অস্তিত্ব সংকটে জেলার নদ-নদী ও খাল বিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একের পর এক অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ, স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ, ভারতের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রকল্প এবং অবৈধ নদী দখলের কারণে নদী বেষ্টিত সাতক্ষীরা জেলা ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। ফলে বাড়ছে জলাবদ্ধতা, কমছে ফসল উৎপাদন। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ২৭টি নদী রয়েছে। যার বেশির ভাগ নদী এখন স্মৃতি হতে চলেছে। এদিকে, কপোতাক্ষ ও বেতনা খনন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে জেলার সবকটি নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। এসব নদী কেন্দ্রিক খালগুলোর তলদেশ ফেঁটে চৌচির হয়ে গেছে। সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগে ২১৬টি ¯øুইস গেট রয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর অধীনে ১২৩টি ¯øইস গেট রয়েছে। যার ৮০টি কার্যক্ষম আছে। বাকি ৩৪টি সম্পূর্ণ অকেজো। এছাড়া সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর অধীনে ৯৩টি ¯øুইস গেটের মধ্যে ২৮টি সম্পূর্ণ অকেজো। ৫০টির তলদেশ পলি জমে উঁচু হয়ে যাওয়ায় এগুলো পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এসব ¯øুইস গেট সমূহ স্বাধীনতার আগে নির্মিত। পাউবো-১ এর একটি তথ্যে দেখা যায়, ১২৩টি ¯øুইস গেটেরে মধ্যে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সালে নির্মিত ৩৫টি, ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সালে নির্মিত ৫টি, ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সালে নির্মিত ৩০টি, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৬ সালে নির্মিত ৪৮টি এবং ১৯৮৯ থেকে ৯৩ সালে নির্মিত ৫টি। যার বেশির ভাগ ¯øুইস গেটের মেয়াদই শেষ। ফলে চলতি বর্ষা মৌসুমে এ জেলাসহ দক্ষিঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলাবদ্ধার আশঙ্কা করছে ভুক্তভোগীরা।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর অধীনে ১, ৩, ৫ ও ১৫নং পোল্ডারের আওয়তায় সাতক্ষীরা সদর, আশাশুনি, দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগরের অংশে হাবড়া ও মরিচ্চাপ নামে দুটি নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে। ১০টি নদী কোন রকমে বেঁচে আছে। যার মধ্যে সীমান্ত নদী ইছামতি, কাকশিয়ালি, কালিন্দী, মাদারগাং নদী। সুন্দরবন সংলগ্ন চুনা নদী, মালঞ্চ নদী, আড়পাঙ্গাশিয়া, কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া, গোয়ালখেশিয়া নদীর প্রবাহ আছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানান। ২০১১ সালে একনেকের বৈঠকে কপোতাক্ষ নদ খননের জন্য ৪ বছর মেয়াদী প্রায় ২৬২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সেই প্রকল্পের বেশির ভাগ টাকায় লুটপাট হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। স্কেবেটর মেশিন দিয়ে দিয়ে চেঁচে-ছিলে দায়সারা গোচের খনন করা হয়েছে। কপোতাক্ষ নদ খননের নকশা অনুযায়ী তলদেশের প্রস্থ হওয়ার কথা ছিল স্থান বিশেষ ১০৩ ফুট থেকে ১৩০ ফুট। মাথায় প্রস্থ হওয়ার কথা ছিল স্থান বিশেষ ১৪৮ ফুট থেকে ২০৩ ফুট এবং গভীরতা হবে স্থান বিশেষ ১০ ফুট থেকে ১৪ ফুট। কিন্তু খনন করা হয়েছে, তলদেশ প্রস্থ মাত্র ৩৩ ফুট, মাথায় প্রস্থ’ মাত্র ৪৯ ফুট ও গভীরতা সাড়ে ৬ ফুট বলে অনেকে অভিযোগ করে। খননকৃত মাটি ১৭০ ফুট দূরে ফেলার কথা থাকলেও মাটি ফেলে হয়েছে নদীর মাঝখানে। বর্ষা আসলেই এসব মাটি ধসে আবারও নদ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে নদীটিতে জেয়ার ভাটা না থাকলে সীমিত পরিমানে পানির প্রবাহ আছে। বর্তমান সরকারের সময়ে ২৬২ কোটি টাকার প্রকল্পের প্রভাবে নদীটি কিছুটা প্রাণ ফিরে পেয়েছে বলে স্থানীরা জানান। গত দু’বছরে তালা কলারোয়াতে জলাবদ্ধতা ছিল অনেক কম। নদীর যৌবন ফিরে পেতে দলটির নেতা কমীরা নদী বাঁচাও আন্দোলনসহ নানা মুখি কর্মসুচি গ্রহণ করে। ২৫ কোটি টাকায় খনন করা হয়েছে সাতক্ষীরার এক সময়ের প্রমত্তা বেতনা নদী। কিন্তু খননের পূর্বের অবস্থার চেয়ে বর্তমান অবস্থা আরো খারাপ। খনন কাজের পূর্বে নদীটি কমপক্ষে ১৫০ থেকে ২০০ মিটার চওড়া ছিল। কিন্তু খননের পর নদীটি পরিণত হয়েছে নালায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, যাচ্ছে তাইভাবে নদীটি খনন করায় দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। বেতনা নদীর মাঝ বরাবর খনন করার কথা ছিল ১০ থেকে ১৮ ফুট। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। কেবল বিনেরপোতা ব্রিজের কাছে দুই থেকে তিন ফুট গভীর করে খোঁড়া হয়েছে। কোথাও এক ফুটের বেশি মাটি তোলা হয়নি। উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়নে সাতক্ষীরার বেতনা নদী খনন ও পাড় বাধার জন্য ২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ২৫ কোটি টাকার ওই প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করে টাকা তোলার অভিযোগ আছে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে। স্থানীয়রা জানান, সাতক্ষীরায় বেতনা ছাড়াও মরিচ্চাপ নদী অদক্ষ পরিকল্পনার বলি হয়েছে। এক সময়ের স্রোতহীন নদী এখন মরা নালা। এছাড়া যমুনা, শালতা, শালিখা, সাপমারাসহ বিভিন্ন নদী-খালের অবস্থাও একই। জেলা সদরের লাবসা ইউনিয়নের বিনেরপোতা থেকে ব্রহ্মরাজপুর হয়ে ধুলিহর ইউনিয়নের সুপারিঘাটা পর্যন্ত বেতনা নদী সরু নর্দমায় পরিণত হয়েছে। মাছখোলা, দামারপোতা, শালো, বেড়াডাংগী, বড়দল, মাটিয়াডাংগা, নেহালপুর, তেঁতুলডাংগা গোবিন্দপুরসহ বিভিন্ন এলাকার পানি নিষ্কাশনের খালগুলো প্রভাবশালীরা দখল করে মাছের ঘের তৈরি করেছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে পানি নিষ্কাশনের সব পথ। কপোতাক্ষ ও বেতনা নদীর চর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ইটের ভাটা। খালের ঢালুকে পাড় বাঁধাই করে দেওয়ার কথা থাকলেও শুধু কাদার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। চর কেটে মাঝ দিয়ে উঁচু বেড়িবাঁধ তৈরি করায় নদী সরু হয়ে এসেছে। বর্তমানে বেতনা নদীর দু’ধারের চর দখল করে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ৫০টির বেশি ইটভাটা। তারা ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দেদারছে ইট পোড়াচ্ছে ভাটায়। তারা নদীর পলিমাটি কৌশলে কেটে নিয়ে ব্যবহার করছে। জলবায়ু প্রকল্পের আওতায় ২০১৩ সালের ২২ জুলাই ২৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে আটটি প্যাকেজের মাধ্যমে কলারোয়ার মুরারীকাটি থেকে সদরের সুপারীঘাটার দিকে ২৫ কিলোমিটার নদী খননের জন্য আহবান করা হয়। ২০১৪ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারি মধ্যে ওই কাজ শেষ করার কথা থাকলেও সেই সময়ে ঠিকাদাররা কাজ করতে পারেনি। ফলে কাজের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়িয়ে ২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত ধার্য করা হয়। কিন্তু ঠিকাদারা দায়সারাভাবে চেছে-ছুলে পুরো টাকা হজম করার চেষ্টা করে। তাদের দাবী কাজ শেষ হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলে ২৫-৩০ ভাগ, আর এলাকাবাসী বলে ৫-৭ভাগ কাজ হয় ঐ সময়। মূলত প্রমত্তা বেতনা নদীর মাঝে খাল কেটে নদী ভরাট করার চেষ্টা চালানো হয়। কপোতাক্ষ নদের প্রায় ৩০ কি. মি. এখন পলি পড়ে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। ফলে বেতনা ও কপোতাক্ষের দু’কূলে যশোর-সাতক্ষীরা-খুলনার লাখ লাখ মানুষ বছরে ছ’মাস পানিতে তলিয়ে থাকে। প্রায় ৫০ হেক্টর জমির ফসল ঘরবাড়ি ফি বছর বিনষ্ট হচ্ছে। মানুষ বাড়ি ঘর ছেড়ে স্কুল, কলেজ ও উঁচু রাস্তার পাশে আশ্রায় নেয়। বর্তমানে সাতক্ষীরায় হাজার হাজার বিঘা চিংড়ি ঘের আছে। চিংড়ি চাষের ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার কর্মজীবী কৃষক। একদিন পুরুষ-মহিলা সকলকে সারাবছর ব্যস্ত থাকতে হতো ধান-পাট কৃষিপণ্য উৎপাদন এবং এগুলো গুছিয়ে ঘরে উঠানোর জন্য। বর্তমানে কৃষক হারিয়েছে জমি, গবাদি পশু, গাছ-গাছালি সব মিলিয়ে এখানকার মানুষ এখন দারুণ কষ্টে আছে। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী অপূর্ব কুমার ভৌমিক জানান, ২০১৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২৫ শতাংশ বেতনা খননে কোন সফলতা আসেনি বললেই চলে। বেতনা খননে ১, ২, ৪ ও ৬নং পোল্ডারের আওতাধীন নতুন করে ৪৪ কিলোমিটার ও মরিচ্চাপ নদীর ৩৭ কিলোমিটার খননের জন্য ৫৪৩ কোটি টাকা চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। এতে নদীর নব্যতা বাড়াতে পাউবো-১ এর আওতাধীন দেবহাটার টিকেট ও শুকদেবপুর বিলে টিআরএম পদ্ধতিতে পাঁচ বছরের জন্য জলাধার নির্মাণের পরিকল্পনা উল্লেখ করা হয়েছে। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর সাব ডিবিশনাল প্রকৌশলি রাশেদুর রহমান জানান, ১, ২, ৬ও ৮ নং পোল্ডারের আওতাধীন নদী খনন ও পানি নিষ্কাশনের জন্য ৫৯৩ কোটি টাকা, নদীর তীর সংস্কারের জন্য ১৬’শ ৪৫ কোটি টাকা এবং জাইকার কাছে ৯০ কোটি টাকা চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী বি এম আব্দুল মোমিন জানান, জেলার নদী, খাল ও ¯øুইস গেটে সংস্কারের জন্যে আমরা ৭’শ কোটি টাকার পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি। বরাদ্দ পেলেই কাজ শুরু করতে পারবো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন