মরণবাঁধ ফারাক্কার ভয়াল থাবায় নদীমাতৃক বংলাদেশ আজ শুকনো মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। এদেশের অনেক নদনদী প্রবাহ হারিয়ে এখন মৃত প্রায়। এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মার বুকেও অনেক স্থানে দেখা দিয়েছে ডুবোচর। এতে পদ্মার সাথে সংযোগ রয়েছেÑ এমন অনেক নদীপ্রবাহ হারিয়ে মৃত্যুর মুখে পড়েছে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে প্রমত্তা পদ্মার ফরিদপুর শহরমুখী অংশে তথা কুমার নদ ও পদ্মার সংযোগস্থল মুনখালী পয়েন্টে জেগেছে ৪ কিলোমিটার ডুবোচর। ফলে ফলে পদ্মার প্রধান শাখা নদী কুমার, মধুমতি, ভুবনেশ্বর, চন্দনা, বাড়াশিয়াও শুকিয়ে বালিতে ভরে গেছে। পানির প্রবাহ না থাকার কারণে এসব নদী আজ মৃত প্রায়। পাশাপাশি পদ্মার পলিতে এবং ভূমিদস্যুদের দখলে জেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নদীগুলো।
নদী মরে যাওয়ায় মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে বৃহত্তর ফরিদপুরের পরিবেশ ও প্রতিবেশ। হুমকি পড়েছে জীববৈচিত্র্য। এ ছাড়া নদী শুকিয়ে যাওয়ায় জেলেদের পেশাও আজ হুমকির মুখে। সংসার চালাতে অনেক জেলে তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়ছে, কামার, কুমার, তাঁতী, জেলে ও নৌকার মাঝিরা এবং নৌকার ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীসহ ২০ পেশার শ্রমিজীবী মানুষ।
ফরিদপুর জেলা সদরের ডিক্রিরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিন্টু ফকির এবং নর্থচ্যানেল আওয়ামী লীগের সভাপতি মোফাজ্জেল হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, মদনখালীর পদ্মা-কুমার নদের প্রধান সংযোগস্থল তথা কুমার নদের পানি প্রবেশের উৎস মুখটি পদ্মার পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে ৩ থেকে ৪ বছর আগেই। ফলে কুমার নদে পানিপ্রবাহে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই মরা নদীর প্রায় ৬০ কিলোমিটার খননের পর দুইপাড় ধ্বংসে আবার ভরাট হয়ে গেছে। জনগণের কোনো উপকারে আসেনি নদী খনন।
পদ্মার সাথে আংশিক সংযোগ আড়িয়াল খাঁ, কুমারÑ ভুবনেশ্বর নদীর দুইদিকে থেকে এসে মিলিত হয়েছে। দুই নদীর পানি কমে যাওয়া, কুমার নদী শুকিয়ে এখন মরা খাল। ফলে বেকার হয়ে পড়ছে শাতাধিক জেলে। তারা আজ পেশা পরিবর্তন করে বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। পাশাপাশি কুমার নদীর দুইপাড় দখল হয়ে নদীর পাড়ে দোকান পাট ও বাসাবাড়ি নির্মাণ করায় নদী হারিয়েছে তার চিরচেনা রূপ। কুমার, চন্দ্রনা, বারাশিয়া, মধুমতি, ভুবনেশ্বর এসব নদী শুকিয়ে যাওয়ায় নদী সম্পৃক্ত পেশার মানুষ চরম বিপাকে পড়েছে। ফরিদপুর সিএন্ডবি ঘাট হয়ে, মদনখালী মোহনা থেকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সামগ্রী নিয়ে অল্প খরচে নিরাপদে ও আরামে ভ্রমণের আদলে, বিভিন্ন পণ্য নিয়ে, ভাঙ্গা, সদরপুর, নগরকান্দা, মধুখালী, সালথা উপজেলা সদরের হাটবাজারে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করত। শত শত পরিবারও জীবন-জীবিকা ছিল নদী পথনির্ভর। ফরিদপুর সিত্রন্ডবি ঘাটের ৩ শত নৌশ্রমিক এখন বেকার হয়ে পড়ছে। পদ্মার নাব্য কমে যাওয়া বড় বড় কার্গো, বলগেটে, মালটানা জাহাজ এখন ঘাটে ভিড়তে পারে না। দৈনিক ইনকিলাবের সাথে কথা হয়Ñ চট্টগ্রাম ও চাঁদপুর থেকে আসা এমভি নার্গি ও এমভি শাওনের সারেং ও চুকানির সাথে। তারা জানান, নাব্য কমে যাওয়ায়, অল্পসংখ্যক নৌযান আসলেও প্রায় ২০ থেকে ২২ কিলোমিটার নৌপথ ঘুরে আসতে হয়। ফলে জ্বালানি খরচ দ্বিগুনের বেশি পড়ে যায়। এ কারণে নৌযান অনেক কমে গেছে। ঘাটের শ্রমিকও কমে গেছে। শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় মহাজনদের বহু লোকসান হচ্ছে। সর্বোপরি শ্রমিকরা এখন আর কাজও পাচ্ছে না।
আগে কুমার নদসহ ৫টি নদের পানি সেচ কাজে ব্যবহার করায়, মাঠে তিন ফসলি বাম্পার ফলনও হতো। প্রতি বছর জোয়ারের পানিতে নিচু এলাকা এবং ফসলের মাঠে ভরে যেত পদ্মার নতুন পানিতে। পদ্মার পানির সাথে নতুন পলি আসায় ফসলও ভালো হতো। পানির সাথে নানান, প্রজাতির দেশি মাছ এসে ভরে যেত গ্রামগঞ্জের পুকুর, বিল ও হাওর। আর এসব এলাকার হাওর-বিলে শত শত জেলে নানান প্রজাতির দেশি মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। আজ তারা সবাই বেকার। অনেকে অন্য পেশায় যোগ দিয়ে সংসার চালাচ্ছে।
কুমার নদে আগে মাছ ধরা জেলে রিপন কুমার, পেশা পাল্টিয়ে এখন তিনি মোমিন খাঁর হাটে চুল কাটার কাজ করছে। শহরের লক্ষ্মীপুর এলাকার শ্যামা জেলের তিন পুরুষ কুমার নদে মাছ শিকার করত, এখন পেশা পাল্টিয়ে হাজীগঞ্জের বাজারে চায়ের দোকান করছেন। কুমার নদ দিয়ে মাটির হাড়ি-পাতিল-বাসন নিয়ে নৌকাযোগে মুকসুদপুর বাজারে গিয়ে বিক্রি করত সুকেশ জাইলা। এখন তিনিও পেশা পাল্টিয়ে ফরিদপুর কানাইপুর বাজারে ভ্যানে কাঁচা তরিতরকারী বিক্রি করন। সপ্তাহে ২ দিন কুমার নদ দিয়ে কাশিয়ানি ও ট্যাংরাখোলা বাজার নৌকা চালিয়ে পাঠের পাইকার নিয়ে বাণিজ্য করত গনেশ মাঝি। এখন সেই নদের গভীরতা নেই নৌকাও চলে না। ফারাক্কার প্রভাবে উজান থেকে ধেয়ে আশা পলি-বালি পড়ে প্রমত্তা পদ্মার বুকে ফরিদপুর অংশে, জেগে উঠছে শত শত ডুবোচর, ফলে এ অঞ্চলের ৭টি নদীতে পানির প্রবাহ নেই। নদী, পুকুর-বিল-হাওর এখন পানিশূন্য। আমন এবং ইরি মৌসুমে মাঠের পাশে পুকুর ডোবা হাঁওর বিলে পানি না থাকায়, ফসলের মাঠ ও পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে যায়। আগে নতুন পানির সাথে আসা জমিতে পলি পড়ে ফসলও ভালো হতো, সার ও সেচ খরচ লাগত না। এতে আগের চেয়ে ৪ গুন খরচে কৃষকদের মাঠে মাত্র দুটি ফসল ঘরে তুলতে হয়।
অন্যদিকে এসব নদী পাল্লা দিয়ে চলছে ভরাট ও দখল। যে যার মতো, পাকা ঘরবাড়ি এবং নদীর মধ্যে বাঁশ দিয়ে মাচা পেতে টং ঘর তৈরি করছে। এ চিত্র সবচেয়ে বেশি সদর থানার মিষ্টিপট্টিতে। এতে বর্ষা মৌসুমে, পানির প্রবাহ প্রচণ্ড রকমের বাধাগ্রস্ত হয়। অপরদিকে, ফরিদপুর হাজীশরীয়তুল্লা বাজার ব্রিজের এপারওপারে পাল্লা দিয়ে, নদীতে ময়লা-আবর্জনা এবং গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগির বর্জ্য এবং কাঁচাবাজারের ময়লা ফেলায় ৫০ বছরের ঘাটলাটিও আবর্জনায় ডুবে গেছে। ময়লা-আবর্জনার পচা গন্ধে বাজারের পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।
অপরিকল্পিতভাবে নদী খনন, দখল, ভরাট ও দূষণের ব্যাপারে, ইনকিলাবের সাথে কথা হয় ফরিদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে। তিনি বললেন, সকলবিষয় অবগত হলাম। খুব শিগগিরই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অপরদিকে, জবরদখলে শীর্ণ হচ্ছেÑ মাদারীপুরের কুমার নদ অবৈধ স্থাপনার মাধ্যমে সক্রিয় একটি গ্রুপ হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অথচ দেখার মতো কেউ নেই। মাদারীপুর আড়িয়াল খাঁ নদীর শাখা কুমার নদ। ওই নদের মুখেও চর পড়ে শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে নদ। এ সুযোগে কুমার নদের জেগে ওঠা চরে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় একের পর এক নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে দখল করছে স্থানীয়রা। সেই সাথে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কুমার নদের তীরে পাঁচ শতাধিক দখলদার কুমার নদের ভরাটকৃত অংশে প্রায় ৫ একর জমি দখল করে বাড়িঘর, দোকানপাট, করাতকল ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বসবাস করছে। ক্রমাগত দখলদারের সংখ্যা বাড়লেও প্রশাসন এ ব্যাপারে নজর দিচ্ছে না। মাদারীপুর শহর ঘেঁষা পুরান বাজারের রাস্তি এলাকায় চর দখল করে বেশ কয়েকটি স্থাপনা নির্মাণের সাথে জড়িত ১৬ জন প্রভাবশালী বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কতিপয় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি জোট গঠন করে গত শুকনো মৌসুমে বালি দ্বারা ভরাট অংশ উঁচু করে ভরাট করে তা দলিলবিহীন দখল দেখিয়ে বিক্রি করে স্থানীয়দের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। স্থানীয়রা নদের যায়গায় বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে বসবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, কুমার নদের জমি দখল করে বাদল মোল্লা নামের এক দখলদার পাকা স্থাপনা নির্মাণ করেছে। বাদল মোল্লার দাবি, সে এই জমি কিনে স্থাপনা নির্মাণ করছে। তবে সে জমি কেনার কোনো দলিল বা কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। দুইজন প্রভাবশালীর কাছ থেকে সে দখল নিয়েছে বলে স্থনীয় এক ব্যবসায়ী জানায়। যেহেতু যারা বিক্রি করেছে, তাদের কোনো কাগজ বা দলিল নেইÑ তাই তারা মৌখিকভাবে পজেশন জমি বিক্রি করেছে বলে জানান বাদল মোল্লা। সরকারি জমিতে পাকা স্থাপনা নির্মাণের ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কারো অনুমতি নিয়েছেন কি-না এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি নির্মাতা। তবে এ ব্যাপারে দখলদার বাদল মোল্লা বলেন, আমাদের কেনা সম্পত্তি এখানে আছে। তারপরেও যদি সরকারি জমিতে ঘর করে থাকি, তাহলে সরকার চাইলে ভেঙে দেবে।
অনুসন্ধানের আরো জানা গেছে, বাদল মোল্লা ছাড়াও বাদশা বেপারী, রুপাই, সুফিয়া বেগম, বাচ্চু বেপারী, আনোয়ারসহ অনেকে জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করে বসবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, পূর্ব রাস্তি মৌজার ২৯৪ নম্বর খতিয়ানের এসএ ৯৯০ নম্বর দাগের ৩ একর জমির মধ্যে ২ একর ২০ শতাংশ জমি বিভিন্ন মালিকের নামে রেকর্ড রয়েছে এবং তারা ভোগ দখলে আছে। উক্ত ৩ একরের মধ্যে ৮০ শতাংশ ও অন্যান্য দাগের প্রায় ৪ একরসহ প্রায় ৫ একর জমি নদী সিকস্তী হিসাবে ১/১ খতিয়ানে বাংলাদেশ সরকারের নামে বিআরএস-এর মাঠ জরিপে রেকর্ডভুক্ত করা হয়। অভিযোগ রযেছে, স্থানীয় প্রভাবশালী ১৬ জনের একটি গ্রুপের নেতৃত্বে নদী সিকস্তী জমি ভরাট করে বিভিন্ন লোকের কাছে দলিলবিহীন দখল দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ১৬ জনের ওই গ্রুপটি।
মাদারীপুর বিসিক শিল্প নগরীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা জানান, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কুমার নদের তীরে পাঁচ শতাধিক দখলদার কুমার নদের ভরাটকৃত অংশে প্রায় ৫ একর জমি দখল করে বাড়িঘর, দোকানপাট, করাতকল ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বসবাস করছে। ক্রমাগত দখলদারের সংখ্যা বাড়লেও প্রশাসন এ ব্যাপারে নজর দিচ্ছে না।
এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিসিকের হুকুম দখলকৃত ১৫ একর জমির মধ্যে অনুমোদিত ৮৪টি শিল্প-কারখানার মধ্যে ৭টি স’মিল যা ফার্নিচারের দোকান হিসেবে বরাদ্দ ও অনুমোদিত এর বাইরে নদের তীরে প্রায় ৫ একর জমিতে অবৈধভাবে ৭ থেকে ৮টি স’মিল ও ট্রলি বসিয়ে ব্যবসা করে আসছে অবৈধ দখলদাররা। এছাড়াও বাড়িঘর দোকানপাট ও আড়তঘর নির্মাণ করা হয়েছে, সরকারি জমিতে যার কোনো বৈধতা নেই। মাদারীপুর বিসিক শিল্পনগরীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, মাদারীপুর বিসিক সংলগ্ন কুমার নদের পাড়ের প্রায় ৫ একর জমি বিসিকের নামে বরাদ্দের জন্য প্রস্তাব তোলায় তা নিয়ে রাজনৈতিক ও বিভিন্ন মহলের তোপের মুখে পড়ে, সে প্রস্তাব থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। এখানের অবৈধ দখলদাররা রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় আছে। যে কারণে প্রশাসনও বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, শুধু বিসিক-এর পাশে নয়, কুমার নদের দুইপাড়েই কিছু দখলদার বিভিন্ন সময় ধরেই এ স্থাপনাগুলো নির্মাণ করে আসছে। দখলকৃত জমিতে বেশ কিছু স’মিল, বাড়িঘর, আড়তঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। নদীর পাড় দখল করায় নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য যা করার সবই করব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন