণার রসদ। সেই রসদ নিয়েই আজ কলম্বোর আর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মাঠে নামবে সাকিব বাহিনী।
টি-টোয়েন্টি আর প্রতিপক্ষ ভারত, এই দুটি শব্দ একত্রিত করলেই একটি হতাশার চিত্র ফুটে ওঠে টাইগার ক্রিকেট প্রেমিকদের মনপটেÑ ব্যাঙ্গলুরুর সেই ২০১৬ টি-২০ বিশ্বকাপের ম্যাচ। যে ম্যাচে জয়ের জন্য ৩ বলে প্রয়োজনীয় ২ রান নিতে ব্যর্থ হন মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ। চাপ সামলাতে না পেরে দুজনই আউট হন বাজে শট খেলে। বাংলাদেশ হেরে যায় ১ রানে। তৎকালীন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে তখন শিষ্যদের বুঝিয়েছিলেন, ব্যথা ভুলে ঐ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিতে। দলপতি সাকিবও ঐ ম্যাচের স্মৃতি হাতড়ে সম্প্রতি বলেন, ‘সবাই ভুল থেকেই শেখে। বেঙ্গালুরু আমাদের কাছে শিক্ষা ছিল কিভাবে জিততে হয়। আমি মনে করি এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখন আমরা সচেতন।’
প্রায় দুই বছরের ব্যবধানে এই মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক এখন অনেক পরিণত। কঠিন পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখার দিক্ষায় দিক্ষিত অভিজ্ঞ খেলোয়াড় যাকে বলে। আসরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ দুটিতে তাকালেই তা বোঝা যায়। বোঝা যায় সেদিনের শিক্ষাটা কাজে দিয়েছে মুশফিক-মাহমুদউল্লাহকে। তৃতীয় ম্যাচে ২১৪ রানের রেকর্ড তাড়া করার দিনে শেষ ওভারের নায়ক মুশফিক। আর মাহমুদউল্লাহর বীরত্বে সদ্য জয়স্মৃতি তো আরো টাটকা। উত্তেজনার বারুদে ঠাসা ম্যাচে শেষ চার বলে ১২ রানের দুরহ সমীকরণ কি ধীর শান্ত অথচ অবিচল ভঙ্গিমায়-ই না মিলিয়ে নেন মাহমুদউল্লাহ।
অথচ বিধ্বস্ত এক দল নিয়ে নিদাহাস ট্রফি খেলতে শ্রীলঙ্কার মাটিতে পা রেখেছিল বাংলাদেশ। যাদের চোখে মুখে ছিল ঘরের মাটিতে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে এই শ্রীলঙ্কার কাছেই হারের হতাশা। এরপর লঙ্কানদের বিপক্ষে টেস্ট ও টি-২০ সিরিজেও বরণ করতে হয় একই পরিণতি। এরই মাঝে দলের প্রাণভোমরা সাকিব আল হাসানকে হারিয়ে যেন আরো দিকভ্রন্ত হয়ে পড়ে বাংলাদেশ।
যে কারণে সিরিজের শুরুটাও হয় একেবারেই নড়বড়েভাবে। ভারতের কাছে একপ্রকার আত্মসমর্পণ করতে হয় মাহমুদউল্লার দলকে। কিন্তু পরাজয়ের ভারে ক্লান্ত দরটির ঘাড়ে হঠাৎ করেই যেন অশরীরী ভর করে। যে দলটি কখনো দুইশ রানই করতে পারেনি তারাই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘুরে দাঁড়ায় ২১৫ রানের রেকর্ড লক্ষ্য তাড়া করে। সেই ম্যাচের আত্মবিশ্বাস কাজে লাগিয়ে পরের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে জয়ের খুব কাছে গিয়েও হার। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই সাম্প্রতিক ক্রিকেটের সবচেয়ে উত্তেজনাকর ও নাটকীয় জয়। এই বাংলাদেশকে তাই কোনভাবেই সিরিজ শুরুর আগের বাংলাদেশের সঙ্গে মেলানো যাবে না।
সাকিব-তামিমদের উদ্বুদ্ধ করতে পারে বিসিবি প্রধানের ঘোষণাও। ফাইনাল নিশ্চিত করায় দলকে কোটি টাকার বোনাসের ঘোষনা দিয়েছেন। ফাইনাল জিতেতে পারলে সেটা আরো বাড়বে বলে জানান নাজমুল হাসান পাপন, ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলের সঙ্গে লড়াই করে দেশের বাইরে ফাইনালে উঠে আসা আমাদের জন্য বিরাট ব্যাপার। কালকের (পরশু) ম্যাচের পর খেলোয়াড়দের জন্য একটা বোনাস ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এটাও বলা হয়েছে, সিরিজ এখনো শেষ হয়নি। আসল খেলাটাই আগামীকাল (আজ)। ওখানে যদি ভালোভাবে খেলতে পারে, তাহলে বোনাস আরও বাড়বে। আপাতত খেলোয়াড়দের জন্য এক কোটি টাকা ঘোষণা করা হয়েছে।’
এ তো গেল খেলোয়াড়দের কথা। কিন্তু শক্তিশালী ভারতের কথা বিবেচনায় এনে একাদশে কি কোন পরিবর্তনের কথা ভাবছেন টিম ম্যানেজমেন্ট? এক্ষত্রে প্রথমেই চলে আসবে সৌম্য-সাব্বিরের প্রসঙ্গ। সাব্বির দুই ম্যাচে মুটামুটি রান পেলেও প্রতি ম্যাচেই তার আউট হওয়ার ধরণ ছিল চোখে বিধার মত। সৌম্যের ব্যাপারটা ছিল আরো দৃষ্টিকটু। আর লিটনের ব্যাপারটা মেলানো যায় বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রচলিত একটি প্রবাদ থেকে- ‘এক ম্যাচ ভালো খেলেছ মানে তুমি আরো দশ ম্যাচ একাদশে নিশ্চিত’। লিটন এর বাস্তব ও সদ্য উদাহরণ। প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৯ বলে ৪৩ রানের টিকিটই তাকে সিরিজের পরবর্তি ম্যাচেগুলোর নিশ্চয়তা দিয়ে রেখেছে। অথচ বাকি ম্যাচগুলোর দিকে তাকালে তাড়াহুড়ো আর কান্ডজ্ঞানহীন শট খেলে আউট হওয়াটার বিষয়টি নিশ্চয় সবার চোখে পড়তে বাধ্য। এই প্রবাদ অবশ্য একজনের বেলায় খাটে না। সেই দুর্ভাগার নাম হলো ইমরুল। বিশেষ করে সৌম্যের ধারাবাহীক ব্যর্থতার পরও যদি ইমরুল দলে সুযোগ না-ই পান তাহলে তাকে খরচ করে দলের সঙ্গে রাখা কেন। সোহানের বেলায়ও একই প্রশ্ন প্রযোজ্য।
ভারতের হিসাবটা আলাদা। টি-২০ এমনিতেই তারা শক্তিশালী দল। যদিও সফরে দ্বিতীয় সারির ভারতকেই পাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে গেলেও বাকি তিন ম্যাচেই আধিপত্য দেখিয়ে নিজেদের জানান দিয়ে ফাইনালে ওঠে তারা। নিশ্চিত ভাবে আজকের ম্যাচে তারাই ফেভারিট। ভারতের দিনেশ কার্তিক অবশ্য প্রতিপক্ষ বাংলাদেশকে ‘বিপজ্জনক’ দল হিসেবে আখ্যা দেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে যে কোন ম্যাচই কঠিন বলে মনে করেন এই উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন