স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের নির্ধারিত শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। গত ১৫ মার্চ ’১৮ জাতিসংঘের পলিসি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এই তথ্য প্রকাশ করেছে। তবে চূড়ান্তভাবে এই যোগ্যতা অর্জন করতে আরও ছয় বছর উন্নতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। আগামী ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি মিলবে। এলডিসি থেকে বের হতে হলে মাথা পিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এই তিন সূচকের যে কোন দুটিতে সিডিপি নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশ তিনটিতেই যোগ্যতা অর্জন করেছে। স্বাধীনতা লাভের ৪৭ বছর পর জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিপি) শ্রেণি থেকে বের হওয়ার যোগ্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন।
কোনো দেশের প্রথম বারের মতো এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য অনেক ধাপ রয়েছে। বিভিন্ন যোগ্যতানুযায়ী বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে হয়। বাংলাদেশকে এই সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশ হবে বাংলাদেশ। নতুন এ অভিযাত্রায় সুযোগের পাশাপাশি অনেক চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি হবে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাণিজ্য ও বৈদেশিক ঋণে যেসব বাড়তি সুযোগ রয়েছে, তার সবকিছু থাকবে না। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার কার্যকর বাস্তবায়ন হলে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে মানুষের জীবনমানের ক্রমাগত উন্নতি করা সম্ভব।
এর আগে বহু দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্য বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এ তিনটি সূচকেই যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ, যা এর আগে অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে ঘটেনি। বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার ও লাওস এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। ভুটান, সাওতোমে ও প্রিনসিপে এবং সলোমন দ্বীপপুঞ্জ দ্বিতীয়বারের মতো যোগ্যতা অর্জন করায় তাদের এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করেছে সিডিপি।
প্রতি তিন বছর পর পর সিডিপি এলডিসি দেশগুলোর অবস্থা পর্যালোচনা করে। বাংলাদেশ ২০২১ সালে দ্বিতীয়বার পর্যালোচনায় যোগ্য হলে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করবে এই কমিটি। এর তিন বছর পর অর্থাৎ ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছাবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাই মাসে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। মাথাপিছু আয়ের বিবেচনায় এ শ্রেণিকরণ করে বিশ্বব্যাংক। জাতিসংঘ তার সদস্য দেশগুলোকে স্বল্পোন্নত (এলডিসি), উন্নয়নশীল এবং উন্নত- এ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করে। বাংলাদেশ ১৯৭৫ সাল থেকে এলডিসিভুক্ত দেশ।
২০২১ সালে দ্বিতীয় পর্যালোচনা করবে সিডিপি। ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এ উত্তরণকে অনুমোদন দেবে। বাংলাদেশের অগ্রগতি এখন যেভাবে আছে, তার কোনো বড় ধরনের ব্যত্যয় না ঘটলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছাবে।
সবচেয়ে বড় বিষয় মর্যাদার। বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে তার একটা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া গেল। বাংলাদেশকে সবাই তখন আলাদাভাবে বিচার করবে। আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিরও সম্ভাবনা রয়েছে। চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো হলো, উন্নয়নশীল দেশ হলে বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে বাণিজ্যে যে অগ্রাধিকার পায় তার সবটুকু পাবে না। আবার বৈদেশিক অনুদান, কম সুদের ঋণও কমে আসবে। বাংলাদেশ তার সক্ষমতা দিয়ে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে।
যারা এর আগে এলডিসি থেকে বের হয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। প্রথমত, সুশাসন নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়ন ও রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হতে হবে। উন্নতি করতে হবে জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষায়। বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। উচ্চ মূল্য সংযোজন হয় এমন শিল্পের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। জাতীয় অগ্রাধিকার বিবেচনায় রেখে বৈদেশিক ঋণের ব্যবহার করতে হবে।
বাংলাদেশের এ অর্জন নিয়ে খুব বেশি আত্মতুষ্টিতে না ভুগে সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। বাংলাদেশ এখন বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনেক কম সুদে এবং অপেক্ষাকৃত সহজ শর্তে ঋণ পায়। বিশ্বব্যাংক গ্রæপের পক্ষ থেকে এ ধরনের ঋণ দেয় এর অঙ্গ সংস্থা আইডিএ। আরও কয়েক বছর পর হয়তো বাংলাদেশ আইডিএ ঋণ পাবে না। বাংলাদেশকে এ বিষয়টি মাথায় রেখে এগোতে হবে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের তিন বছর পর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বর্তমান জিএসপি সুবিধা থাকবে না। উন্নয়নশীল দেশগুলো ইইউতে জিএসপি প্লাস সুবিধা পায়। বাংলাদেশকে তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এলডিসি না থাকলে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশেও অনেক ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না। এ জন্য বিমসটেক, বিবিআইএনের মতো আঞ্চলিক উদ্যোগের সুবিধা কীভাবে কার্যকরভাবে নেওয়া যায় তার প্রস্তুতি থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। কেননা শুল্কমুক্ত সুবিধা না থাকলে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলেও ২০২৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপেীয় ইউনিয়নের ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ উদ্যোগের আওতায় পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। বাংলাদেশ মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার, পরিবেশ ও সুশাসন বিষয়ে ইইউর নিয়ম-কানুনের শর্ত পূরণ করলে জিএসপি প্লাস নামে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধাও পাবে।
ঝুঁকি বা চ্যালেঞ্জের সঙ্গে এলডিসি হিসেবে পাওয়া বাণিজ্য সুবিধার বিষয়টি সরাসরি সম্পৃক্ত। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ আঞ্চলিক বা দ্বিপাক্ষিক চুক্তির অধীনে বিভিন্ন দেশে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানির সুবিধা পায়। এর সঙ্গে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অনেক দেশ আমাদের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। আবার এলডিসি হিসেবে ওষুধ রফতানির ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিবিধান থেকে আমাদের অব্যাহতি রয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশকে কম সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে। যেহেতু এলডিসি হিসেবে এসব সুবিধা বাংলাদেশ পেয়ে থাকে, এলডিসি না থাকলে তখন সুবিধাগুলো টিকিয়ে রাখা যাবে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
ইইউ জিএসপি প্লাস সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানদন্ডে যাচাই করে। দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, কার্বন নিঃসরণ কমানোসহ কিছু বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত দেখে তারা এ সুবিধা দেবে। বাংলাদেশকে এ জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে।
রফতানিতে প্রতিযোগিতা বাড়বে সন্দেহ নেই। হিসাব করে দেখা গেছে, সুবিধা উঠে গেলে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ক্ষেত্রে সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ শুল্ক বাড়তে পারে। এতে করে মোট রফতানির ৮ শতাংশ ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়লে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যয় কমানো গেলে বাড়তি শুল্কের ঝুঁকি মোকাবেলা সম্ভব।
আরেকটি বিষয় হলো, শুল্কমুক্ত সুবিধা উঠে গেলে আমদানিকারক দেশের ভোক্তাদের ওপর তার প্রভাব পড়বে। তাদের তুলনামূলক বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে। এসব দেশে ভোক্তা সংরক্ষণ নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের কাছে তথ্য-উপাত্তসহ বিষয়গুলো তুলে ধরার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা লাগবে। দেশগুলোর নীতি-নির্ধারকদেরও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জানাতে হবে। বাণিজ্য সুবিধা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এসব অ্যাডভোকেসি কাজে দেবে। বাংলাদেশ এখনও ১০ বছর সময় পাবে। ১০ বছর কিন্তু খুব বেশি সময় নয়। বাংলাদেশকে নতুনভাবে নেগোসিয়েট করার প্রস্তুতি নিতে হবে। সুবিধাগুলো যাতে কোনো না কোনোভাবে বজায় থাকে তার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম হলো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এর একটা প্রভাব ভবিষ্যতে আসবেই। বিশ্বব্যাপী রোবোটিক্স কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার ঘটছে। এসবের প্রভাবে শ্রম চাহিদার পরিবর্তন হবে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ শ্রমনিবিড় প্রযুক্তির উৎপাদনে থাকতে চাইছে না। তারা যখন বিনিয়োগ স্থানান্তরের চিন্তা করবে এবং যদি বাংলাদেশের কথা ভাবে তাহলে এখানে তখন উন্নততর প্রযুক্তিতে কারখানা স্থাপন করতে চাইবে। এ জন্য যে ধরনের শ্রমিক চাহিদার দরকার হবে তা দিতে না পারলে তারা আসবে না। এখন পর্যন্ত ভিয়েতনাম এদিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ এ ধরনের সুবিধা গ্রহণের প্রস্তুতিত নিতে না পারলে তখন ভিয়েতনামের মতো দেশে বিনিয়োগ চলে যাবে।
বাংলাদেশ সরকারের নিকট সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আগামীতে একটি নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ সকল দলের গ্রহণযোগ্য একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করা। তা নাহলে আমাদের অর্জনের পথে বড় বাধা এসে উপস্থিত হবে। সুষ্ঠু, সুন্দর ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক পরিবেশ অবশ্যই বিরাজমান রাখতে হবে। সত্যিকারার্থেই আইনের শাসন কায়েম করতে হলে সকলের জন্য আইন সমানভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। গুম, খুন ও বিচার হীনতার রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসবে। বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে প্রবেশ করা যাবে না।
লেখক: সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন